জাপানের পোর্ট অব হিউম্যানিটি

পোর্ট অব হিউম্যানিটির ৎসুরুগা মিউজিয়ামের প্রবেশপথ। ছবি: লেখক
পোর্ট অব হিউম্যানিটির ৎসুরুগা মিউজিয়ামের প্রবেশপথ। ছবি: লেখক

জার্মান নাৎসি বাহিনী কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রান্ত। নাৎসি আক্রমণ থেকে বাঁচতে পলায়নপর পোল্যান্ডবাসী ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, কোথায় গেলে একটু নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যাবে। এ ঘটনা ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের।

নাৎসি বাহিনীর একটাই লক্ষ্য, ইহুদিদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা। এদিকে ইউরোপের সীমান্তে কড়াকড়ি। ফলে ইহুদিদের পালানোর পথ বন্ধ। বাঁচার জন্য নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছার একটাই পথ, সেটা হলো সাইবেরিয়া হয়ে জাপান। আর সেখানে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ।

পোল্যান্ডের ইহুদিরা বাঁচার জন্য নিরপেক্ষ লিথুয়ানিয়ায় পালিয়ে যায়। কিন্তু সোভিয়েত বাহিনী লিথুয়ানিয়ার ওপর জোর খাটায় ও শরণার্থীদের লিথুয়ানিয়ায় থাকতে বাধা দেয়। এতে ইহুদিরা সাইবেরিয়ায় নির্বাসনের মুখোমুখি হয়।

এ অবস্থায় লিথুয়ানিয়ায় থাকতে না পেরে অনেক ইহুদি কাউনাসের জাপানের কনস্যুলেটে দেশটির ট্রানজিট ভিসার জন্য আবেদন করেন।

কাউনাসে ১৯৪০ সালের শুরুর দিকে জাপান কনস্যুলেটের কনসাল এজেন্ট ছিলেন সুগিহারা। তিনি শরণার্থী ইহুদিদের পক্ষ থেকে পাঁচজনকে ডাকেন ও তাঁদের কথা শোনেন। কথা বলে তিনি বুঝতে পারেন যে শরণার্থীরা জাপানের ট্রানজিট ভিসা পেতে ইচ্ছুক।

সুগিহারা নিয়ম অনুযায়ী কয়েকজনকে ভিসা দিতে পারেন। কিন্তু এত মানুষকে একসঙ্গে ভিসা দিতে হলে সরকারের অনুমতি প্রয়োজন। তাই তিনি সরকারের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু জাপান সরকার তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।

তসুরুগা পোর্টে লেখক ও তাঁর ছেলে আরফান আহমেদ
তসুরুগা পোর্টে লেখক ও তাঁর ছেলে আরফান আহমেদ

এ অবস্থায় পরিস্থিতি ও মানবিক বিবেচনায় জাপান সরকারের ভিসা না দেওয়া–সংক্রান্ত আদেশ অমান্য করে সুগিহারা শরণার্থীদের ভিসা দেওয়া শুরু করেন। এর মাধ্যমে তিনি মানবিক দৃষ্টান্তের এক ইতিহাস হয়ে যান। আর যে বন্দর দিয়ে ইহুদিরা জাপানে প্রবেশ করে সেই ফুকুই প্রিফেকচারের তসুরুগা সমুদ্রবন্দরটি হয়ে গেল ‘পোর্ট অব হিউম্যানিটি’।

মানচিত্রে জাপানের ৎসুরুগা সমুদ্রবন্দরের অবস্থান
মানচিত্রে জাপানের ৎসুরুগা সমুদ্রবন্দরের অবস্থান

একসময় জাপান থেকে রাশিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার এবং একইভাবে ইউরোপ থেকে জাপানে আসার একমাত্র সমুদ্রবন্দর ছিল তসুরুগা বন্দর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কালের পরিক্রমায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার যোগাযোগব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। এখন আকাশপথ অনেকে সহজ ও কম সময়সাপেক্ষ।

পরবর্তী সময়ে বন্ধ হয়ে যায় তসুরুগা বন্দর বা পোর্ট অব হিউম্যানিটি। পরে এই বন্দরকে আধুনিকায়ন করে তৈরি করা হয় পোর্ট অব হিউম্যানিটি জাদুঘর। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে পোর্ট অব হিউম্যানিটি জাদুঘর প্রত্যেক দর্শনার্থীকে মনে করিয়ে দেয় সেই সব দিনের কথামালা; যা সবকিছুকে ছাড়িয়ে মানবতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে।