ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি: বরফের পাহাড় আল্পস-১

সেমনিতে সপরিবার লেখক। ছবি: লেখকের অনুরোধে একজন পর্যটকের তোলা
সেমনিতে সপরিবার লেখক। ছবি: লেখকের অনুরোধে একজন পর্যটকের তোলা

অনেক দিন থেকেই আল্পস পর্বত ঘুরে দেখার ইচ্ছা। দেশে দুই-তিন সপ্তাহের ছুটি চোখের পলকে শেষ করে ইংল্যান্ড ফেরার পথে বিমানের জানালা দিয়ে নিচে বিশাল বরফের পাহাড় আল্পস চোখে পড়ে। বিমান অবতরণ করতে তখনো হয়তো ঘণ্টা দুই বাকি।

শুভ্র তুষারের এই গতিহীন সৌন্দর্য দেশ থেকে আনা মন খারাপের ঝুড়ির যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করে। এই অপার মায়াবী পাহাড়ের নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করার উপায় নেই। বলি, আমি আসছি, খুব শিগগির আসছি।

তারপর আবার নাগরিক ব্যস্ততা। মাস ঘুরে বছর হয়ে যায়। আবার হয়তো দুই সপ্তাহের ছুটি জোগাড় হয়। আমার বাঙালি মন বাংলাদেশ পানে ছুট দেয়। ফিরতি বিমানের জানালা দিয়ে আল্পস আবার নিমন্ত্রণ জানায়। আমি আবার বলি, আসছি, খুব শিগগির আসছি।

ইংল্যান্ডে বছরে দু-তিনবার তুষারপাত হয়। তা যত না উপভোগের, তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণার। উইকএন্ড হলে একটা উৎসব উৎসব ভাব থাকে। সবাই দল বেঁধে রাস্তা বা পার্কে যায়। স্লেজ দিয়ে খেলা করে। স্নো বল ফাইট হয়। সেলফি, ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম আপডেট তো আছেই।

কিন্তু প্রকৃতি তো মানুষের বানানো ক্যালেন্ডার মেনে চলে না। অফিসে যাওয়ার জন্য সকালে উঠে দেখলেন রাতের তুষারপাতে সব সাদা হয়ে আছে। রাস্তায় কয়েক ইঞ্চি বরফের আস্তরণ। গাড়ির ওপরের বরফ পরিষ্কার, ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার করে তারপর রওনা হলেন অফিসে। তারপর রাস্তায় জমে থাকা বরফ ব্ল্যাক আইসে দুর্ঘটনার ভয় তো আছেই।

তাই নিজের আঙিনায় তুষারপাতের চেয়ে দূর পাহাড়ের শুভ্র তুষার ঢের বেশি উপভোগ্য। আসলে তুষারপাত হোক, বৃষ্টি বা নদীর সৌন্দর্য, কোনোটাই আমরা বেশি চাই না। বরফঢাকা শহর, অতিরিক্ত বৃষ্টি যখন নদীর দুই কূল ছাপিয়ে বন্যায় প্লাবিত করে চারদিক, তখন তা বিড়ম্বনাই।

আল্পস উচ্চতায় হিমালয়ের প্রায় অর্ধেক, ৪ হাজার ৮০০ মিটার। পাঁচ-ছয়টি দেশ থেকে আল্পসে ওঠা যায়। সুইস আল্পস, ফ্রেঞ্চ আল্পস, ইতালিয়ান আল্পস, অস্ট্রিয়ান আল্পস ও জার্মান আল্পস।

সেমনিতে লেকের পাশে সপরিবার লেখক। ছবি: লেখকের অনুরোধে একজন পর্যটকের তোলা
সেমনিতে লেকের পাশে সপরিবার লেখক। ছবি: লেখকের অনুরোধে একজন পর্যটকের তোলা

সব বেজ (ফুট অব আল্পস) থেকেই কেব্‌ল কার আর মাউন্টেন রেলের কল্যাণে পিকে পৌঁছাতে মুসা ইব্রাহীম বা ওয়াসফিয়া নাজরীনের মতো পর্বতারোহী হতে হয় না। মাত্র এক ঘণ্টায় পাহাড়চূড়ার বরফের রাজ্যে পৌঁছানো যায়। নিচে সমতলে তখন হয়তো রোদ বা বৃষ্টি হচ্ছে।

ইংল্যান্ডে প্রতি ছয় সপ্তাহ স্কুলের পর এক সপ্তাহের হাফ টার্ম ছুটি থাকে। অক্টোবর হাফ টার্মে আমরা তাই বেরিয়ে পড়লাম আলপাইন রোড ট্রিপে। সঙ্গে বউ আর দুই কন্যা ইসরা ও ইনায়দা। গন্তব্য দক্ষিণ ফ্রান্সের সেমনি। আল্পসের সর্বোচ্চ চূড়া মন্ট ব্লং।

আল্পসে ট্রিপের জন্য সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মোটামুটি ভালো সময়। ভিড় থাকার কথা না। তবে স্কিইয়ের সিজন শেষ হয়ে গেছে। আমরা থাকি দক্ষিণ ইংল্যান্ডের কেন্টে। ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম ফোকস্টোনে। সেখান থেকে ইংলিশ চ্যানেলের নিচ দিয়ে ইউরো টানেলে করে ৩৫ মিনিটে ফ্রান্সের ক্যালে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ফ্রি মুভমেন্ট অব পিপল অ্যান্ড গুডস। ক্রসিংয়ে গাড়ি থেকেও নামতে হয় না। কাচ নামিয়ে পাসপোর্ট দিলেই হলো। বিমানবন্দরে যেখানে জুতা, বেল্ট খুলেও রক্ষা পাওয়া যায় না, ভুলে একটা লিকুইড বোতল রেখে দিলেই সুই খোঁজার মতো তল্লাশি।

তবে এই ফ্রি মুভমেন্ট নিয়ে আমার এক বন্ধুর দারুণ অভিজ্ঞতা আছে। সে নেপালি ব্রিটিশ। স্কটল্যান্ডে তার বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা। স্কটিশ একসেন্টে কথা বলে। স্পেনে বেড়াতে গিয়ে যখন বিচে হাঁটছিল, তখন পুলিশ ওকে আটকায়। পাসপোর্ট দেখতে চায়। সে যতই বোঝাতে চায় পাসপোর্ট ওর হোটেলে, মানিব্যাগ থেকে ওর ইউকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখানোর পর ওদের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।

ইউকে লাইসেন্সে জন্মস্থান লেখা থাকে। তার জন্মস্থান নেপাল দেখার পর ওরা পাসপোর্ট না দেখে তাকে ছাড়বে না। তার স্কটিশ ইংলিশ শুনে পুলিশ বলছিল তুমি ছোটবেলা থেকে ইউকেতে থাকলে ইংলিশে ভালো না কেন?

সেমনিতে আমেরিকান পর্যটকের সঙ্গে সপরিবার লেখক। ছবি: লেখকের অনুরোধে একজন পর্যটকের তোলা
সেমনিতে আমেরিকান পর্যটকের সঙ্গে সপরিবার লেখক। ছবি: লেখকের অনুরোধে একজন পর্যটকের তোলা

এ কথা শোনার পর আমার বন্ধুটি বাক্যহারা। মনে করল পুলিশের গাড়িতে করে ওকে হোটেলে নিয়ে গেলে পাসপোর্ট দেখিয়ে পাঁচ মিনিটে মামলা ডিসমিস। ওকে অবাক করে দিয়ে স্প্যানিশ পুলিশ বলল, তুমি হোটেলের দিকে হাঁটা শুরু করো। আমি সাইকেলে তোমাকে ফলো করছি।

আমার বন্ধু অবাক বিস্ময়ে বলেছিল, তোমাদের কি গাড়ি দেয় না? আমি ট্যাক্সি নিই? ট্যাক্সি নিলে পুলিশ ফলো করতে পারবে না। তাই তা করা যাবে না! হোটেলের সামনে যাওয়ার পর পুলিশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছে, তুমি এই হোটেলে উঠেছ? হোটেলের কার্ড দেখালে না কেন? হোটেলের কার্ড যে আইডি হয়, তা ওই বন্ধুর মতো আমার মাথায়ও আসে না। এরপর থেকে আমাদের বন্ধুদের ব্রেক্সিটবিষয়ক আলোচনায় ফ্রিডম অব মুভমেন্ট কখনো মুখে আনা যায় না। বন্ধুটি ওর রেকর্ড শুরু করে।

ক্যালে থেকে সেমনি ৯ ঘণ্টার ড্রাইভ। হাইওয়েকে ফ্রান্সে বলে অটো রুট, গুগলে দেখেছিলাম আমাদের নিতে হবে এ২৬, তারপর এ৪০। যা সেমনি হয়ে তুরিন, ইতালি গেছে। এ৪০-এর আরেক নাম অটো রুট ব্লং। ফ্রেঞ্চ শব্দ ব্লং মানে সাদা। এই রুট সাদা বরফের পাহাড় আল্পসে নিয়ে যায় বলে এর নাম অটো রুট ব্লং। (চলবে)