এখনই বিদায় নয় বন্ধু

বসফরাস আর ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থানের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক
বসফরাস আর ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থানের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক

সহনশীলতার সঙ্গে পারস্পরিক সম্মানের মিশ্রণই সম্পর্কের অভীষ্টতা নির্ধারণ করে অনেকাংশে। কোনো অংশের অনুপস্থিতি নিমেষেই গুঁড়িয়ে দেয় দীর্ঘদিনের ভরসার অভেদ্য পাটাতন। ভরসার নড়বড়ে অবস্থান, বন্ধন ভাঙায় তড়িৎ গতিতে আর ভাঙা-গড়ার এই যাত্রায় উভয় পক্ষই নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে আরও ভেঙে যায়।

সে ভাঙেনি অবিচল, নির্ভীক আর কঠোরতা তার নিত্যসঙ্গী বলে। বসফরাসের নীল পানিকে সাক্ষী মেনে আপনা রায়ে ইতি টেনেছে প্রায় অর্ধ যুগের এক নিখাদ বন্ধুত্বের উপাখ্যানকে।

আক্ষরিক অর্থে ভিনদেশের মানুষ, সংস্কৃতি আর ভাষার ভিন্নতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রহেলিকার অর্থপূর্ণ সন্ধান দিয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরের নৃবিজ্ঞান বিভাগ। ঔপনিবেশিক শাসন, ভাষার রাজনীতি, রাষ্ট্র, আধিপত্যবাদী সম্পর্কে শুনে যতই মুগ্ধ হতাম, ততই নিজের গোমূর্খতার ওপর রাগ আরও চড়া হতো।

পুরোটা না হলেও অনেকটা সত্যি, সেই রাগ থেকেই আমার প্রথম বিদেশযাত্রার মনস্থির। ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই মনস্থিরতাকে আরও বেশি বেগবান করেছিল। নতুনত্ব দেখার এই আগ্রহে আঙ্কারা ঘুরে থামি তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব শহর মারদিনে।

ছোট শহর মারদিনের গায়ে মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার অন্যতম পুরোনো শহরের তকমা, যেখানে একই ছাদের নিচে প্রায় দশের বেশি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তুর্কি, কুর্দি, আরব, সুরইয়ানিসহ আরও অনেক বিচিত্র জনগোষ্ঠীর। এই বিচিত্র জাতিগোষ্ঠী দর্শনেই মারদিনের প্রথম দিনগুলোয় ছিল ঝাটিকার বেগ। মেসোপটেমিয়া থেকে শুরু করে রোমান আর অটোমানদের নিদর্শনের দর্শন সময়কে দ্রুত থেকে দ্রুততর করেছিল।

মারদিনে মসজিদ আর গির্জার কোলাকুলি অবস্থান, কুর্দি, আরব আর তুর্কিদের মিশ্রিত বিয়ে বর্ণনাতীত ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতির গোড়াপত্তন করেছে। মোটাদাগে এই ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতির প্রধান কাণ্ড সংগীত, যা মারদিনকে দিয়েছে বহুরূপ। যে বহুরূপ যেকোনো সমাজবিজ্ঞানের উৎসাহী পাঠককে আটকে রাখতে পারে বহুদিন। মাঝেমধ্যেই নিজেকে প্রশ্ন করি, আমিও কি আগ্রহেই মারদিনে পাঁচ বছর আটকে ছিলাম, না আমি নিজেকেই মারদিনে আটকে রেখেছিলাম। দুর্বোধ প্রশ্নের উত্তর সহজ হয়।

২০১৫ সালের হেমন্ত শেষে একক পদক্ষেপে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় হয়। পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে তার ছায়ায় দেখার অভিজ্ঞতা এই পরিচয় পর্বকে সহজ করে দিয়েছিল। সেই সূত্রেই স্বল্পভাষী হিসেবে তার পরিচিতির কথা জানতাম। তবে নৃবিজ্ঞান, দর্শন আর সমকালীন বৈশ্বিক রাজনীতির দুর্দান্ত সব চিন্তার সঙ্গে তার পরিচিতি ও সেই চিন্তাকে সহজে উপস্থাপনের ব্যাপকতা আমার অজানা ছিল।

বিদেশ-রীতিতে, প্রথম পরিচয়ে পেশাদারত্বের তাগিদেই অনেক আলাপ করার সুযোগ থাকলেও ক্ষান্ত দিই ভবিষ্যতের জন্য। প্রথম আলাপের পরই তার বৈপ্লবিক ব্যক্তিত্বের টের পাওয়া দ্বিতীয়বারের সাক্ষাতের জন্য জোরাজুরি ছিল আমার মধ্যে। অনেকটা নীরবে খোঁজাখুঁজির পরও পরের কয়েক দিন তার দেখা পাওয়া যায়নি কোথাও। না চিরচেনা করিডরে, না বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোথাও।

সপ্তাহ দু-এক পর সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় ছিলাম। দূর থেকে সালাম বিনিময়ের পর জানাল, রুটিনমাফিক ঘোরাঘুরিতে নিবিষ্ট ছিল বলেই স্কুলে তার ছায়া দেখা যায়নি। আলাপের একপর্যায়ে তার চায়ের দাওয়াতে কবুল বলে পরদিন হাজির হলাম তার নান্দনিক বাড়িতে। নীরব আর গোছানো বাড়ি ছিল বইয়ে ভরপুর। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির মতো। দেয়ালে খাটানো ছিল রহস্যে ঘেরা অচেনা এক মায়াবী নারীর অবয়ব। যার মধ্যে ঘোষণা ছিল তার অনন্যার।

চায়ের দাওয়াত শেষ হলো রাতের খাবার দিয়ে। দীর্ঘ প্রায় ছয় ঘণ্টার আলাপের পুরোটাতেই জর্জরিত ছিলাম নানান প্রশ্নে। দেশভাগ, নেহরু থেকে শুরু করে জিন্নাহ, হমি ভাভা আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আলাপের মধ্য দিয়ে তাকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে কল্পনার জগৎ বিস্তৃত হতে থাকে। তার কথায় খুঁজে পেয়েছিলাম ঝুম্পা লাহিড়ীর অসীমার ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসার আবদার আর জেন অস্টিনের অনবদ্য সৃষ্টি এলিজাবেথ বেনেটের বুদ্ধিমত্তা। তার প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে আমার অপ্রতুল উত্তর, অনেকটা ব্যতিব্যস্ত করেছিল ওই দিনের মতো বিদায় বলাকে। প্রথম আলাপেই তার তাক লাগানো ব্যক্তিত্ব ও পড়াশোনার কাছে নিঃশর্ত পরাজয়। ফলাফল ০-১।

পরের বছরগুলোতে এই ফলাফল কখনো বদলায়নি। হারের পর হার। মাস কয়েকের ব্যবধানে আমাদের বন্ধুত্ব স্বাস্থ্যবান হয়ে সবার ঈর্ষার কারণ হয়। তবে আমাদের দ্বিপক্ষীয় চমৎকার বোঝাপড়া, পরের ঈর্ষায় পরাস্ত না হয়ে একে ওপরের প্রতিচ্ছায়া হয়ে ওঠে। কোনো আলোচনায় তার অনুপস্থিতির অভাব থাকত দৃশ্যমান। তাকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে কল্পনার জগৎ বিস্তৃত হতে থাকে। ২০১৫ সালের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে আমি বাংলাদেশে ফিরলেও আমাদের আলাপ-আলোচনা থামেনি। দুই দেশের সময়ের ফারাক আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরায়নি; বরং আরও বেশি মজবুত করেছে।

তার কাছ থেকেই শিখেছি কুর্দি ভাষার প্রথম লাইনগুলো। তার নিখাদ আগ্রহেই পরিচয় ঘটেছিল বিখ্যাত কুর্দি সংগীতশিল্পী আহমেত কায়া আর সিভান পেরভারের বিপ্লবী গানের সঙ্গে। পরিচয় ঘটেছে কয়েক শতাব্দীব্যাপী কুর্দিদের ইতিহাস, সংগ্রাম আর প্রতিরোধের কথা। তার কল্যাণেই সেজান আকসুর হৃদয় ভাঙানো সব গানের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে শুরু করেছিলাম। তার সঙ্গেই হেঁটে বেরিয়েছি দিয়ারবাকের, নুসায়বিন, মারদিনসহ তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বের বেশির ভাগ শহরে।

মতামতের মিল ছিল না আমাদের কোথাও। না আদর্শিক, না রাজনৈতিক। তবে দুজনকেই টানত দিয়ারবাকির শহর। অসম্ভব সুন্দর আর রোমাঞ্চকর অধ্যায়ে ভরপুর এই শহরের ইতিহাস ইস্তাম্বুল, রোম আর গ্রিসের মতোই প্রাচীন। একাকিত্বের অনুভব দূর করতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল মারদিন থেকে এক শ কিলোমিটার দূরের শহর দিয়ারবাকিরে। টাইগ্রিস নদীর মোহিত জলরাশির শব্দে অনবরত কথার খই ফোটাতাম আমরা।

আমাদের একান্ত ইচ্ছাতে সবকিছুই বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ ছিল। যার পাটাতন ছিল দুর্ভেদ্য ও সময়ে সময়ে দাম্ভিক। কখনোই পারস্পরিক ইচ্ছা, প্রকাশ্য অথবা অপ্রকাশ্য বন্ধুত্বের পাটাতনকে ভেদ করেনি বলেই মনে হয়। ভালো-খারাপ দুজন দুজনের অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। অভ্যস্ত ছিলাম দীর্ঘ আলাপে আর বিরতিহীন যাত্রায়। এক কথায় বন্ধুত্বে আকুতি ছিল সীমাহীন।

তবে গত গ্রীষ্মে মারদিন থেকে তার ইস্তাম্বুল যাত্রা বদলে দেয় পুরোনো আকুতিকে। শুরু থেকেই ইস্তাম্বুল তার অজনপ্রিয়। ইস্তাম্বুলের ক্যাচাল তার ভালো লাগে না। বড় শহর, শব্দ আর মানুষ আর মানুষ। এসব কোনো কিছুই তার পদের না। সে মারদিন ফিরতে চায়, আগ্রহ-অনাগ্রহ তোয়াক্কা না করেই। প্রথম দিকে তার উপেক্ষার ভয় ছিল, এখন আর নেই। এই অনাস্থার আগুনে ঘি ঢালে তার পুরোনো এক বন্ধু। ‘অপদার্থ’ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকেই তার পুরোনো বন্ধুর ছায়া দেখতে আমার অতীতের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন নেই, না থাকাটা এখনো যুক্তিসংগত মনে করি।

তার ‘অপদার্থ’ বন্ধুর বেখাপ্পা উপস্থিতি বিবাদকে ঝগড়ায় রূপান্তরিত করে। আবার পাঁচ বছর পর আলাপের জায়গাগুলো প্রায় সংকীর্ণ হতে থাকে। সর্বশেষ নিয়মিত মুখ দেখাদেখিতে ক্ষান্ত দিয়ে, জোড়াতালির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের আলাপ সচল রাখার পথে অগ্রসর হই আমরা। কিন্তু অনিয়মিত ওই ক্ষান্ত দেওয়া নিয়মিততে পরিণত হয় অল্পেই।

গেল সপ্তাহে, গ্রীষ্মের শেষ দিকে বাসায় না পেয়ে হাজির হলাম ইস্তাম্বুলের চিরচেনা গুলহানে পার্কের পেছনের দিকটার খোলা জায়গায়। যার এক দিকে বসফরাস আর গোল্ডেন হর্ন, অপর দিকে বসফরাস আর ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থান। মন খারাপ হলে এখানেই এসে বসে থাকা আমাদের নিয়মিত অভ্যাস ছিল।

কুশলাদির পরের বাক্যগুলো আমাদের বন্ধুত্বের ইতি টানে তার একান্ত ইচ্ছাতেই। জেদি না হওয়ার বিদ্যা শব্দহীন করেছে আমাকে অনেকবার। তাই মেনে নিয়েছিলাম নিঃশব্দে। কারণ সে সিদ্ধান্ত শুধুই জানাতে এসেছিল। আলাপ, সংলাপের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে নয়। তার স্থির ও বিবেচিত চাহনি আর ঘনীভূত শব্দগুলোর মধ্যে প্রথমবারের মতো ক্ষমতা আর জৌলুশের গন্ধ খুঁজে পেলাম। যা আমার দিকে ধেয়ে আসছে, কোনো এক অচেনা বিদেশির দিকে। সবকিছুর পরে আমাদের প্রোথিত দ্বিপক্ষীয় সম্বন্ধের বিশালতায় আমার নিজেকে ‘বিদেশি’ ভাবার কারণগুলো ভবিষ্যতে তার ভাবনার অংশ হবে কি না, জানার ইচ্ছা সর্বোপরি অনেকটা জাগ্রত।

বহুকাল আগে, কোথায় যেন পড়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘আশাই মানুষকে জীবিত রাখে’। সেই ভরসায় বিশ্বাস নিয়েই বলছি, আবার আলাপ হবে। ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হবে। আবার সারা রাত না ঘুমিয়ে বিরামহীন বাদ-প্রতিবাদ হবে মধ্যপ্রাচ্যের অসরল রাজনীতি আর পরিবর্তন নিয়ে। আলাপ হবে পাবলো নেরুদা, হান্নাহ আরেন্থ আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ভালোবাসা আর নিঃসঙ্গতা নিয়ে। তাই এখনই বিদায় নয় বন্ধু।


লেখক ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।