তর্জনী

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

আমি ডেট্রয়েট শহরের যেখানে থাকি, সেখানে রাস্তার উল্টো দিকেই একটা পানশালা। ওখানে দুপুরের দিকে থাকে বয়স্ক মানুষের আনাগোনা। বিকেল থেকে তরুণ–তরুণীদের।

একদিন কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে শীতের এক ভরসন্ধ্যায় সেই পানশালার সামনে অস্পষ্ট এক দৃশ্য দেখে আমি হতবাক। সেই দৃশ্যটি আরেকবার দেখার আশায় আমি মাঝে মাঝে ওই পানশালায় যাই।

ওখানে পানীয় পানের সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ খেলাধুলা করে। কেউ টিভিতে বেজ বল, ঘোড়দৌড় বা কার রেস দেখে। কিন্তু জেসিকা এর ব্যতিক্রম। জেসিকা সন্ধ্যায় কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে বারে এসে একটা ড্রিংকসের অর্ডার দিয়ে একেবার কোনায় গিয়ে বসে। গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে কী সব লেখালেখি করে।

আমি নিজ থেকেই একদিন জেসিকার সঙ্গে আলাপ জমাতে চেষ্টা করি। জেসিকা আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?’

আমি হ্যাঁ বা না কিছুই বলি না।

জেসিকা বলে, ‘আই থিংক ইউ আর ফ্রম বেংলাদেশ।’

আমি বলি, ঠিকই তাহলে ধরতে পেরেছ।

জেসিকা বলে, এ এলাকায় অনেক বাঙালি থাকেন। দুই–একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তা ছাড়া আমার দাদু তোমাদের ওখানে ছিলেন দীর্ঘদিন। তাঁর কাছ থেকে জেনেছি, ১৯৭০ সালে সামুদ্রিক ঝড়ে তোমাদের ওখানে অনেক লোক মারা গেছে। তারপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা, বাঙালির আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা আজও তিনি বলেন।

একপর্যায়ে জেসিকা আমায় জিজ্ঞেস করে, তোমাদের আর্সেনিক সমস্যার কি সমাধান হয়েছে? নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি সবকিছুই যেন তার নখদর্পণে।

আমি জেসিকাকে জিজ্ঞেস করি তুমি বাংলাদেশ সম্বন্ধে এত খবর রাখ?

জেসিকা বলে, আমি একটা পত্রিকায় কাজ করি, তাই খোঁজতো রাখতেই হয়।

প্রায়ই জেসিকার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমরা হাই–হ্যালো বলি।

জেসিকার সঙ্গে পরিচয়ের পর কেটে গেছে কয়েক মাস। একদিন রাতে টিভিতে স্থানীয় নিউজ দেখছি। হঠাৎ চোখটা টিভি স্ক্রিনে আটকে গেল। খুব পরিচিত মুখ। চেনাচেনা লাগছে। জেসিকা! নামটাও পরিচিত। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

নিউজ কাস্টার বলে যাচ্ছেন, জেসিকা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ছিলেন। বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি করে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। ইনডেক্স ফিঙ্গার নামে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মের কাজ ছিল প্রায় শেষ পর্যায়ে...।

খবরটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবি, জেসিকা তো আমার কেউ না। তবে কেন তার জন্য মনটা কাঁদে। দিন যায়, মাস যায়। আমি মাঝে মাঝে সেই পানশালায় যাই। একেবারের কোনার চেয়ারটায় কেউ আর বসে না। যেখানটায় জেসিকা বসতেন।।

একদিন স্থানীয় একটি পত্রিকায় হঠাৎ চোখ পড়ল। জেসিকার অসমাপ্ত ডকুমেন্টারি ফিল্মটা তার বয়ফ্রেন্ড শেষ করেছেন এবং আগামী রোববার স্থানীয় একটি থিয়েটার হলে ছবিটি প্রদর্শিত হবে।

বন্ধু বিজয় ধর ও মিলটন হাসানকে নিয়ে আমি ছবিটি দেখতে গেলাম। শুরুতেই সারা পর্দা জুড়ে বিশাল একটি তর্জনী। সঙ্গে খুব পরিচিত আবহ সংগীত। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১, ১৯৭২, ১৯৭৫...২০১৫। ৫২ মিনিটের ফিল্মে বাঙালির আন্দোলন, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, চাওয়া পাওয়া, স্বপ্নভঙ্গের বাস্তব চিত্র কত নিখুঁতভাবে যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা ছবিটা না দেখলে বোঝা যাবে না।

ছবি শেষে তিনজন যখন হল থেকে বের হলাম, আমরা সবাই নির্বাক। একজন অবাঙালি হয়ে জেসিকা যা করলেন তাতে সত্যি আমি অভিভূত। মনে মনে বলি, ছবিটা আমাদের সবার দেখা উচিত। আমার চোখে ভেসে ওঠে পানশালায় গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে জেসিকা ডুবে যেতেন বাংলা আর বাঙালিত্বে। প্রণামি তোমায় জেসিকা।