একটি ভৌতিক সন্ধ্যা

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

জাপানে এখন শরৎ ঋতু বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চলছে পাতা ঝরার মৌসুম। বাহারি রঙের শুকনো পাতা যেন প্রকৃতিকে নতুন রূপে সাজিয়ে যাচ্ছে। চোখধাঁধানো প্রকৃতির এমন রূপ দেখতে দেখতে রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৫ মিনিট পাহাড়ি ঢাল বেয়ে পৌঁছাই বাচ্চাদের হোইকুয়েনে।

যথারীতি সেদিনও ব্যতিক্রম হলো না। এখন বেলা বেশ ছোট। সাড়ে চারটায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। হোইকুয়েন থেকে বের হতেই বাচ্চাদের আবদার চকলেটের। চকলেট না নিয়ে বাড়ি ফিরবে না। কী আর করা, বাচ্চাদের আবদার মেটাতে রওনা হলাম কনভেনিয়েন্স স্টোর সেভেন ইলেভেনে। ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে জাপানের কনভেনিয়েন্স স্টোরের জুড়ি নেই।

সেভেন ইলেভেনে পৌঁছার পর দুই ভাইবোন নিজেদের পছন্দমতো চকলেট কিনল। আমিও বাচ্চাদের জন্য কিছু খাবার কিনে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর কেন জানি যে রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে যাই, সে রাস্তা বাদ দিয়ে অন্য একটা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলাম।

রাস্তার ঠিক বিপরীত দিকে একটা পরিত্যক্ত গির্জা আছে। সেখানে বাচ্চাদের খেলার জন্য স্লাইড আর সুইং আছে। কিন্তু কোনো দিন কাউকে এখানে খেলা করতে দেখিনি। সেদিন হঠাৎ দেখলাম দুটি মেয়ে আর একটি ছেলে বয়স ছয়–সাত হবে খুব আনন্দ নিয়ে সেখানে খেলা করছে। মেয়ে দুটি দেখতে অবিকল এক রকম। যমজ বোন। ছেলেটি খুব সম্ভবত ভাই।

ওদের খেলতে দেখে আমার বাচ্চারা সেদিকে খেলার জন্য যেতে চাইল। আমিও কেন জানি নিষেধ করলাম না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমি অবচেতন মনে বাচ্চাদের নিয়ে সেই পরিত্যক্ত গির্জার সামনে গেলাম। আমার মেয়ে দৌড়ে স্লাইডের ওপর উঠে গেল। ছেলেটি আর মেয়েটি একটি বল নিয়ে খেলছে। আর আরেকজন মেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে।

আমার ছেলে খুব চাচ্ছে ওদের সঙ্গে খেলতে। কিন্তু ওরা যেন আমার ছেলের দিকে ফিরেই তাকাচ্ছে না। আমার ছেলে কত কথা বলছে। কিন্তু ওরা আপন মনে খেলেই যাচ্ছে। এমন সময় দূর থেকে পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেয়ে দেখি হোইকুয়েনের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রিন্সিপাল এনসো সেনসেই আমার ছেলেমেয়েকে ডাকছেন। তিনি বারবার বাসায় ফিরে যেতে বলছেন।

আমি তখন বাচ্চাদের নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু বাড়ির পথ যেদিকে আমি সেদিকে না গিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে অন্য পথে হাঁটতে শুরু করলাম। একদম ঘোর সন্ধ্যা। আমার অচেনা পথ কেবল আমাকে উঁচু পাহাড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমার মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, এ পথে কি বাসায় পৌঁছানো যাবে?

আমার মনে খটকা লাগল। থমকে দাঁড়ালাম। আমি তো ভুল পথে যাচ্ছি। আমার তো পেছনের পথে যাওয়ার কথা।

হঠাৎ সেই তিন ভাইবোন যারা গির্জার সামনে খেলছিল, তারা এসে দাঁড়াল সামনে। তিনজনেরই দুই চোখ রক্তবর্ণ এবং দাঁতগুলো ভয়ংকর।

আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, চকলেট না দিয়ে কোথায় যাচ্ছ? আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল।

ভয়ে তখন আমাদের অবস্থা কাহিল। মনে পড়ল, আমাদের সঙ্গে অনেকগুলো চকলেট আছে। সঙ্গে সঙ্গে চকলেট ভরা পলিথিনের ব্যাগটি ওদের দিকে ছুড়ে দিয়ে মা ছেলেমেয়ে মিলে দৌড় দিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে আবারও হোইকুয়েনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এনসো সেনসেই তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে।

আমাকে হাঁপাতে দেখে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এখনো বাসায় যাওনি? ওদিকে কোথায় গিয়েছিলে? আর পুরোনো গির্জায় কেউ প্রবেশ করে না। ওটা ভুতুড়ে।’ তিনি জানালেন আমার ছেলেকে দূর থেকে দেখেছেন অদৃশ্য কারও সঙ্গে কথা বলছে। তখনই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। তখন নিরুপায় হয়ে সব খুলে বললাম। সবকিছু শোনার পর এনসো সেনসেই যা বললেন, তাতে আমাদের পায়ের নিচে মাটি ফাঁক হয়ে গেল।

প্রায় ১০ বছর আগের ঘটনা। পরিত্যক্ত সেই গির্জার পাশে পুরোনো জনমানবহীন যে বাড়িটা পড়ে আছে, সেই বাড়িতে আওকি নামের এক নারী বাস করতেন। তাঁর সঙ্গে দুটি যমজ মেয়ে আর একটি ছেলে থাকত। সবাই জানত ওরা সেই নারীর সন্তান।

একদিন হঠাৎ করে পুলিশ সেই বাড়ি থেকে তিনটি শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করে। তাদের বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়। এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। গোয়েন্দা পুলিশের তত্ত্বাবধানে পরে জানা যায়, সেই নারীই ওই তিন শিশুকে হত্যা করে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেছেন। শিশু তিনটি নারীর স্বামীর প্রথম স্ত্রীর সন্তান ছিল। দুই বছর আগে এক দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। এরপর ওই নারী অন্য একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব এড়াতে ও ঝামেলা মুক্ত হতে প্রেমিকের পরামর্শে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেন শিশু তিনটিকে।

জীবিত থাকতে প্রতিদিন বিকেলে তিন ভাইবোন মিলে গির্জার পাশে খেলতে আসত। লোকে বলে শরতের কোনো এক শেষ বিকেলে শেষবারের মতো ওরা এসেছিল এখানে খেলতে। এরপর প্রতিবছর শরতের শেষ সন্ধ্যায় ওই গির্জার পাশে বাচ্চাদের কলকাকলি শোনা যায়। অনেকে একা পথে কখনো কখনো ওদের ভৌতিক রূপ দেখতে পায়। যেমনটা আমরা পেয়েছি। সৎমায়ের ষড়যন্ত্রে প্রাণ হারানো শিশু তিনটির আত্মা আজও ভেসে বেড়ায় সন্ধ্যার বাতাসে। ওদের কান্নার শব্দে কখনো কখনো নিস্তব্ধ পথ থমকে দাঁড়ায়। পথিক ভয়ে দৌড়ে পালায় যেমনটি আমরা করেছি।