জীবনের রং বদল

তাসনীম আহসান। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত
তাসনীম আহসান। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত

প্রথমবারের মতো ঢাকা এসেছি। বাধ্য হয়েই উচ্চশিক্ষা শেষ করতে হবে। ভালো রোজগার করতে হবে। পরিবারের আর্থিক অভাব দূর করতে হবে কিন্তু শুরুর দিনগুলোতে সেই অভাবই আমার পিছু ছাড়ছিল না।

এলাকার বড় ভাইয়েরা টিউশনি ঠিক করে দেন। কিন্তু কোনো টিউশনিই সপ্তাহখানেকের বেশি টেকে না। কারণ, ঢাকার বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে বড্ড বেশি যান্ত্রিক। তাদের একমাত্র লক্ষ্য, বুঝে বা না বুঝে হোক ভালো ফলাফল করতে হবে।

এদিকে তত দিনে উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের বইগুলো খোলনলচে বদলে ফেলা হয়েছে। তাই চাইলেও আমি উচ্চমাধ্যমিকের ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারি না।

বেশ কয়েকটা টিউশনিতে রিজেক্ট হওয়ার পর মোটামুটি মনমরা হয়ে গেলাম। তত দিনে জমানো টাকাগুলোও শেষ হয়ে যাচ্ছিল। বন্ধুদের কাছেই বা আর কত ধার নেওয়া যায়। কারণ, প্রত্যেকেই তখন বাড়ি থেকে সীমিত টাকা পায়।

এভাবে চলতে চলতে সামনের দিনগুলোতে মোটামুটি অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। তত দিনে সকালের নাশতা করা বাদ দিয়ে দিয়েছি। হলের ডাইনিংয়ে মাসের শুরুতে ছয় শ টাকা জমা দিতে পারলে দুপুর আর রাতের খাবারের ব্যবস্থাটা হয়ে যায়। কিন্তু সকালে নাশতা করতে গেলে আরও প্রায় দশটা টাকার দরকার। তাই নাশতা করা বাদ দিতে হলো বাধ্য হয়েই।

২০০০ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে আমি ছাড়াও সানজাদ, সুদীপ্ত, হাবিব, মাহফুজ ও জাকির বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলাম বিভিন্ন সাবজেক্টে। মফস্বলের একটা কলেজ থেকে বুয়েটে এক ব্যাচে এতগুলো ছেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়াটা তখনকার দিনে মোটামুটি অসম্ভবই ছিল। আমরা একই কলেজের হওয়াতে আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা ছিল দারুণ।

একদিন বন্ধু সানজাদ এসে বলল, ইয়াকুব আমার খালাতো ভাই রানা (তাসনীম আহসান) রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তুমি চাইলে ওকে পড়ানো শুরু করতে পার। অকূলদরিয়ায় আমি যেন কূলের দেখা পেলাম।

রানা তখন নেহাতই বাচ্চা একটা ছেলে। ওর মা–বাবা দুজনই পেশায় চিকিৎসক। তাঁদের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে রানা বড় আর নীলপলা ছোট। আমার নিজের কোনো বোন ছিল না তাই নীলপলাকে নিজের বোনের জায়গায় বসিয়েছিলাম।

রানার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল ভারী অদ্ভুত। শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্কের ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। আবার বন্ধুত্বের ক্যাটাগরিতেও ফেলা যায় না। রানাকে পড়ানো শুরু করার পর থেকেই প্রতিদিন চমৎকৃত হতাম ওর জানাশোনার পরিধি দেখে। সে তত দিনে হুমায়ূন আহমেদের একটা জীবন্ত অমনিবাসে পরিণত হয়েছে। ওর কাছে হুমায়ূন আহমেদের সব বই ছিল। আমারও আউট বই পড়ার নেশা ছোটবেলা থেকেই। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই সব সময়ই বেশি টানে আমাকে। তাই পড়ানো শেষ করে রানার কাছ থেকে বই নিয়ে যেতাম পড়ার জন্য।

ওকে পড়ানো শুরু করার পর ঢাকা শহরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমার ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো। রানারও আগ্রহ সিলেবাসের বাইরের বইয়ের প্রতি বেশি। সে শুধু অতটুকুই পড়ে পাস করার জন্য যতটুকু পড়া দরকার।

তাসমীম আহসানের চিকিৎসার জন্য তহবিল সংগ্রহের প্রচারপত্র। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত
তাসমীম আহসানের চিকিৎসার জন্য তহবিল সংগ্রহের প্রচারপত্র। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত

রানাকে দিন শেষে পড়ানোর আরও একটা উপকারিতা ছিল। সেটা হলো, সারা দিন পরিশ্রম করে যেটুকু ক্লান্ত হতাম রানার সঙ্গে আড্ডা দিলে সেই ক্লান্তিও দূর হয়ে যেত। এভাবে আমাদের মধ্যে একটা বিনে সুতার বন্ধন তৈরি হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে রানা চট্টগ্রাম প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে একটা সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি শুরু করে।

রানার বর্তমান বয়স মাত্র ২৮ বছর। ২০১৭ সালে ওর বিয়ে হয়েছে। ২০১৮ সালে রানার ক্যানসার ধরা পড়ে। সে টি টাইপ অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকোমিয়ায় (T-ALL) আক্রান্ত। এরপর শুরু হয় রানার চিকিৎসা। কাকতালীয়ভাবে রানার সঙ্গে ওর বোন নীলপলার বোনম্যারো ম্যাচ হয়ে যায়। পরে নীলপলার শরীর থেকে রানার শরীরে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় সফলভাবে।

এ পর্যন্ত সবকিছু মোটামুটি ঠিকভাবেই চলছিল। গত মাসে রানাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। সেটা নিশ্চিত করার জন্য রানার শরীর আবার পরীক্ষা করা হয়। তখন দেখা যায় রানার শরীরের কোষগুলো নীলপলার কোষগুলোকে রিজেক্ট করা শুরু করেছে। এখন আবার তার চিকিৎসার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। আগেরবারের মতোই কেমোথেরাপি চলবে নিয়ম করে। এর পাশাপাশি চলবে বোনম্যারো খোঁজার কাজ।

চিকিৎসকেরা এই দুঃসংবাদটা দেন তখন স্বভাবতই রানার মা–বাবা-বোন-স্ত্রী সবাই ভেঙে পড়েছেন। আর তাঁদের গ্রাস করেছে একটা রূঢ় অসহায়ত্ব। গত এক বছরের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে ওর মা–বাবা একেবারে কপর্দকহীন হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে রানার মা–বাবা তাঁদের একমাত্র ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমান চিকিৎসা ব্যয় বহন করার ক্ষমতা এখন আর তাঁদের নেই।

রানার স্বাস্থ্যের নিয়মিত আপডেট রাখছিলাম কখনো ফোনে অথবা কখনো ফেসবুকে রানার পোস্ট থেকে। অক্টোবরের ৯ তারিখে এই খবরটা পাওয়ার পর থেকেই একধরনের শূন্যতা কাজ করছে আমার মনের মধ্যে। আমি জানি না মনের এই শূন্যতাটাকে কী বলে। রানার খবরগুলো জানার পর থেকে আমার জীবনযাপনে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। শুধু বারবার মনে হচ্ছে আমরা কত অসহায়। সামান্য অর্থের অভাবে আমার ছোট ভাইটার চিকিৎসা হবে না। এই ভাবনা আমাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে।

আমি আমার সাধ্যের বাইরে গিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি রানার পাশে দাঁড়ানোর। আমার পরিচিতজনদের মধ্যেও অনেকেই রানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। যাঁদের সঙ্গে রানার বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই। একজন মানুষ বিপদে পড়েছেন বলে মানুষ তাঁকে সাহায্য করার জন্য পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন দেখে আবারও মানবজাতির প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাসটা ফিরে পাই।

রানাকে আমি কল্পনা করলেই রানার প্রাণোচ্ছল মুখটা ভেসে ওঠে। কিশোরের শরীরে আটকে পড়া একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কথা মনে পড়ে। যার মনের প্রতিটি কোণা মানুষ ও মানবতার কথা বলে। অন্যের বিপদে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা হচ্ছে আমাদের রানা।

অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়ার ব্যাপারটা আমি যত দূর বুঝি সেটা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম কঠিন একটা কাজ। এতে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া গেলেও নিজের আত্মাভিমান নষ্ট হয়। আমি জানি, রানার মা–বাবাও সেই পরিস্থিতিতে আছেন। তাঁরা কখনোই ব্যক্তিগতভাবে আমাকে একটিবারের জন্য বলেননি রানার জন্য সাহায্য চাইতে। কিন্তু আমি জানি, এটা এখন অনেক জরুরি।

নীলপলা ও রানার কিশোরী স্ত্রীও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই-একবার সাহায্য চেয়ে পোস্ট দিয়েছেন। যেটাকে আসলে সাহায্য চাওয়ার পোস্ট বলা চলে না। কারণ, এই মানুষগুলো কোনোভাবেই এই আচরণে অভ্যস্ত না। এর বাইরে রানার বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী যাঁরা রানাকে চেনে, সবাই এগিয়ে এসেছেন রানার বিপদের দিনে। কিন্তু গতবারের মতো এবার তেমন একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই আমি সাহায্য চাইতে এলাম আপনাদের কাছে। আবেদনসংবলিত প্রচারপত্রের যেকোনো একটি লিংকে গিয়ে আপনারা তাসনীম আহসান রানাকে সাহায্য করতে পারেন সাধ্যমতো।

জীবন কখন কীভাবে তার রং বদলাবে এটা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু আমরা সবাই একটু সদিচ্ছা প্রকাশ করলেই একটা প্রাণ অকালে ঝরে পড়া থেকে রক্ষা পাবে। পৃথিবীর সব মানুষের মঙ্গল হোক। মানবতার জয় হোক।