বিদায়বেলার এপিঠ ওপিঠ

প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

প্রথমবারের মতো বিদেশ যাচ্ছি আমি। ঘুরতে নয়। দেশ–পরিবার ছেড়ে বিদেশ যাচ্ছি আরেকটা পারিবারিক বন্ধন তৈরি করার জন্য। দিনটি ছিল কোনো এক বছরের কোনো এক ডিসেম্বর মাসের কোনো এক রাত ১২টা। ফ্লাইট ছিল ১২টা ৪৫–এ। কিন্তু প্রায় দেড় ঘণ্টা ডিলে হয়েছিল আমার ফ্লাইট। তাই সব ফর্মালিটিজ শেষ করে লাউঞ্জে ওয়েট করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ ছিল না।

প্রথমবারের মতো বিমানে চড়ব। সাগর পাড়ি দিয়ে অন্য মহাদেশে ঘরসংসার পাতব। এই উত্তেজনাটা খুব একটা কাজ করছিল না। মাথায় ঘুরছিল মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে বিদায় নেওয়া পরিবার আর বন্ধুদের মুখচ্ছবি।

কবে তাদের দেখব, আবার কবে দেশকে দেখব, সেই অনুভূতিটাই আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আবার এর মানে এ–ও না যে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছি বলে আমার মন খারাপ।

এ এক জটিল অনুভূতি। ভালোবাসার মানুষের কাছে গিয়ে সংসার করব। সে জন্য আরেক ভালোবাসার অংশকে বিদায় দিতে হবে। আমি ব্যক্তিমানুষ যে দুটি নৌকায় পা দিয়ে কূলকিনারার খোঁজে ছন্নছাড়া হচ্ছিলাম, সেই মানসিক বিপর্যস্ত পরিস্থিতি কখনো কাউকে বোঝানো যাবে না।

অলস আমি আমার চারদিকের বিচিত্র ধরনের যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছি আর নিজের কথা ভাবছি। সাধারণত মেয়েদের বিয়ে হয় একবার। বিয়ের পর বিদায় হয় একবার। অতঃপর মেয়েটি তার স্বামীর বাড়িতে সংসার করা শুরু করে। যেমনটি আমি দেখে এসেছিলাম আমারই পরিবারের নিকটাত্মীয়দের মাঝে।

বাপের বাড়ি একই শহরে হোক আর দূরবর্তী শহরে হোক, এক মাস, দুই মাস পরেই কন্যার সঙ্গে তার বাপের বাড়ির লোকদের দেখা-সাক্ষাৎ চলে মোটামুটি। এটা-সেটা অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। দেখা করার বাহানার তো আর শেষ নেই।

আর আমি সংসার করব এমন এক জায়গায়, যেখানে স্বামী ছাড়া আর কেউ নেই। কত শত আচার–অনুষ্ঠান হয়ে যাবে এ দেশে। আমি হয়তো ভিডিও কলে দেখব। হয়তো সময়ের তারতম্যের কারণে দেখবও না। আমারই পরিবারের লোকজন, বন্ধুমহল, যাদের বিয়ে মানেই আমাকে দিয়ে মেহেদি পরানো। তারা বিয়ে করবে, উৎসবের আনন্দে মাতবে আমাকে ছাড়াই।

হয়তো সময়ের নিয়মে কেউ সামান্য সৌজন্যমূলক কুশলবিনিময়ও করবে না একপর্যায়ে। অথচ এই আমি দেশে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত তাদের সঙ্গে গলায় গলা মিলিয়ে ভাগাভাগি করেছি। কী অদ্ভুত! জীবন তবু থেমে থাকবে না।

এমন এক গন্তব্যে আমি যাচ্ছি, আমার বিদায় শুধু বিয়ের দিনই হয়নি, আজ এয়ারপোর্টে এই একটু আগেও আমার একই রকম করে বিদায় নিতে হয়েছে অশ্রুসজল চোখে। ঠিক বিয়ের দিনের মতোই। হয়তো বিয়ের দিন থেকেও আজকে দুঃখের অনুভূতিটার মাত্রা গভীর ছিল।

হঠাৎ আমার মনে হলো, আজ থেকে যতবার আমি দেশে আসব, মা–বাবা-ভাই এবং অন্য প্রিয় মানুষদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্বামীর বাড়ি ফেরার পথে অবিকল একই রকম করে কষ্ট পাব। একইভাবে বিয়ের দিনের বিদায়ের মতো কাঁদব আমি। কাঁদবে আমার প্রিয়জন; বুক ফেটে যাবে, দেখানো যাবে না। কী নির্মম!

লেখিকা
লেখিকা

এসব ওলটপালট চিন্তায় মনে হলো, বিমানে ওঠার আগে পরিবারের সঙ্গে একটু না হয় কথা বলে নিই। আমার কাছে ফোন তো আছেই। ফোন বের করে কল করতে যাব, এমন সময় একটা গোঙানির শব্দ কানে বাজল। আমার ঠিক পাশেই দেখলাম ছোট্ট মতো এক নারী। ফুঁপিয়ে কাঁদছেন; কাঁদছেন তো কাঁদছেনই!

বয়স হয়তো আমার চেয়ে দুই এক বছর কমই হবে। দেখে মনে হলো অপুষ্টি রোগী। শীর্ণকায় দেহ, শতবছরের পুরোনো একটা কালো বোরকা গায়ে। বোরকার বিভিন্ন জায়গায় সাদা রঙের ছাতা বা ছত্রাক পড়ে একাকার। কেউ এভাবে বিদেশ যায়, আমি নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বুঝতে পারতাম না। কারণ, আমি নিজেই প্রথমবারের মতো বিমানবন্দরের ভেতরে বসে আছি। বিমানবন্দরের হরেক রকম মানুষের হরেক রকম গল্প আমার কাছে একেবারেই নতুন।

যা হোক, কৌতূহলবশত তার পায়ের দিকে তাকালাম। বাথরুমে পরে যাওয়ার স্পঞ্জের স্যান্ডেল তার পায়ে। কোলের ওপর ছাতা পড়া কালো রঙের ছোটখাটো একটা ব্যাগ।

আমার বুঝতে বাকি রইল না, সে এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যাচ্ছে কোনো এক শেখ কিংবা অন্য কোনো কারও বাড়িতে কাজ করার জন্য। ভদ্র ভাষায় গৃহকর্মী। আর সোজা বাংলায় গতর খাটা। আমার মতো সেও দেশ–পরিবার আরও না জানি কত কিছু ছেড়ে যাচ্ছে। খুব মায়া হলো আমার।

ধরে নিই তার নাম কুলসুম। কুলসুমের চেহারা দেখলেই তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যে কারওরই মায়া লাগতে বাধ্য।

কুলসুম একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার ফোনের দিকে। আমি একটু আলাপচারিতার চেষ্টা করতেই আমাকে অনেক কথা বলে ফেলল। ভীষণ চিন্তায় আছে সে। সকালে এসেছে বিমানবন্দরে। কখন বিমানে উঠবে আর কখন পৌঁছাবে কিছুই জানে না। গ্রামে মায়ের কাছে রেখে এসেছে ছোট দুই সন্তান। স্বামী বছর কয়েক আগে তাদের ফেলে চলে গিয়েছিল। আর কোনো খোঁজ নেই। দুই সন্তানকে স্কুলে পড়িয়ে শিক্ষিত বানাতে চায় সে। কিন্তু তিনজনের ভাত জোটাতেই কঠিন অবস্থা, সেখানে পড়াশোনা করানো মারাত্মক চাহিদা! অতঃপর বিদেশ গিয়ে দুটো পয়সা বেশি রোজগারের আশায় সন্তানদের রেখে এই দুঃসহ যাত্রা কুলসুমের।

আমাকে অবাক করে দিয়ে জানাল, তার ব্যবহৃত ফোনটা রেখে এসেছে সন্তানের কাছে। কিন্তু সে যে একটু ফোন করে খবর নেবে সেই সুযোগ পাচ্ছে না। ভেবেছিল বিমানবন্দরের ভেতরে কোনো ফোনের দোকান থাকবে। আদৌ আছে কী নেই, সে কিছুই খুঁজে বের করতে পারছে না। কেন জানি না কুলসুমের অসহায়ত্ব মারাত্মক ছুঁয়ে গেল আমাকে।

আমি আমার পরিবারের নম্বরে কল না করে কুলসুমের কাছ থেকে ছোট্ট চিরকুটে লেখা নম্বর কল করে কুলসুমকে দিলাম। কিছুক্ষণ প্রাণভরে সন্তানের সঙ্গে কথা বলুক মেয়েটা। আমি নিশ্চিত, আমার জায়গায় অন্য যে কেউ ঠিক এই কাজটাই করত। আমি কুলসুমকে কথা বলতে দিয়ে ওর দিকেই তাকিয়েছিলাম। মেয়েটার মুখে একটু হাসি দেখতে চেয়েছিলাম।

ওর আঞ্চলিক ভাষাটি আমার জানা ছিল না। তাই সে কী বলল তা আমি বুঝতে পারিনি। আদতে সে তেমন কোনো কথা বলেওনি। শুধু অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। তার সেই বাঁধ ভাঙা কান্না আশপাশের সব যাত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে তারই অজান্তে। লজ্জা লাগছিল আমার। লোকজন আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি একবার ভাবলাম ওকে কথা বলতে দিয়ে কী সমস্যাটাই না বাঁধিয়েছি!

পরক্ষণেই কুলসুম আমাকে আমার ফোন ফেরত দিয়ে দিল। হতবাক আমি ভেবেছিলাম না জানি কত কথা বলবে আর কাঁদবে সে।

অদ্ভুত চোখে দেখলাম মেয়েটার কান্না। কত কথা যে বলে দেয় ওই কান্না! সে জানে না, আবার কবে বাচ্চাদের মুখে মা ডাক শুনবে। সে জানে না, সে কোথায় যাচ্ছে। সে জানে না, সামনের দিনগুলো তার জন্য কতটা বৈচিত্র্যময়। সে যেখানে যাচ্ছে, সেখানে আপন বলতে কেউ নেই তার। সে এ–ও জানে না, অচেনা দেশে অজানা ভাষাভাষীর সন্নিকটে হঠাৎ কোনো বিপদে পড়লে কার কাছে সাহায্য চাইবে। গৃহকর্মী বা দাসী যেটাই বলি না কেন, আমরা সবাই জানি, তাদের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। তারা বিদেশ পাড়ি জমায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তিতে। ওই নির্দিষ্ট চুক্তির সময়টুকুতে তারা হারিয়ে ফেলে নিজেদের ব্যক্তিসত্তা।

সর্বোপরি দুটো বিদেশি মুদ্রা উপার্জনের আশায় কুলসুম এমন কাঁটায় পা দিতে যাচ্ছে, যেখান থেকে জীবিত কিংবা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসতে পারবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তরও তার অজানা। তবু সে যাচ্ছে, বুকে পাথরচাপা দিয়ে কেবল কান্না আটকাতে পারছে না। ওই কান্নাটুকুই হয়তো একলা চলার পথে কুলসুমদের সম্বল। কুলসুমরা যুগে যুগে এভাবেই অসহায়ত্ব বরণ করে গৃহকর্মীর তকমা গায়ে লাগিয়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে।

হঠাৎ আমার মনোযোগ কেড়ে নিল ঘোষণা। আমার ফ্লাইট নম্বর ঘোষিত হচ্ছে। সারিবদ্ধভাবে বিমানে গমন করব ওই ফ্লাইটের যাত্রীরা। সময় হয়ে এসেছে। আমি গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। কুলসুমকে বিদায় বলা হয়নি আমার। আসলে এই মানুষগুলোকে বিদায় বলার কিছু নেই। তাদের জীবনের চিত্রগুলো অনেকাংশে তিক্ততায় পূর্ণ। নিজের বিদায়মুহূর্তে আমার মনের ভেতরে যে ছটফট ভাব ছিল। কুলসুম যেন তার অসহায় অবস্থা থেকে আমায় একরাশ শক্তি দিল।

বিমান উড়াল দিচ্ছে আমার। আমি দেশ, পরিবার, বন্ধুদের রেখে বিশেষ একজন ভালোবাসার মানুষের উদ্দেশে উড়াল দিচ্ছি আর কুলসুম নামক হতভাগ্যদের কথা ভাবছি। তারাও আমার মতো উড়াল দিচ্ছে। কিন্তু তাদের যাত্রা উদ্দেশ্যহীন ও ভালোবাসাহীন। কী প্রচণ্ড মানসিক শক্তি থাকলে এই কঠিন যাত্রায় অগ্রসর হতে পারে মানুষ। এসব কুলসুমের চোখে আমি তাকানোর সাহস পাই না। হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আমার।

আমি জানি না, কুলসুম নিজ দেশে ফিরে যেতে পেরেছে কি না। কিন্তু এখন যখনই প্রবাসী গৃহকর্মীদের দুঃসহ বেদনাময় কোনো খবর পত্রিকায় চোখে পড়ে, আমি কল্পনায় কুলসুমকে দেখতে পাই। বিদায়মুহূর্তে কুলসুমের চোখে আমি যে অসহায়ত্ব দেখেছি, তা আমার অন্তরকে পুড়িয়ে মারে। পোড়া হৃদয়ে প্রার্থনা করি সুস্থভাবে উপার্জন করে ফিরে আসুক প্রতিটা কুলসুম তার দেশ ও পরিবারের কাছে।