ড্যান ও ক্যাথির ভালোবাসা

লেখিকার মেয়ে তাজরির সঙ্গে ড্যান-ক্যাথি। ছবি: লেখিকা
লেখিকার মেয়ে তাজরির সঙ্গে ড্যান-ক্যাথি। ছবি: লেখিকা

আর পাঁচ দিন পর ড্যান-ক্যাথি পাঁচ মাসের সফর শেষে ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া ফিরবেন। এই পাঁচ মাসে আমরা তাঁদের কাছ থেকে মোট আটটি পোস্টকার্ড পেয়েছি। প্রত্যেকটি কার্ডে তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তসহ কার্ডের পেছনে সেই স্থানগুলোর সুন্দর ছবি দেওয়া আছে।

পোস্টকার্ডগুলো পড়ে মনে হয় ইউরোপ শুধু তাঁরা একা নয়, আমরাও যেন তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছি। আর তাঁদের সঙ্গে হাইকিং, বাইকিং, বোটিংসহ সব রকমের আনন্দ করছি।

এত কাল ধরে ভেবে এসেছি, আমি খুব যত্ন করে ভালোবাসতে জানি। কিন্তু ড্যান-ক্যাথির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর মনে হয়েছে, ভালোবাসার অনেক দিক এখনো আমার দেখাই হয়নি।

আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ যেখানে মানুষকে চিঠি লেখার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে, সেখানে আধুনিক সব প্রযুক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আমাদের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে শুভেচ্ছাকার্ড পাঠাতে কখনো তাঁদের ভুল হয় না। জাগতিক দ্রব্যাদি বিনিময়প্রথা যেখানে আমাদের ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে, সেখানে ড্যান-ক্যাথির ভালোবাসা যেন হিরে বসানো সোনার ফুল।

এই বছরের শুরুর দিকের কথা। নিউজিল্যান্ডের মসজিদের বোমা হামলার পরদিন ড্যান-ক্যাথি একগুচ্ছ গোলাপ আর কাপ কেক বানানোর যাবতীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে হাজির আমাদের বাসায়। উদ্দেশ্য একটাই, মুসলিম জাতি হিসেবে আমাদের বিক্ষিপ্ত মনকে একটু শীতল করা। আমাদের বাসায় ফ্লাওয়ার ভাস আছে কী নেই, এই ভেবে একটা জারও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন।

লেখিকার মেয়ে তাজরির স্কুল হলিডেতে বেড়ানো। ছবি: লেখিকা
লেখিকার মেয়ে তাজরির স্কুল হলিডেতে বেড়ানো। ছবি: লেখিকা

ক্যাথির চিন্তার পরিধি কতটা বিস্তৃত আমি ভেবে কোনো কূল-কিনারা পাই না। এরপর শুরু কাপ কেক বানানো পর্ব। জীবনে প্রথমবারের মতো কাপ কেক বানানো শিখলাম সেদিন। এ ছাড়া, ক্যাথি নিজের হাতে আমাকে খুঁটিনাটি কত কী যে শিখিয়েছেন এই দুই বছরে, তা বলে শেষ করা যাবে না।

বিস্কুট, চকলেট কাপ কেক, ড্রিমবার, পামকিন স্যুপ, ফ্রেটাটা ইত্যাদি। আর প্রতিটি খাবারের রেসিপি পরম মমতায় তাঁর হাতের গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিয়েছেন। এ তো গেল রন্ধনশিল্প।

এর বাইরে রান্নাঘরের ইলেকট্রিক চুলার কোন জিনিসটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটা পর্যন্ত আমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছেন। ক্যাথি আমার রান্নাঘরে যতবার ঢুকেছেন ঠিক ততবারই কোনো না কোনো জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করে পরেরবার আসার সময় ঠিক সেটা নিয়ে এসে নিজের হাতে সেটা রান্না ঘরে গুছিয়ে দিয়ে গেছেন। বিদেশি মায়ের ভালোবাসা কতটা যত্নশীল হতে পারে, সেটা আমি আমার ক্যাথি মায়ের ভালোবাসা পেয়ে বুঝেছি।

খুব আশ্চর্য হয়ে আর একটা বিষয় আমি দেখি, সেটা হলো ড্যান-ক্যাথি যতক্ষণ আমার বাসায় থাকেন ততক্ষণ আমার সাত বছরের মেয়েটাকে স্টোরি বুক পড়িয়ে শোনান। পড়াটা এতটাই কৌতুকপূর্ণভাবে শোনান যে, তাজরির হাসি আর থামে না।

ড্যান-ক্যাথির বাসায় খেলারত অবস্থায়। ছবি: লেখিকা
ড্যান-ক্যাথির বাসায় খেলারত অবস্থায়। ছবি: লেখিকা

এ ছাড়া নানাবিধ শিক্ষণীয় গেম তো আছেই। তাজরির দাদা-নানাও বোধ হয় তাজরিকে কাছে পেয়ে এতটা শ্রম দেওয়ার সময় বা সাহস কোনোটাই পাননি। এই দুই বছরে তাজরি যতগুলো স্কুল হলিডে পেয়েছে, প্রত্যেকবারই তাঁরা নিজের উদ্যোগে আমাকে আর তাজরিকে নিয়ে ঘুরেছেন।

তাজরির বাবাকে অবশ্য খুব একটা আমাদের এসব ঘোরাঘুরিতে জড়াননি। এ বিষয়ে তাঁদের একটাই কথা, ‘পিএইচডি স্টুডেন্টের অনেক পড়াশোনা। ওর সময় নষ্ট করা যাবে না।’ আমি ভেবে অবাক হই, এই দুজন মানুষের কতদিকে খেয়াল।

আমার আজও মনে আছে, আমরা অস্ট্রেলিয়া আসার এক সপ্তাহ পর প্রথমবারের মতো ড্যান-ক্যাথি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সেদিন আমি সাত পদের খাবার দিয়ে তাঁদের আপ্যায়ন করেছিলাম।

বাংলাদেশের অতিথি আপ্যায়নের রেওয়াজ অনুযায়ী সাত পদ তেমন আহামরি আয়োজন নয়। কিন্তু খেতে বসে যখন ড্যান-ক্যাথি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি নিজেদের জন্যও এতগুলো রান্না কর প্রতিদিন?’ আমি খুব আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বললাম, ‘না’। ড্যান-ক্যাথির সরল জবাব, ‘তাহলে আমাদের জন্য করেছ কেন? এটা তো রীতিমতো খাবারের অপচয়। আর কখনো আমাদের জন্য এত রান্না একসঙ্গে করবে না, তাহলে কিন্তু আমরা রাগ করব।’

এই হলেন ড্যান-ক্যাথি। আমার প্রাণের খুব কাছাকাছি থাকা দুজন মানুষ। যাঁদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আমি শিখেই চলেছি। গত পাঁচ মাস তাঁদের অনুপস্থিতি আমাকে সাময়িক পীড়া দিলেও তাদের শূন্যতা তাঁরা বোধ করতে দেননি। কারণ, পাঁচ মাসে তাঁদের আটখানা চিঠির ধারাবাহিক ভ্রমণবৃত্তান্ত ভৌগোলিকভাবে তাঁদের দূরত্বে রাখলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে একমুহূর্তের জন্যও দূরে রাখতে পারেনি।

ইউরোপ ভ্রমণকালে ড্যান-ক্যাথির পাঠানো পোস্ট কার্ড। ছবি: লেখিকা
ইউরোপ ভ্রমণকালে ড্যান-ক্যাথির পাঠানো পোস্ট কার্ড। ছবি: লেখিকা

আর তাই তো আমার ছোট্ট মেয়েটাও দিন–তারিখ গুনে গুনে রেখেছে এত দিন। হঠাৎই আজ হুংকার দিয়ে বলে উঠল, ইয়েস, আর কদিন পরেই ড্যান-ক্যাথি চলে আসবে।

তাজরির কথা শুনে আমিও মনে মনে বলি, ড্যান-ক্যাথি, আমার প্রবাসজীবনের একমাত্র অভিভাবক, আমার হাজার কথা শোনার উন্মুখ শ্রোতা। এই পাঁচ মাসে কত কথা জমে গেছে তাঁদের বলার জন্য। 

লাভলী ইয়াসমীন
গসফোর্ড, সেন্ট্রাল কোস্ট
নিউ সাউথ ওয়েলস
অস্ট্রেলিয়া