ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি: বরফের পাহাড় আল্পস-৪

মন্ট ব্লংয়ে সহধর্মিণীর লেখক। ছবি: লেখকের মেয়ে
মন্ট ব্লংয়ে সহধর্মিণীর লেখক। ছবি: লেখকের মেয়ে

পাহাড়ে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ভ্যালিতে হঠাৎ করে অন্ধকার নেমে আসে। দিনের বেলায় রাস্তায় গাড়ি খুব কম দেখা যায়। রাতে তো একদম ফাঁকা।

টার্কিশ রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে সেমনি টাউন সেন্টারে রওনা হলাম। রাতে অনেক টুরিস্টদের আমাদের মতো ঘুরতে আর ছবি তুলতে দেখলাম। আশপাশে অনেক হোটেল। ট্রেনে সেমনি এসে স্টেশনের কাছের হোটেলে অনেকেই ওঠে।

অন্য রেস্তোরাঁয় অনেক ভিড়। ভেতরে বসার জায়গা করতে না পেরে এই শীতে রাস্তায় চেয়ার দিয়ে বসার জায়গা করেছে। টার্কিশ রেস্তোরাঁ প্রায় ফাঁকাই বলা যায়। আমরা ছাড়া আরেকটি আরব ফ্যামিলি।

সেমনিকে বলা হয় এক্সট্রিম স্কিইংয়ের গ্লোবাল ক্যাপিটাল। এখানের কফি শপে গিয়ে নাকি কারা হিমালয়ের বেসক্যাম্পে গেছে জিজ্ঞেস না করে কারা যায়নি জিজ্ঞেস করাই ভালো। তাহলে অল্প কিছু হাত উঠবে। প্রতিবছর অনেক দুর্ঘটনাও হয়। দূর থেকে দেখা মসৃণ তুষারের নিচে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর খাদ মাঝে মাঝেই অনেক প্রাণ কেড়ে নেয়।

আসার পর থেকেই এনেসির ওয়েদার দেখছি। বৃষ্টির জন্য যাওয়া হচ্ছে না। এনেসি সাউথ ফ্রান্সের সুইজারল্যান্ডের সীমান্তবর্তী আরেকটি আল্পাইন শহর। সবুজ স্বচ্ছ পানির বিশাল লেকের জন্য বিখ্যাত। লেকের পানি আসে আল্পসের বরফ গলা নদী আর নিচে থাকা উষ্ণ স্ট্রিম থেকে। যে কারণে তীব্র শীতেও এই লেকের পানি বরফে জমে যায় না।

আজকে সেমনিতে বৃষ্টি হলেও এনেসিতে খুব ভালো ওয়েদার। ওয়েদার অ্যাপ তাই বলছে। তাই আমরা সকালবেলাই বেরিয়ে পড়লাম। সেমনি থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের শহর এনেসি। যা জেনেভা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে। পাহাড় দেখে দেখে মেয়েরা ক্লান্ত। লেক আর বোট রাইডের কথা শুনে তাই খুবই উৎফুল্ল।

সেমনি থেকে এক ঘণ্টার ড্রাইভে পৌঁছে গেলাম এনেসি। লেকের ধারেই কার পার্কে গাড়ি রেখে লেকে চলে এলাম। ওয়েদার অ্যাপ কোনো ভুল করেনি। সুন্দর রোদেলা সকাল। লেকের সবুজ পানির পেছনে উঁচু পাহাড়। লেকে অনেক ছোট বড় বোট, রং বেরঙের কেনু বা ডিঙি নৌকা।

আল্পসের চূড়ায় স্কিইং। ছবি: লেখক
আল্পসের চূড়ায় স্কিইং। ছবি: লেখক

হাঁটতে হাঁটতে ছবি তুলছি আর লেকে ক্রুজ করার বোট খুঁজছি। ছোট স্পিডবোটে এক ঘণ্টা ঘোরা যায়। কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে বড় বোটে ওঠা ভালো। বোট রাইড ওরা খুব এনজয় করে।

একটু হাঁটতেই বড় বোটের দেখা মিলল। গুগলে ছবি দেখে মনে হয়েছিল পানি হয়তো এডিট করে এত গাঢ় সবুজ করা হয়েছে। এখানে এসে ভুল ভাঙল। আসলেই খুব সুন্দর সবুজ পানি। সিলেটের লালাখালের পিয়াইন নদীতে এ রকম সবুজ পানি দেখেছিলাম।

অনেক বড় বোট। ছোট্ট কফিশপ ও স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা আছে মাঝখানের গ্লাস দিয়ে ঘেরা অংশে। সামনে আর পেছনের খোলা জায়গায় বসে লেকের সৌন্দর্য উপভোগের ব্যবস্থা। মেয়েরা এর মধ্যেই ক্রিসপ কিনে খাওয়া শুরু করেছে।

এক ঘণ্টা ধরে বোট সুন্দর লেকের সবদিক আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। সঙ্গে স্পিকারে ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজিতে উল্লেখযোগ্য অংশের বর্ণনা। লেকের ধারে সুন্দর বাড়ি, ক্যাসল, ঘাটে প্রাইভেট স্পিডবোট। লেকের যত গভীরে যাচ্ছি পানি আরও সবুজ হচ্ছে।

আমাদের পাশের সিটে বসেছেন এক ফ্রেঞ্চ পরিবার। সঙ্গে তাদের দুই মাসের মেয়ে। ইনায়দা ওর কাছে যেতেই বাচ্চাটা হেসে দিচ্ছে। ইনায়দা বাকি পথ ওর সঙ্গেই আছে।

দিন ভালো বলে মনে হয় লেকে অনেকে কেনুয়িং করছে। কেউবা রঙিন পাল তোলা সেইলিং বোট নিয়ে লেকে নেমেছে। এক ঘণ্টা দেখতে দেখতে কেটে গেল।

সেমনিতে এসে কোনো ম্যাকডোনাল্ডস পাইনি। মেয়েরা ম্যাকডোনাল্ডস খেতে চায়। তা যত না খাওয়ার জন্য তার চেয়ে বেশি ফ্রান্সে বাচ্চাদের হ্যাপি মিলের সঙ্গে কী ফ্রি টয় দেয় তা দেখা। বোটে ঘোরা শেষ করে তাই ম্যাকডোনাল্ডসে রওনা হলাম।

আল্পসের স্থানীয় এক স্কিইং প্রশিক্ষক। ছবি: লেখক
আল্পসের স্থানীয় এক স্কিইং প্রশিক্ষক। ছবি: লেখক

লেকে সূর্যাস্ত দেখে ফিরে আসার ইচ্ছে থাকলেও পরদিন ইংল্যান্ডে ফেরার পালা। আবার ৯৫৫ কিলোমিটারের ড্রাইভ। তাই সন্ধ্যা নামার আগেই সেমনি ফেরার পথ ধরলাম।

রাতে নাটালি আমাদের খোঁজ নিতে মেসেজ করেছে। তাদের স্যালেতে, সেমনিতে আজকেই শেষ রাত। দারুণ কিছু সময় কাটালাম এখানে। ওদের ম্যারসি বলে মেসেজ পাঠালাম আর বললাম সকাল ১০টার দিকে আমরা চেক আউট করব।

আকাশে মেঘ না থাকায় দূরে মন্ট ব্লংয়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে। রাতের আকাশে অনেক তারাও আছে। ক্যামেরা ট্রাইপডে ফিক্স করছি এই তারার মেলার কোনো ছবি যদি ক্যামেরাবন্দী করা যায়। দূরে দেখি একটা তারা খসে পড়ল।

আমাদের নানা বাড়ির পাশে একটা বিল ছিল। ছোটবেলায় সন্ধ্যার পর রাতে মামাদের সঙ্গে বিলের ধারে গেলে এ রকম আকাশভরা তারা দেখতাম। প্রায়ই এই তারা খসা দেখতাম তখন। আমার কাছে তা একটা সাধারণ ব্যাপারই মনে হতো তখন। অনেক দিন পর আজ আবার তারা খসা দেখলাম।

সকালে ঝকঝকে রোদ। দূরের পাহাড় যেন আমাদের বিদায় জানাতে আরও সুন্দর করে সেজেছে। সব জিনিসপত্র তোলা শুরু করেছি গাড়িতে। স্টেফান ও তাদের ছেলেরা বারান্দা থেকে গুড বাই জানাচ্ছে আমাদের। আমাদের মেয়েরা গাড়ির পেছনের কাচ দিয়ে ওদের ওয়েভ করছে।

নেভিগেশন সিস্টেমে ক্যালের ইউরো টানেলের ঠিকানা দিয়ে ভ্যালির ছোট রাস্তা ধরে কিছু দূর গিয়ে অটো রুট ব্লংয়ের প্যারিসমুখী পথ ধরলাম। পেছনে ছোট হতে হতে হারিয়ে যেতে লাগল আল্পস। শুভ্র স্বপ্নিল আল্পস। তবে আল্পসের কূলে কাটানো এই কয় দিনের স্মৃতি মনে পড়বে সব সময়। (শেষ)

ধারাবাহিক এই ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন