পেঁয়াজ এবং কিপটে নানা

প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি

‘কইগো তোমরা, শিল্পীর মা কই গেলা’ বলে বশীর আলী পাঁচ কেজি পেঁয়াজ নিয়ে ঘরে আসেন।

শিল্পী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাবার হাত থেকে পেঁয়াজের পলিথিন ব্যাগটা নেয়।

বশীর আলী বলেন, ‘বাজারের সবচেয়ে দামি জিনিস লইয়া আইছি, একেবারে পাঁচ কেজি। কিপটেমি করি নাই। তোর আম্মারে গিয়া বল, পেঁয়াজের কেজি ২২০ টাকা। তবুও আব্বা খালি হাতে আসে নাই।

শিল্পী হাসতে হাসতে পেঁয়াজের ব্যাগ নিয়ে রসুইঘরে হনুফা বেগমের কাছে যায়।

: আম্মা আব্বায় কয় পেঁয়াজের কেজি নাকি ২২০ টাকা। এত দাম হইছে, তবুও আব্বা পেঁয়াজ ছাড়া ঘরে আহে নাই। তা–ও আবার পাঁচ কেজি।

: তোর বাপের গরুর গোশত খাইতে মন চাইছে। পেঁয়াজ ছাড়া গরুর গোশত রান্ধুম কেমনে। তাই তোর বাপে দামের দিকে না চাইয়া লইয়া আইছে।

: আম্মা, আপনে সব সময় একটা না একটা কথা কইয়া আব্বারে ছোট করবেন। কেন, আব্বার যে হাত বড়, হেই কথা কইতে দোষ কী!

: হ। পেঁয়াজ কিনতে আবার হাত বড় লাগে! কই আমার যে গত দুই মাস ধইরা কানের দুল জোড়া ভাইঙা পইড়া আছে, হেইডাতো স্বর্ণকারের কাছে নিয়া ঠিক করাইয়া আনে না। নতুন এক জোড়া কিনা তো দিবই না। তোর বড় খালা আমারে দিসিল।

: আপনে খালি স্বর্ণই চিনছেন। আমি কাইলকা কলেজে গেছিলাম। হুইনা আইছি পেঁয়াজের এত দাম। মানুষে চলব কেমনে!

: হ পেঁয়াজ মাঙ্গাইতো। ২২০ টাহা কেজি আমি আমার জনমে হুনি নাই।

বশীর আলী এরই মধ্যে রসুইঘরে চলে আসেন। রসুইঘরে একটা ভাঙা চেয়ার আছে। সেই চেয়ারে গিয়ে বসেন। চেয়ারের দুই হাতলের মধ্যে এক হাতল ভাঙা। কিন্তু পায়াগুলো ঠিক আছে। বসা যায়। স্ত্রী যতক্ষণ রান্না করেন, বশীর আলী মাঝেমাঝে এই চেয়ারে এসে বসে থাকেন। রান্না হয়ে এলে, চামচে করে একটু তরকারি নিয়ে স্বাদ দেখেন। লবণ হয়েছে কি না দেখেন।

শিল্পী বঁটি দিয়ে পেঁয়াজ কাটতে বসে। হনুফা বেগম গরুর গোশত কাটছেন। বশীর আলী হাত বাড়িয়ে মেয়েকে বলেন, আস্তে কাট। একটা মাঝারি সাইজের পেঁয়াজের অর্ধেক কাট। আর বাকিটা অন্য তরকারিতে দিস। এই পাঁচ কেজি দিয়া তিন মাস চালাবি।

হনুফা বেগম বলেন, পাঁচ কেজি পেঁয়াজ দিয়া তিন মাস! এর থেইকা পেঁয়াজ না কিনা আনতেন হেইডাই ভালা আছিল। আর এই ছোট্ট পেঁয়াজের অর্ধেক দিলে গোশত তো স্বাদ হইব না। মুখেও লওন যাইব নাহ। গরুর গোশতে পেঁয়াজ একটু বেশি লাগে।

বশীর আলী বলেন, এত স্বাদের দরকার নাই। অনেক স্বাদের গোশত খাইছ। টাহাটা আসে কোত্থেইকা। হার্টে রিং বসাইয়া আমি তো কোনো কামই করতে পারি না। একটা পোলা মানুষ হইল না। হারাদিন টইটই কইরা ঘুইরা বেড়ায় আর কয় বিদেশ যাইব। সৌদি আরবের লাইন কইরা দিত। জমি বেইচা দুই মাইয়া বিয়া দিসি। আরেকডারে দিত হইব। গঞ্জে দোকান ভাড়া দিয়া এই সংসার চালাই।

এমন সময় রসুইঘরের জানালা দিয়ে বশীর আলী কী দেখে চমকে ওঠেন। দৌড়ে বের হয়ে যান।

পুকুরপাড়ে ফলের বাগানে পাশের বাড়ির হাভাতে ছেলেমেয়েগুলো এসেছে। এগুলো একটু সুযোগ পেলেই বশীর আলীর ফলের বাগানে ঢুকে পড়ে। সব রকমের ফল কুড়িয়ে নেয়। গাছে চড়েও পেড়ে নেয়।

লেখিকা
লেখিকা

বশীর আলী হাতে লাঠি নিয়ে ওদের তাড়া করেন। সব কটি দৌড়ে পালিয়ে যায়। শুধু রমিজ পেয়ারাগাছের ওপর থেকে যায়। তাকে বশীর আলী দেখেননি। বশীর আলী ফেরার জন্য যখন রওনা হয়েছেন, তখনই রমিজ লাফ দিয়ে বেশ কিছু পেয়ারা নিয়ে নেমে দৌড়াতে থাকে। বশীর আলী পেছনে ঘুরে তেচোখা লাঠিটা রমিজের দিকে ছুড়ে মারেন। রমিজের পৃষ্ঠদেশে ভালোমতো বাড়ি লাগে। তবুও পেয়ারাগুলো নিয়ে পালিয়ে যেতে যেতে রমিজ বলে, কিপটা নানা! কিপটা নানা! কিপটার ধন চোরে খায়। আরও কিছু দূর যাওয়ার পর রমিজের সঙ্গী–সাথিরাও বলে, কিপটা নানা, কিপটা নানা! বশীর আলী ধমক দিয়ে তেড়ে আসেন। সব কটি পালিয়ে যায়। এরপর ফলগুলো সবাই ভাগাভাগি করে নেয় আর পরামর্শ করে। রমিজ একটু বেশি নেয়, কারণ রমিজের গায়ে লাঠির বাড়ি পড়েছে ও প্রচণ্ড ব্যথা।

এরপরের কয়দিন বশীর আলী আরও ভালোমতো নিজের ফলবাগানে পাহারা দেন। রাতের বেলায়ও খেয়াল রাখেন। কারণ, লাঠির বাড়ি মারার কারণে এই দুষ্টু বাচ্চাগুলো সব সাবাড় করতে পারে। কয়েক দিন ভালোমতো পাহারা দেওয়ার পর বশীর আলী বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি হন। রসুইঘরে এসে হনুফাকে বলেন, বাজারে যাইতাছি। কী কী লাগব।

হনুফা বেগম মুখ ভার করে রাখেন। কোনো উত্তর দেন না।

বশীর আলী বলেন, বাজার কি কিছুই লাগব না?

শিল্পী রসুইঘরে এসে বলে, পেঁয়াজ লাগব। একটা পেঁয়াজও নাই।

বশীর আলী বলেন, কী! পাঁচ কেজি পেঁয়াজ এই কয়দিনে কেমনে শেষ করলি। তোগোরে আর পেঁয়াজ কিনা দিমু না। পেঁয়াজ ছাড়া রাঁধবি।

শিল্পী বলে, আমরা শেষ করি নাই। আধা আধা কইরা তরকারিতে দিয়া রাঁধতেছিলাম। কাইলকা রান্না শেষে পেঁয়াজ রসুইঘরে ছিল। বাইরের থেকে দরজার খিল লাগাইয়া আমি আর আম্মা পুকুর থেইকা গোসল কইরা আইসা দেখি দরজা পুরা খোলা। ভেতরে গিয়া দেখি, হলুদ, মরিচ সব আছে, শুধু পেঁয়াজগুলাই নাই।

বশীর আলী চুপ করে থাকেন। হাঁটতে হাঁটতে নিজের ফলবাগানের দিকে যান। ভারী দেখে একটা লাঠি নেন। এরপর নিজেকে আড়াল করেন, পেয়ারাগাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন।

দূরের থেকে রমিজ, জহির, সবুজ, সুমন, লিপি, কাজল, সজল বলে, কিপটা নানা। কিপটা নানা। আমরা দেখছি আপনে লুকাইয়া আছেন।

বশীর আলী লাঠিটা ফেলে দিয়ে বলেন, পেঁয়াজগুলা কী করছস বল। পেঁয়াজ ফেরত দে। আমি তোগোরে কিছু করুম না।

ছেলেমেয়েগুলো বলে, আমরা চুরি করি নাই। হাছা কইতাছি।

বশীর আলী বলেন, আমি তোগোরে এক পলিথিন পেয়ারা দিমু। আমার পেঁয়াজ ফেরত দে।

রমিজ বলে, আগে পেয়ারা দেন, তারপর পেঁয়াজ দিমু।

বশীর আলী বলেন, তোরা খাড়া আমি আইতাছি। বশীর আলী ঘরে গিয়ে আগের দিন পাড়া কিছু পেয়ারা পলিথিনে করে নিয়ে আসেন। ছেলেমেয়েগুলোকে দিয়ে বলেন, আমার পেঁয়াজ ফেরত দে।

রমিজ কয়েকটা পেঁয়াজ দিয়ে বলে, বাকিগুলো বেইচা ফালাইছি। শুধু এই কয়ডা হাতের থেইকা এইহানে পইড়া গেছিল। আইজকা নিতে আইছি।

বশীর আলী হাতে লাঠি নিয়ে তেড়ে এসে বলেন, হারামজাদা শুধু এই কয়ডা! আমার পেয়ারা ফেরত দে।

রমিজ আর সঙ্গের অন্যরা দৌড়ে পালিয়ে যায়।

বশীর আলী চারটা পেঁয়াজ হাতে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন।
–––

নূর নাজমা: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।