রাগে-অনুরাগে

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

আসিফ অনেকক্ষণ ধরে একচেটিয়াভাবে গলার প্র্যাকটিস করছে। তার মেজাজ ভয়ংকর খারাপ। নীতার ভাবলেশহীন চেহারা দেখে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। নীতা তাকে পাত্তাই দেয় না।

নীতাকে উত্তপ্ত করার শেষ একটা চেষ্টা করতে গিয়ে আসিফ বলল, ‘আমি তোমার বাপের চাকর না যে সব সময় তোমার হুকুম তামিলের জন্য এক পায়ে খাঁড়া থাকব। মনে থাকে যেন কথাটা।’

আসিফের উদ্দেশ্য সফল হলো। নীতা কঠিন চোখে আসিফের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিল, ‘বাপ তুলে কথা বলবে না। অনেক ছোটলোকামি করেছ, আর না।’

নীতাকে রাগাতে পেরে আসিফ মনে মনে যথেষ্ট পুলক অনুভব করলেও বাইরে তা প্রকাশ করল না। ভাব ধরে রেখে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি ছোটলোক। তাই যত খুশি ছোটলোকামি করব। আমার সাফ সাফ কথা, আমি যেভাবে ইচ্ছা থাকব। যে রকম ইচ্ছা চলব। তোমার ভালো না লাগলে তুমি চোখ বুঁজে থাক, ব্যস।’

নীতা বলল, ‘বাসা তোমার একার না যে জঙ্গল বানিয়ে রাখবে। ভদ্রলোকের বাড়ির কিছু নিয়মকানুন থাকে। সেটা তোমাকে মানতে হবে। তা যদি না চাও তাহলে মেস ভাড়া করে নিজের মতো থাকো গে।’

: নিজের বাড়ি ছেড়ে মেসে যাব কোন দুঃখে? আমার বাসা থেকে আমাকে বিদায় করার ষড়যন্ত্র করছ তুমি? হায়রে লোভী মহিলা, আমার জীবন শেষ করে শান্তি হয় না তোমার। এখন আমাকে তাড়িয়ে আমার বাড়ি দখল করতে চাও।

: লোভী! তোমার কী আছে যে লোভ করব। ভুলে যেয়ো না এই বাড়ি আমার নামে। লোভ করলে তুমিই করো। আমি না। আর জীবন শেষ আমি তোমার, না তুমি আমার করেছ সেটা ভেবে দেখো। তোমার মিথ্যা প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে আজ বহুদিন ধরে অনুশোচনা করছি।

নীতার কথা শুনে আসিফ একটু থতমত খেয়ে গেল। এ কারণেই নিজের ওপর রাগ লাগে আসিফের। নীতার মতো যুক্তি দিয়ে কঠিন কথা সে বলতে পারে না। একরাশ তিক্ততা নিয়ে আসিফ গড়গড় করে বলে গেল, ‘কোনো কিছু মিথ্যা ছিল না। ভালো ঠিকই বেসেছিলাম। কিন্তু এই নীতাকে না। আমি ভালোবেসেছিলাম মিষ্টি করে কথা বলা শান্ত স্বভাবের নীতাকে। তখন যদি জানতাম তুমি আস্ত একটা খাণ্ডারনি, তাহলে এই পথে আমিও পা বাড়াতাম না। স্বপ্ন দেখেছিলাম লক্ষ্মী একটা বউয়ের। মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাতে চাওয়া বউয়ের না।’

নীতা বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে শীতল গলায় বলল, ‘একটু সভ্যভব্যভাবে, নিয়মের মধ্যে থাকতে বলা যদি ছড়ি ঘোরানো হয়, তাহলে আর বলব না। আর কিছুই বলব না কোনো দিন। করো যা ইচ্ছা এখন থেকে। আমার সঙ্গে কথা বলতে এসো না শুধু দয়া করে।’

আরেক পাশে মুখ ঘুরিয়ে শুতে শুতে আসিফ মনে মনে বলল, ‘বয়েই গেছে কথা বলতে আমার। প্যানপ্যান শুনতে হবে না। তাতেই আলহামদুলিল্লাহ। অসহ্য একটা মহিলা। সারা দিন খালি পেছনে লেগে থাকে। ঘর নোংরা করলে কেন। ময়লা পা নিয়ে বিছানায় উঠলে কেন। টিভি ছেড়ে ঘুমিয়ে গেলে কেন। ভিজা টাওয়েল বিছানায় রাখলে কেন। এত করে মনে করিয়ে দিলাম তাও রসুন আনতে ভুলে গেলে কেন। বাথরুমের মেঝে পিচ্ছিল করলে কেন? সারা দিন খালি কেন কেন কেন! এত বিধিনিষেধে প্রাণ হাঁপিয়ে আসে। পেয়েছেটা কী সে? আমি স্কুলে পড়া বাচ্চা যে সে আমাকে যেভাবে চলতে বলবে আমি চলব? আমার জীবন, আমার যা খুশি তাই করব। বিয়ে তো না যেন অভিশাপ। এর থেকে তো জেল খাটা আরামের হতো।’

সকালে উঠে আসিফ বেকায়দায় পড়ল। অফিসের শার্ট, প্যান্ট কিছু তার হাতের নাগালে নেই। প্রতিদিন নীতা সব রেডি করে বিছানায় রেখে দেয়। এখন কথা বলাবলি বন্ধ। কাজেই নীতাকে জিজ্ঞেস করার বা সাহায্য চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আসিফ তাদের একমাত্র ছেলে রিশানকে মিস করতে লাগল। আগে ঝগড়া হলে রিশান দুজনের মাঝে কথা–চালাচালির কাজ করত। কেন যে ছেলেটাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠাতে গেল সে। ধুর!

খাবার টেবিলে নীতা একা একা নাশতা করছিল। ইচ্ছা করেই আসিফের জন্য কিছু রেডি করেনি সে। মনে মনে বলল, ‘বুঝুক একটু বউয়ের মূল্য। সবকিছু সহজে পেয়ে যায় দেখে শিক্ষা হয় না। কাপড় না খুঁজে পেলে খালি গায়ে যাক। দেখি কী করে। আমাকে খাণ্ডারনি বলে, কত বড় সাহস!’

আসিফ কুঁচকোনো এক শার্ট পরে বেডরুম থেকে বেরিয়ে এল। আলমারি খুলে সামনে এটাই পেয়েছে। নীতাকে আরামে বসে খেতে দেখে তার মেজাজ চড়ে গেল। এক টেবিলে আর বসতে ইচ্ছা করল না। হনহন করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় ইচ্ছে করে দরজা সশব্দে বাড়ি দিয়ে রাগটা প্রকাশ করে গেল।

নীতা মনে মনে হাসল।

লেখিকা
লেখিকা

প্রতিদিন লাঞ্চ ব্রেকে আসিফ নীতাকে ফোন করে। আজও অভ্যাস বসত ডায়াল করে ফেলেছিল। করার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়াতে টুক করে কেটে দিয়েছে। সকালে কিছু খাওয়া হয়নি। ভীষণ খিদে পেয়েছে। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে আসিফ ক্যানটিনের দিকে রওনা দিল। ওদিকে বেলা পড়ে আসতে আসতে নীতার রাগও একটু একটু করে কমে আসছিল। তার মনে পড়ল আসিফ সকালে না খেয়ে গেছে। ক্যানটিনের ওই সব বাসি–পচা সমুচা শিঙারা খেয়ে যে আসিফের পেট ভরবে না, তা সে ভালো করেই জানে। রান্নার আইটেম আরেকটা বাড়িয়ে দিতে দিতে নীতার নিজের ওপরই ভীষণ বিরক্তি লাগল। যে লোক তাকে লোভী মহিলা ডাকতে পারে, তার জন্য সে কেন ভাবছে? মানুষটা খেলেই কী আর না খেলেই কী? এই পনেরো বছরের সংসারে প্রথম দিকের সেই মাধুর্যের কিছুই আর বাকি নেই। ঝগড়ার সময় যখন একে অপরকে কথা দিয়ে আঘাত করাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন সামনের মানুষটাকে নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। এই সম্পর্কের জন্য কিছু করে কী লাভ?

সন্ধ্যায় ফিরতি পথে আসিফ নিজের জন্য চাইনিজ খাবার কিনে এনেছে। বেশ রসিয়ে রসিয়ে সেটা খেল। উদ্দেশ্য, নীতাকে বোঝানো সে রান্না না করলেও আসিফের কিছু এসে–যায় না। নীতা না দেখার ভান করল। কোনো একটা রিঅ্যাকশন দেওয়া মানে আসিফকে জিতিয়ে দেওয়া। অতএব প্রশ্নই ওঠে না।

আসিফ খেয়ে ওঠার পর নীতা নিঃশব্দে নিজের রান্না করা খাবারগুলো ফ্রিজে উঠিয়ে রেখে রিমোট নিয়ে টিভি দেখতে বসে গেল। আসিফ যে বাসায় আছে যেন সে টেরই পাচ্ছে না। আসিফ খানিকক্ষণ খাবার রুম আর ড্রয়িংরুমের পাশ দিয়ে হাঁটাচলা করে শোয়ার ঘরে ঢুকে গেল। তার সামান্য অস্থির লাগছে। ভেবেছিল নীতা একটু রাগারাগি করবে। তার বদলে নীতা তাকে সাইলেন্ট ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। নীতার চুপ থাকাটা বিপদের লক্ষণ। বড় ঝড়ের সংকেত। মাত্র দুজন মানুষের বাসা। এর মধ্যে দীর্ঘদিন কথা বন্ধ থাকলে তো টেকা মুশকিল। তার ওপর আগামীকাল ছুটির দিন। এ তো ভালো মুশকিলে পড়া গেল দেখি!

টিভি দেখা শেষ করে নীতা যখন ঘুমোতে এল, আসিফ তখনো জেগে। নীতা কোনো দিকে না তাকিয়ে আবার সেই উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ল। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আসিফের মনে হচ্ছিল নীতাকে একটু জ্বালাতে পারলে তার পরম শান্তি হবে। তার কানের কাছে অনর্গল ঘ্যানঘ্যান করার কেউ না থাকলে, তার সব কাজে খুঁত ধরার কেউ না থাকলে সে মহা আনন্দে থাকবে। অথচ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে নীতার এই নীরবতার থেকে সেগুলো অনেক ভালো। নীতার নিয়মকানুন জেলখানার মতো লাগে। তবু তা সহনীয়। কিন্তু নীতার আসিফকে এভাবে অগ্রাহ্য করা কোনোভাবেই হজম হয় না। নিজেকে অদ্ভুত রকমের অসহায় লাগে। আসিফ মনে মনে বলল, ছেলেকে উদ্দেশ্য করে, রিশান বাবা, তুই ছাড়া আমাকে কেউ বোঝে না!

সকালটা বিষাদে ছেয়ে আছে। আসিফের মন ভয়ংকর রকমের খারাপ হয়ে আছে। ইচ্ছে করলেই যেকোনো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে জম্পেশ নাশতা খেয়ে আসা যায়। কিন্তু কেন যেন ইচ্ছা করছে না। একবার মনে হচ্ছিল বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বলবে তোকে সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম। আজ সারা দিন একসঙ্গে থাকব, আড্ডা দেব। পরমুহূর্তেই সেই আইডিয়া বাতিল করল। ছুটির দিন। সবারই নিজের ফ্যামিলির সঙ্গে কোনো না কোনো প্ল্যান থাকে। খবর না দিয়ে হুট করে যাওয়াটা শোভন হবে না।

বাসার রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছে। সেই শব্দও আসিফের অসহ্য বোধ হচ্ছে। মনে মনে নীতার উদ্দেশে মুখ বিকৃত করে বলল স্বার্থপর এক মেয়েকে বিয়ে করে জীবন আমার তেজপাতা হয়ে গেল। রান্নাবান্না করে নিজে আরামে খাবে। বাড়িতে যে আরেকটা মানুষ আছে, তাকে দেখি পুরাই ভুলে গেছে। মায়া–মহব্বত কি নারী জাতির মনে তুমি দাওনি আল্লাহ? কোন কুক্ষণে যে বিয়ে করেছিলাম! আগে যদি জানতাম, তাহলে...ভাবতে ভাবতেই বিকট একটা চিৎকার দিলেন আসিফ। এই চিৎকার বিয়ে করেছেন সেই আফসোসে নয়, অন্যমনস্ক হয়ে হাতঘড়ি খুলে ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে হাতে ভয়াবহ একটা চিপা খেয়েছেন। ‘আহ’ বলাটা তার ব্যথার বহিঃপ্রকাশ।

চিৎকার শুনে নীতা দৌড়ে এসেছিল। দেখল আসিফের হাতের একাংশে রক্তারক্তি অবস্থা। নীতা ‘ইশ্‌, এ কী’ বলে তৎক্ষণাৎ ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা করল। আসিফ মুখ করুণ করে বসে ছিল। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর লাজুক হেসে বলল, ‘খেয়াল করিনি কীভাবে যেন হয়ে গেল।’ নীতা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি কোনো দিনইবা কিছু খেয়াল করো? সামান্য একটা ড্রয়ারে চিপা লেগে যে কারও এ রকম রক্ত বের হতে পারে, তা জীবনে প্রথম দেখলাম। তোমার সবকিছুই বিচিত্র। পিকুইলিয়ার এক লোককে বিয়ে করেছি আমি। সে জন্য আজকে আমার সংসারের এই অবস্থা!’

আসিফ মনে মনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ভাগ্যিস হাতটা কেটেছিল। ড্রয়ারটার ওপর বিশেষ কৃতজ্ঞ হলো সে। নীতার হাত ধরে গভীর গলায় বলল, ‘এরপর থেকে খেয়াল রাখব। তুমি রাগ কোরো না। আমি চেষ্টা করব তুমি যেমন চাও, সেভাবে সবকিছু করার। মাঝেমধ্যে একটু উল্টাপাল্টা বলে ফেলি। বিশ্বাস করো, মন থেকে বলি না। মনে হয় আমার ভেতর অন্য কেউ ভর করে ওই সব বলিয়ে নেয়।’

অন্য সময় হলে নীতা উত্তর দিত, তোমার চেষ্টার দৌড় জানা আছে। প্রথম কয়েক দিন ঠিক থাকবে। তারপর আবার যে সেই! আজ এই মুহূর্তে নীতা আর তা বলতে পারল না। দুই দিন কথা বন্ধের পর আসিফের এই নিঃশর্ত সমর্পণ নীতার মনটা দ্রবীভূত করে দিল। নরম গলায় বলে উঠল, ‘খাবার দিচ্ছি, খেতে এসো।’

টেবিলের দিকে রওনা হতে হতে আসিফের মনে হলো ঝগড়া জিনিসটা নেহাত খারাপ না। বিবাহিত জীবনে এই ঝগড়া, রাগারাগি, কথা বন্ধ ব্যাপারগুলো আছে বলেই মিল হওয়ার পর সম্পর্কটাকে সেই শুরুর দিকের মতো নতুন আর মধুর লাগে।

সারা বুশরা দ্যুতি: বেডফোর্ড, ইল্যান্ড।