বেড়ানো: টুকলির টুকিটাকি

লেকে বোটে বিশ্রাম। ছবি: ফারাহ আযিম
লেকে বোটে বিশ্রাম। ছবি: ফারাহ আযিম

প্রতিবারের মতো এবারও আমাদের গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা। বেশ অনেক দিন থেকেই কোথায় যাওয়া যায়, কোথায় থাকা যায় তার হিসাব–নিকাশ চলছিল।

সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে: ‘পরিকল্পনা কর্মের আধা’। তার মানে ঠিক পরিকল্পনা করতে পারলে অর্ধেক কাজ সমাধা।

চারপাশে গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে শুনলাম আমাদের বাসার কাছে কোনো এক স্থানে নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গরম পড়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় এমনিতেই শীতকাল তেমন ভোগায় না, যতটা ভোগায় গরমকাল।

টুকলি সিডনি থেকে ১০৭ কিলোমিটার দূরে। প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। সেন্ট্রাল কোস্টের ছোট একটা শহর। ১৮৮০ সালের দিকে টুকলির সঙ্গে সিডনি শহরের যোগাযোগ স্থাপন হয়। টুকলি নামকরণটাও বেশ মজার। এর আসল নাম টুকলি অক্লি। যার অর্থ মসৃণ এক পাশ, আর অন্য পাশ রুক্ষ।

টুকলিতে থাকার জন্য ভাড়া বাড়ি। ছবি: লেখক
টুকলিতে থাকার জন্য ভাড়া বাড়ি। ছবি: লেখক

টুকলির এক পাশে টাগারাহ (Tuggera) লেক। অন্য পাশে Budgewoi লেক। টাগারা লেক বিখ্যাত তার মসৃণ সৌন্দর্য আর স্নিগ্ধ মিষ্টিপানির জন্য। অন্য পাশে বাদগিঅই লেক বেশ রুক্ষ, ঘোলা পানি আর শেওলাভরা তলদেশ।

সাধারণত ক্রিসমাসের সময়ে কোথাও থাকার জায়গা পাওয়া বেশ দুষ্কর। তারপরও কীভাবে যেন টুকলিতে থাকার একটা জায়গা পেয়ে গেলাম। যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হলে এয়ার বিএনবিতে থাকার জায়গা ঠিক হলো।

পৌঁছে চমকের পালা। এই সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনার অতীত। বাসার পেছনে খোলা লেক আর সবুজ ঘাসে ভরা লন। লেকে ছোট ছোট নৌকা আর লেকের সবুজ পানি চোখে পড়ে যত দূর চোখ যায়। এলাকাজুড়ে শৈবালের গন্ধ। ঠিক উৎকট বলা যাবে না। বরং কেমন যেন মন ভালো করা নেশা ধরানো গন্ধ।

লেকে সূর্যাস্ত। ছবি: ফারাহ আযিম
লেকে সূর্যাস্ত। ছবি: ফারাহ আযিম

বাসায় পৌঁছে মনে হলো এখানে যদি থেকে যেতে পারতাম! খাবারদাবার সঙ্গেই ছিল। বারান্দায় চেয়ার–টেবিল পাতা রয়েছে। ঝটপট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম লেকে মাছ ধরতে। স্নিগ্ধ বাতাস চারপাশে ক্লান্তি যেন কোথায় উবে গেল।

লেকে সূর্যাস্ত। ছবি: ফারাহ আযিম
লেকে সূর্যাস্ত। ছবি: ফারাহ আযিম

সন্ধ্যার সময় লেক থেকে উঠে এলাম কিছু মাছ নিয়ে। মাছে–ভাতে বাঙালি আর সেই বাঙালিপনা থেকে আমাদের টাটকা মাছ দিয়ে সারা হলো সান্ধ্যভোজ। আমার আর আমার ছোট বোনের বাচ্চারা মিলে ঘাসে ভরা লনে খেলায় মেতে উঠেছে।

ঘরের চেয়ে বাইরে থাকতেই যেন সবাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। হিমেল বসে গেছে তার গিটার নিয়ে আর ফারাবি তার বেসুরো গলায় তাল দিচ্ছে। চারপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক। দূরে আধো অন্ধকারে লেকের অবয়ব। স্নিগ্ধ মিষ্টি বাতাস যেন এক অপার্থিব সৌন্দর্যের চাদরে চারপাশ ঢেকে রেখেছে।

অনেক রাত পর্যন্ত চলল আমাদের আড্ডা আর গান–বাজনা। কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করতে গেল আর আমরা লন পেরিয়ে লেকের পাশে গিয়ে বসলাম। অন্ধকার আকাশে একটু পর অদ্ভুত একটা কিছু দেখে ফারা চেঁচিয়ে উঠল। আমাদেরও চোখ ততক্ষণে সেই দিকে।

লেকে সূর্যাস্ত। ছবি: ফারাহ আযিম
লেকে সূর্যাস্ত। ছবি: ফারাহ আযিম

আমি আমার পুরো জীবনে এ রকম অদ্ভুত কিছু দেখিনি। একটা আলো অনেকটা বিমানের মতো আকার, বিমানের মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে আর একটু পরপর আলো বন্ধ করে দিচ্ছে। আমরা নিশ্চিত এটা কোনো সার্চলাইট, বিমান বা কোনো আকাশ যান নয়। পরদিন পত্রিকায় দেখেছিলাম মেলবোর্নের আকাশেও নাকি এ রকম কিছু দেখা গিয়েছিল। ভূতপ্রেতে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু সেই আলোর কোনো যুক্তিযুক্ত বর্ণনাও খুঁজে পাইনি।

পরদিন আমাদের যাত্রা নেলসন বেতে। ডলফিন আর নীল পানির এক স্বপ্নিল শহর। অন্য একসময় সে কথা লেখা যাবে। আমরা ফিরে এলাম ক্লান্ত হয়ে। আরও একটা স্বপ্নিল সন্ধ্যা কাটালাম টুকলিতে। উপভোগ করলাম লেকের পানিতে সূর্যের লাল আলো ছড়াতে ছড়াতে হারিয়ে যাওয়ার মন ভোলানো দৃশ্য।

সন্ধ্যায় গেলাম মাছ ধরার মেলায়। ওখানে দেখলাম কাঁকড়া। এত বড় কাঁকড়া আমি বোধ হয় আর কখনো দেখিনি। অনেক বড় কাঁকড়া ধরা পড়তে দেখলাম ওই রাতে। আমরাও কম যাই না। একটা ফ্লাট হেড ধরে ফিরে এলাম।

ব্যালকনি ভিউ। ছবি: লেখক
ব্যালকনি ভিউ। ছবি: লেখক

পরদিন ফিরে আসার পালা। সকাল থেকেই দেখলাম সবার মুখ ভার। মনের অবস্থা আমারও যে বিশেষ ভালো, তা নয়। কিন্তু বিধি বাম। চিরচেনা ব্যস্ত জীবনে ফিরতেই হবে। এই সুন্দর সময়গুলো ছিল বলেই হয়তো ব্যস্ত জীবন এগিয়ে নেওয়ার একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।