ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি: বরফের পাহাড় আল্পস-২

লেক অ্যানেসি। ছবি: লেখক
লেক অ্যানেসি। ছবি: লেখক

ফ্রান্সসহ ইউরোপের প্রায় সব দেশে রাস্তার ডান দিকে গাড়ি চালাতে হয়। নেভিগেশন সিস্টেমের কল্যাণে ম্যাপ দেখে এখন আর রাস্তা খুঁজতে হয় না। ক্যালে থেকে সেমনির পথ ধরার আগেই নেভিগেশন সিস্টেমে ইউনিট মাইল থেকে কিলোমিটার করে নিলাম। কারণ, ফ্রান্সে মাইলের বদলে কিলোমিটারের হিসাব।

সেমনিতে এয়ার বিএনবি থেকে রেন্ট করা অ্যাপার্টমেন্ট ঠিকানা দিতেই ৯৫৫ কিলোমিটার দূরত্ব দেখাল। আর যেতে লাগবে ৯ ঘণ্টা। আমার সহধর্মিণী ইংল্যান্ডের ৫০ মাইল ড্রাইভ করে তার দায়িত্ব শেষ করেছে। এখন বাকি পথ আমার ড্রাইভ করতে হবে।

ফ্রান্সের হাইওয়েতে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা ১৩০ কিলোমিটার বা ৮০ মাইল। হাইওয়ে ড্রাইভিং সব দেশে একই রকম। শহরের ভেতরের রাস্তায় বিশেষ করে রাউন্ড অ্যাবাউটে সতর্ক থাকতে হয়। কারণ রাস্তার বাঁ দিক খালি থাকলেই রাউন্ড অ্যাবাউটে ওঠা যায়। সেখানে ইংল্যান্ডে ডান দিক খালি থাকলে ওঠা যায়।

আমার এক কলিগ বলেছিলেন, এটা মনে রাখার উপায় হচ্ছে ফ্রান্সের রাউন্ড অ্যাবাউটে ওঠার আগে বাঁয়ে বসা ওয়াইফের দিকে একবার তাকাতে হবে! তাহলে আর ভুল হবে না।

ক্যালে থেকে অল্প কিছুক্ষণ ড্রাইভ করার পরই টোল রোডের শুরু। ফ্রান্সের অধিকাংশ অটো রুটেই টোল দিতে হয়। কাছের দূরত্বে যাওয়ার জন্য কেউ অটো রুট ব্যবহার না করায় রাস্তায় ট্রাফিক কম হয়। আমাদের কোনো তাড়া নেই। দু–তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করেই একবার করে সার্ভিসে থামি।

এয়ার বিএনবিতে বুকিং দেওয়া আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের হোস্ট নাটালি ও স্টেফান। ওদের জানিয়ে রাখলাম আমাদের পৌঁছাতে সন্ধ্যা ৬টা হতে পারে।

আল্পসের বাড়িগুলো প্রায় একই প্যাটার্নের হয়। তা সুইস, ফ্রেঞ্চ বা অস্ট্রিয়ান আল্পস হোক। বাড়িগুলো কাঠের তৈরি। সঙ্গে ঢালু ছাদ। এগুলোকে স্যালে (chalet) বলে। ওদের স্যালের এক দিকে এক্সটেনশন করে দুই বেডরুমের ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপার্টমেন্ট। যা ওরা এয়ার বিএনবিতে ট্যুরিস্টদের ভাড়া দেয়।

ব্যাক গার্ডেন থেকে মাউন্টেন ভিউ আর আগের অতিথিদের ভালো রিভিউ পড়ে বুকিং দিতে দেরি করিনি। দুই সপ্তাহ আগে বুকিং দেওয়ার পর থেকেই ওরা খোঁজ নিচ্ছিল আমাদের ট্রাভেল প্ল্যানের। আমরা কখন পৌঁছাব। বেশি রাত হলেও সমস্যা নেই। তারা চাবি কি সেফে রেখে দেবে। যার কোড আগেই দিয়ে রেখেছে।

লেক অ্যানেসি। ছবি: খালেদা সুলতানা
লেক অ্যানেসি। ছবি: খালেদা সুলতানা

আল্পসে ড্রাইভিংয়ে গাড়িতে স্নো চেইন রাখতে হয়। তুষারে গাড়ি আটকে গেলে পুলিশ ঠিকই উদ্ধার করে। তবে সঙ্গে জরিমানাও গুনতে হয়। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। অনলাইনে যদি স্নো চেইন কিনিও, কীভাবে টায়ারে ফিক্স করে তা তো জানি না! নাটালি ও স্টেফানকে জিজ্ঞেস করতেই জানাল যে এখন স্নো হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যদি হয়, তবে তাদের দুটি গাড়ির একটা আমরা নিতে পারব। মনে হচ্ছে যেন আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। রীতিমতো ধারদেনা করা শুরু করে ফেলেছি!

সকালে উঠে জানালা খুলতেই মেঘের আড়ালে আল্পসের দেখা মিলল। গতকাল আমার আয়েশি ড্রাইভিংয়ের কারণে সেমনিতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা হয়ে গিয়েছিল। আর আমার কী দোষ, আল্পস যত কাছে আসছিল, পাহাড়ের ঢালে বানানো রাস্তা বেয়ে উঠতে গিয়ে দূরের পাহাড়ের সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না।

পাহাড়ে সন্ধ্যা খুব দ্রুত নামে। রাতে আর তাই সেমনি থেকে মন্ট ব্লংয়ের দেখা মেলেনি। দিনের আলোতে পেটিও ডোর দিয়ে দূরের পাহাড় উঁকি দিচ্ছে। মেঘ দ্রুতই ভেসে চলছে, একটু ফাঁকা হলে দূর পাহাড়ের চূড়া স্পষ্ট হয়। তখন আবার আরেক মেঘের ভেলা এই লুকোচুরি খেলায় যোগ দেয়।

এগি ডি মিডি (Aiguille du Midi) আল্পসের সর্বোচ্চ চূড়া মন্ট ব্লংয়ে ওঠার কেব্‌ল কার। নাশতা করেই আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম। আবহাওয়া খুব খারাপ থাকলে কেব্‌ল কার বন্ধ থাকে। গাড়ি টাউন সেন্টার কার পার্কে রেখে হাঁটা শুরু করতেই কেব্‌ল কারকে পাহাড়ে উঠতে দেখলাম। দুই দিনের মন্ট ব্লং ফ্যামিলি পাস কিনলাম। এই মন্ট ব্লং পাস দিয়ে শুধু কেব্‌ল কারই নয়, মন্ট ব্লং ট্রামসহ বাস ও ট্রামে আনলিমিটেড চড়া যায়।

লেক অ্যানেসি। ছবি: খালেদা সুলতানা
লেক অ্যানেসি। ছবি: খালেদা সুলতানা

দুটি কেব্‌ল কার বদলে চূড়ায় পৌঁছে দেখি তুলার মতো নরম তুষার পড়ছে। সঙ্গে কনকনে হিমেল হাওয়া। এই পাহাড়ের সঙ্গেই পাথরের আরেক পাহাড়, সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে ৪০০ স্টেপ উঠলেই পাহাড়চূড়া। তুষারে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সবাই পাহাড়চূড়ার রেস্টুরেন্টে খেতে বসলাম। কাচের দেয়াল দিয়ে বাইরে তখনো শব্দহীন তুষারপাত চলছে। মেয়েরা আর ঠান্ডায় বাইরে বেরোবে না। আমরা তাই এক এক করে বাইরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।

সুইজারল্যান্ডের মাউন্ট টিটলিস, সুইস আল্পসের আরেক চূড়া। তিন বছর আগে সেখানে ১০ হাজার ফুট উঁচুতে উঠে এক ফটো স্টুডিও পেয়ে সুইস ট্র্যাডিশনাল ড্রেস পরে আমাদের চারজনের এক ফ্যামিলি পোর্ট্রেট করিয়েছিলাম। পেছনে মাউন্ট টিটলিস। মন্ট ব্লংয়ে এ রকম কিছু খুঁজে পেলাম না। ওই ছবির একটা সিকিউল আর করা হলো না।

ফেরার কেব্‌ল কার ধরার জন্য যখন অপেক্ষা করছি, তখন কথা হলো দুই আমেরিকান ট্যুরিস্টের সঙ্গে। ষাটোর্ধ্ব দুই বান্ধবী আল্পস ভ্রমণে বেরিয়েছেন। থাকেন সিয়াটলে। বড় মেয়ে ইসরা তো খুবই খুশি। কারণ, সিয়াটলের অনেকের ইউটিউব চ্যানেল ও দেখে। ওদের সঙ্গে গল্প করতে করতে কেব্‌ল কার দিয়ে নিচে ফেরা শুরু করলাম। (চলবে)