ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি: বরফের পাহাড় আল্পস-৩

সেমনি শহর। ছবি: লেখক
সেমনি শহর। ছবি: লেখক

কেব্‌ল কার নামতেই একদম মুষলধারে বৃষ্টি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখলাম না, তখন আমরা ছাতার খোঁজে টাউন সেন্টারের দিকে রওনা হলাম।

দুই দিন ধরে ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টে ঘাসভুস আর ক্রিপ খেয়ে আছি। এখানে হালাল রেস্টুরেন্ট যে থাকতে পারে, তা কল্পনাও করিনি। এ জন্য গুগলে সার্চ করিনি।

একটু হাঁটতেই আমাদের অবাক করে দিয়ে একটি টার্কিশ হালাল ফাস্টফুডের দোকান। কোনো সময় নষ্ট না করে আমরা ঢুকে পড়লাম। এটার সন্ধান আগে পেলে কাল রাতেই একবার ঢুঁ মারতাম এখানে।

বরফের পাহাড়। ছবি: লেখক
বরফের পাহাড়। ছবি: লেখক

পাশের সুভেনির শপে ছাতা পাওয়া গেল। সঙ্গে দুই মেয়ের জন্য সেমনি কেব্‌ল কারের ছবিসহ টি-শার্ট কিনতেই ছোটজন ইনায়দা সঙ্গে সঙ্গে তা পরে ফেলল। এখন আর এই ঠান্ডায়ও জ্যাকেটের জিপ লাগবে না। পাছে ওর নতুন টি-শার্ট না ঢাকা পড়ে যায়। পাশে একটা সুপার স্টোর খুঁজে চাল আর ডাল কিনলাম রাতে খিচুড়ি খাব বলে।

ছাতা মাথায় সেমনি টাউন ঘুরে বেড়ালাম। সেমনির সব বাসই ব্যাটারিচালিত। পরিবেশদূষণ সেমনির এক বিরাট মাথাব্যথা। মন্ট ব্লংয়ের গ্লেসিয়ার দ্রুত নিচে নেমে আসছে। একেকটি গ্লেসিয়ার ইঞ্চিখানেক নামতে যেখানে বছরের পর বছর লাগার কথা, সেখানে গ্লেসিয়ারগুলো দ্রুত নিচে নেমে গলা শুরু করেছে। গত মাসেও গ্লেসিয়ারের কারণে সেমনি-মিলানের রাস্তা বন্ধ ছিল। পাহাড়ের অনেক বাড়ির লোককে সরিয়ে নিতে হয়েছে।গ্লেসিয়ার দেখার জন্য সাইন ফলো করে হাঁটছিলাম। শহরেই আছে গ্লেসিয়ার ভিউ পয়েন্ট। কিন্তু পাহাড়ে তো কিছুই চোখে পড়ে না। পাশ দিয়ে যাওয়া এক নারীকে Bonjour Madame বলে গ্লেসিয়ারের সন্ধান চাইলাম। আমার ফ্রেঞ্চ দৌড় Bonjour (হ্যালো) আর Merci (ধন্যবাদ) পর্যন্ত। তাও আবার থ্যাংক ইউ বলার পর মারসি বলি।

আমার মেয়ে ইসরা তা লক্ষ করেছে এবং আমাকে যেকোনো একটি বলতে বলেছে। ইসরা স্কুলে কিছু ফ্রেঞ্চ শিখেছে বলে তা দিয়ে আমার ওপর পণ্ডিতি করে। টানেলে ওঠার সময় আমাকে ফ্রেঞ্চে লেন নম্বর দুজোতে ড্রাইভ করতে বলেছে। আমি তো কিছুই বুঝিনি। গাড়ি ড্রাইভ না করে দাঁড়িয়েছিলাম। না বুঝে ভুল লেনে উঠে না আবার ক্রসিং মিস করি!

ইসরা আমাকে বলে, ড্যাডি লেন ২-এ ড্রাইভ করো, তুমি আমাকে বিব্রত (Embarrassed) করছ! আমি ওকে বলি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা না জানার জন্য আমি বিব্রত হই না। তো ওই ফ্রেঞ্চ নারী তাঁর আঙুল পাহাড়ের দিকে তুলে আমাকে গ্লেসিয়ার দেখালেন। কিন্তু আমি তো তা দেখি না। হাল ছেড়ে দিয়ে তিনি তাঁর মোবাইল ফোনে ছবি তুলে আঙুল দিয়ে গ্লেসিয়ার দেখালে তখন চিনলাম গ্লেসিয়ার। আসলে মন যা জানে না, চোখ তা দেখে না। তাঁকে আবেগে কয়েকবার থ্যাংক ইউ আর মারসি বলে মেয়েকে আরেকটু বিব্রত করলাম।

সকালে খুবই সুন্দর আবহাওয়া। মেঘ সরে গিয়ে পাহাড়চূড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সূর্যের আলো পড়ে তা সোনালি দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সেদিন আমাদের মন্ট ব্লং ট্রাম আর ইতালির কুরম্যওর (Courmayeur) দেখার প্ল্যান।

মন্ট ব্লংয়ে বাংলাদেশ লেখা ব্যানার হাতে লেখকের মেয়ে ইসরা। ছবি: লেখক
মন্ট ব্লংয়ে বাংলাদেশ লেখা ব্যানার হাতে লেখকের মেয়ে ইসরা। ছবি: লেখক

মন্ট ব্লং ট্রাম স্টেশনে এসে শুনি ট্রাম সার্ভিস বন্ধ। গাড়িতে পোস্ট কোড দিয়ে সি লেভেল থেকে ৬০০ ফুট উঁচু সেই স্টেশনে রওনা দিলাম। ট্রাম নেই তো কী হয়েছে। গাড়ি করে দেখে আসি। শেষের ১০ কিলোমিটার সর্পিল পাহাড় বেয়ে ওঠা। একসময় দেখি আমরা মেঘের ওপরে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি আর ছবি তুলে কুরম্যওর রওনা হলাম। কারণ, আর ওপরে গাড়ি নিয়ে ওঠা যাবে না।

সেমনি থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে ইতালির কুরম্যওর স্কাই ওয়ে স্কি রিসোর্ট। ১৯৬২ সালে পাহাড়ের নিচ দিয়ে কাটা ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেল যুক্ত করেছে ফ্রান্স আর ইতালিকে। টানেলের একদিকে ফ্রান্সের সেমনি, অন্যদিকে ইতালির কুরম্যওর।

৫৭ ইউরো দিয়ে পার হওয়া যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরলে আর বাড়তি কোনো চার্জ নেই। কোনো পাসপোর্টও দেখাতে হয় না। গেটে যখন থামি, সহধর্মিণী আমাদের চারজনের পাসপোর্ট দিতেই ইতালিয়ান সিকিউরিটি লেডি বলে ওঠেন, অনলি মানি। আবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ফ্রি মুভমেন্ট অব পিপল অ্যান্ড গুডস।

২০ কিলোমিটার লম্বা টানেল পেরোতেই আমরা চলে এলাম কুরম্যওর। রাস্তা বা বাড়িঘর সব একই। একই রকম আল্পাইন ভিলেজ। আমরা থামলাম স্কাই ওয়ে স্কি রিসোর্টে। এখান থেকেও কেব্‌ল কারে করে ট্যুরিস্ট ও স্কিয়াররা মন্ট ব্লংয়ে উঠছেন।

কার পার্ক চারদিকে পাহাড়ঘেরা এক ভ্যালিতে। বসন্তে সব গাছের পাতা লাল হয়ে আছে। আগের দিনই পাহাড়চূড়ায় উঠে এসেছি। তাই একই পাহাড়ে আবার ওঠার কোনো ইচ্ছা নেই। দূরে এক পাহাড়ি ঝরনা দেখা যাচ্ছে। ওই ঝরনার কাছে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করলাম। দূর পাহাড়ের বরফ গলা পানি দিয়ে তৈরি পাথুরে ঝরনা। কেমন যেন রুক্ষ, কোনো সবুজ গাছপালা নেই।

বিকেলে সেমনিতে ফিরে এলাম। সেদিন রোদ ওঠায় মেঘ সরে দূরে পাহাড়চূড়ার সুন্দর ভিউ আসছে আমাদের স্যেলের পেছনের বাগান থেকে। সহধর্মিণীকে বলেছিলাম আসার সময় শাড়ি নিয়ে আসতে। পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবি তুলে দেব। আবার কখন মেঘ এসে পাহাড়কে আড়াল করে দেয়। বললাম, এখনই ছবি তুলে নিলে হয়। (চলবে)

ধারাবাহিক এই ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: