অনুপ্রেরণার প্রতিটি মুহূর্ত

কুইন্স বোটানিক্যাল গার্ডেনে শিক্ষার্থীরা। ছবি: লেখিকা
কুইন্স বোটানিক্যাল গার্ডেনে শিক্ষার্থীরা। ছবি: লেখিকা

নিউইয়র্ক শহরের স্কুলগুলো থেকে তাদের শিক্ষার্থীদের বছরে একাধিকবার বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাসফরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, বোটানিক্যাল গার্ডেন, মুভি থিয়েটারসহ নানান শিক্ষণীয় স্থান অন্তর্ভুক্ত থাকে।

আমার ফোর্থ গ্রেড পড়ুয়া ছেলে রিহান ও তার শিক্ষিকা মিস ওয়ারেজের অনুরোধে এবার আমাকেও তাদের সঙ্গে যেতে হয়। নির্দিষ্ট দিনে সকাল নয়টায় স্কুলের সামনে উপস্থিত থাকতে বলা হয় আমাকে। যথাসময়ে স্কুল গেটে অপেক্ষা করছিলাম। শহরময় সূর্যের উজ্জ্বল কিরণে ঝকঝক করছিল।

মিস ওয়ারেজ তাঁর ক্লাসের ২৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলের বাইরে এসে দাঁড়ান। সামনেই স্কুলবাস অপেক্ষারত ছিল। একে একে সব শিক্ষার্থী শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বাসে উঠে বসে ও প্রত্যেকেই ঝটপট সিটবেল্ট বেঁধে নেয়।

মা সঙ্গে থাকায় রিহানের বাড়তি আনন্দ। তার চোখেমুখে আনন্দ উচ্ছ্বাসের একধরনের জ্যোতি ফুটে উঠেছে। যেন আজকের দিনটি তার কিংবা সে-ই আজ বিশ্বের সেরা সুখীজন।

বাস ছুটে চলছে হাইওয়ে ধরে। শিশুদের কেউ কেউ ব্যাগ থেকে কাগজ–কলম বের করে লিখছে। কেউ ছবি আঁকছে। কেউবা বাইরের দৃশ্য দেখছে আপনমনে।

আমরা মা-ছেলে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছি। খুব বেশি দূরের পথ নয়। সহসাই বাসটি গন্তব্যে এসে থামে। কুইন্স বোটানিক্যাল গার্ডেন। শিক্ষক মিস ওয়ারেজ বিশাল এক ব্যাগে শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবার বহন করে নিয়ে আসেন সঙ্গে।

মিস অ্যান, যিনি গাইডের ভূমিকা পালন করছিলেন, তিনি সবাইকে নিয়ে একটি রেড ম্যাপলগাছের নিচে এসে দাঁড়ান। শিক্ষার্থীরা তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ঘিরে থাকে। মিস অ্যান বলেন, ‘শুভ সকাল, তোমাদের মাঝে কেউ কি আগে কখনো কুইন্স বোটানিক্যাল গার্ডেনে এসেছ?’

কুইন্স বোটানিক্যাল গার্ডেনে শিক্ষার্থীরা। ছবি: লেখিকা
কুইন্স বোটানিক্যাল গার্ডেনে শিক্ষার্থীরা। ছবি: লেখিকা

শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই একযোগে না–সূচক উত্তর দেয়। অতঃপর তিনি ম্যাপল ট্রি সম্পর্কে তাদের ধারণা দেন। অক্টোবর-নভেম্বরের এই সময়টায় গাছের পাতা কেন হলুদ-কমলা-লাল হয়ে ওঠে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন শিক্ষার্থীদের। কেউ ঝটপট উত্তর দিচ্ছে। কেউ বা জানা আর না-জানার দোলাচলে। তবে অধিকাংশই হাত তুলে জানায়, এ বিষয়ে তারা অবগত আছে। তারা পাতায় ক্লোরোফিল থাকার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে।

প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় শিশুদের চোখেমুখে আনন্দ ছিল। ছিল আবেগের আতিশয্য। মিস ওয়ারেজ সবাইকে একটি করে বাদামি রঙের কাগজের ঠোঙা দিয়ে বলেন, যেসব উদ্ভিদ সম্পর্কে আজ শিক্ষাদান করা হবে, সেসব গাছের পাতা সেখানে রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা সবাই একটি করে ম্যাপল লিফ ঠোঙায় রাখে।

আমরা বাগানের ঝরাপাতা মাড়িয়ে হেঁটে চলেছি অন্য গাছের উদ্দেশে। যেন উন্মুক্ত জ্ঞানের জগতের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। যে জগতে শুধু নতুন নতুন বিষয় জানবার আগ্রহ। দেখার আকাঙ্ক্ষা। নতুন বিষয় আবিষ্কারের উপলব্ধি। চমৎকার এক আনন্দের অনুভূতি নিয়ে শিশুরা অগ্রসর হতে থাকে সামনের দিকে।

কখনো কোনো গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে মিস অ্যান বলে চলেন, এটি ডগ উড ট্রি, এটি পাইন কোন কিংবা ট্রপিক্যাল প্ল্যান্ট। সেই সঙ্গে গাছ ও পাতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তিনি।

বাগানের ভেতরে সরু পথের বাঁকে বাঁকে নানান জাতের গাছ। সূর্যের সোনালি রোদ এসে পড়ায় গাছগুলোকে আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। শাখা প্রশাখায় হলুদ-কমলা-লাল রঙের পাতা এমনভাবে ভরে ছিল যে, তার ফাঁকফোকর গলিয়ে সূর্যের কোমল মসৃণ আলো ঠিকরে পড়ে চারপাশটা একধরনের ঝলমলে স্বর্গীয় পরিবেশ হয়ে উঠেছে।

এর চেয়েও স্বর্গীয় বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি বিষয় জানার জন্য শিশুরা মিস অ্যানের মুখের দিকে উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে ছিল। চারদিকে উৎসুক মুখ। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এক একটি প্রস্ফুটিত ফুল যেন! আমি আমার ভেতরের গভীরতা দিয়ে উপলব্ধি করলাম, এ দেশে শিক্ষার বিষয়টি ভালোবাসা আর আনন্দের সম্মিলন। শিক্ষকেরা কাউকেই শিখতে বাধ্য করেন না। তাদের সার্বক্ষণিক স্নেহময় কৌশলে শিক্ষা দিয়ে যান কেবল।

পায়ের নিচে ঝরাপাতার মর্মর ধ্বনি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ক্রমেই বাগানের ভেতরের দিকে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করছিল। তখন স্থির দাঁড়িয়ে থাকা রং–বেরঙের পাতাবিশিষ্ট গাছগুলোর ডালপালা নত হয়ে আসে। বাগানজুড়ে হেমন্তের উপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

লেখিকা
লেখিকা

বাগানের ভেতরে এখানে–ওখানে আরও অনেক শিক্ষার্থীকে মুখর হতে দেখা যায়। যারা তাদের নিজ নিজ স্কুল থেকে সেখানে গিয়েছে স্কুল ট্রিপে। চারপাশটা দেখে সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল যেন গাছ, সূর্যের কিরণ, শীতের হিমেল বাতাস আর এসব শিশু পরস্পরের নিবিড় বন্ধু।

সূর্য একটু একটু করে ওপরে উঠতে লাগল। আমরা হাঁটছি দল বেঁধে। কোথাও ঘনবৃক্ষ, কোথাও বা পার্পল কোন ফ্লাওয়ার। কোথাও মৌমাছির ঘর (Bee Garden) বানিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে ওখানে কিছু বসার বেঞ্চি। যেন এ পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ক্লান্ত পথিক জিরিয়ে নিতে পারে ক্ষণিক। গাছপালা ঘেরা বাগানটি যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য পর্যাপ্ত। এটি এমন এক চমৎকার রঙিন পরিবেশ, যেখানে নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায় স্বেচ্ছায়।

বাগানের ভেতরের এডুকেশন বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। বিশাল গোলটেবিল আর চেয়ারে পরিবেষ্টিত রুমটি অনেকটা কনফারেন্স রুমের মতো। সেখানে চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এসব শিক্ষার্থী আসন গ্রহণ করে। তাদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হয়। অতঃপর কাগজের ঠোঙায় করে সংগ্রহ করে আনা নানান প্রজাতির গাছের পাতা শিক্ষার্থীরা একটি সাদা কাগজের ওপর সাজিয়ে আঠা দিয়ে আটকে প্রতিটির নাম লিখে মিস ওয়ারিজের কাছে জমা দেয়।

এবার ফেরার পালা। শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে খুদে শিক্ষার্থীরা হলুদ বাসে উঠে বসে। সিটবেল্ট বাঁধে। বাস হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে স্কুলের উদ্দেশে। আমি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে জানালায় বাইরে তাকিয়ে ভাবছি, এ দেশে একজন শিক্ষক কেমন করে ছাত্রদের জ্ঞানের দুয়ার উন্মোচন করে দেন তা স্বচক্ষে দেখার চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে। এ দেশে স্কুলের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত অনুপ্রেরণার। শেখার ও আনন্দের। শিক্ষকেরা সহানুভূতির সঙ্গে নিরলস প্রচেষ্টায় তাঁদের ভূমিকা এমনভাবে পালন করে থাকেন যেন শিক্ষার্থীরা প্রতিটি বিষয়ের ভেতরেই সৌন্দর্য দেখতে পায়।