গৃহকর্মী বোনদের ওপর অত্যাচারের বিচার চাই

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

আমার বন্ধু মৌমিতার বাসা ঢাকার মিরপুরে। তাদের বাসার পাশের জমিতে বস্তি। মানে যিনি জমির মালিক, তিনি থাকেন উত্তরা। জমি দখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে ছোট ছোট ঘর করে ভাড়া দিয়েছেন। কাঠের একটা কারখানাও আছে। যেখানে ফার্নিচার বানানোর কাজ চলে।

মৌমিতাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা বাগান আছে। সেই বাগানে একটা শিউলি ফুলগাছ আছে বিশাল। ভোরে মৌমিতাদের বাসায় ছুটা বুয়া যখন কাজে আসে, তখন কলাপাতায় ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসে। শিউলি ফুল সারা দিন তাজা থাকে না। কিন্তু সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মনটা খুশিতে ভরিয়ে রাখার মতো থাকে।

একদিন মৌমিতা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল শিউলিগাছটা খুব দুলছে অথচ আশপাশের গাছগুলোর পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। ঘটনা কী দেখতে নিচে নেমে মৌমিতা দেখল, ছোট্ট একটা মেয়ে খালি পায়ে বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। জামার কোঁচড়ে কুড়ানো শিউলি ফুল। মৌমিতাকে দেখে মেয়েটা একছুটে পালিয়ে গেল গেট পেরিয়ে।

মৌমিতা মনে মনে ওর নাম দিল ফুল কুমারী। মনে তাকে উদ্দেশ করে আরও বলল, ও মেয়ে এ ফুল ফুটছে শুধু তোমার জন্য...।

পরের কয়েক দিন ফুল কুমারী এল আরও ভোরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে গেট পেরিয়ে অনেক ঘুরে পাশের বস্তির একটা ঘরে যেতে দেখল মৌমিতা। তারপর কয়েক দিন ধরে খেয়াল করল ফুল কুমারীর মা অনেক সকালে কাজে চলে যায়। বাবা কাঠের কারখানায় কাজ করে। মেয়েটি স্কুলে যায় না, ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

এক বছর পর মৌমিতা তাদের বাসার দারোয়ানের কাছে শুনল, বেশি আয়ের আশায় সামনের বস্তির কয়েকজন মহিলা সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে যাবেন। ফুল কুমারীর মাও তাঁদের একজন। মাস কয়েক পর ফুল কুমারীর মা চলে গেলেন। তিনি মেয়ের জন্য রেখে গেলেন একটা ব্যবহৃত শাড়ি। মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে রোজ শাড়ি ধরে কাঁদত।

কত কষ্ট বুকে নিয়ে একটা মা চলে গেলেন। কত কষ্ট ছোট বাচ্চাটার। প্রথম প্রথম লোক মারফত কিছু টাকা বা জিনিস পেত তারা। কিন্তু পরে সব কেমন যেন বন্ধ হয়ে গেল।

এদিকে পত্রিকায় সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের অত্যাচারের খবর মৌমিতা নিয়মিত পেতে লাগল। দরোয়ানের কাছে জানল, ফুল কুমারীর মা সৌদি আরব থেকে চলে আসতে চাইছেন। কিন্তু আইনি কী এক জটিলতায় আটকে গেছেন তিনি।

তারপর সেই ভয়ংকর দিন এল। সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। মৌমিতাকে দারোয়ান বাগানে নিয়ে গেল। মৌমিতা দেখল, ফুল কুমারী শিউলিগাছের নিচে অঝোরে কাঁদছে। ফুল কুমারী মৌমিতাকে জানাল, ওর মা মারা গেছে, আর আসবে না।

আমরা বাংলাদেশিরা পরিশ্রমী জাতি। ভাগ্যান্বেষণে পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের মতো আমরাও যাই বিভিন্ন দেশে। তাই বলে অত্যাচার করে মানুষ মেরে ফেলার মতো সাহস সে দেশের লোকের কেন হবে?

মুসলমান মানুষ আমি, ওমরাহ করা। নিজেকে মহা সৌভাগ্যবান মনে হয় সৌদি আরবের পুণ্যভূমিতে পা রাখতে পেরেছি বলে। কিন্তু ইবলিসের চেয়েও বড় শয়তান কীভাবে বেঁচে থাকে সে দেশে? কোথায় কঠিন বিচার? সৌদি আরবে আমার গৃহকর্মী বোনদের ওপর অত্যাচারের বিচার চাই। এটা ২০১৯। বর্বর প্রস্তর যুগ নয়। পৃথিবীজুড়ে হুজুর, প্রিস্ট, পুরোহিতদের অন্যায়ের বিচার চলছে। এ যুগে এত অনাচার। ছি, সৌদি আরব।