হঠাৎ অস্থিতিশীল বাজারের দায় কার

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের একটি অন্যতম কাজ। স্থিতিশীল বাজার সব সময় চ্যালেঞ্জের। জনগণের জন্য দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে বাজার অস্থিতিশীল হয়। সম্প্রতি পেঁয়াজসংকটে বাংলাদেশের বাজারে একরকমের অস্থিরতা আমরা দেখেছি।

বাজারের স্থিতিশীলতা জনগণের আর্থিক সক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। আয় বেশি হলে বেশি দাম দিয়ে দ্রব্য কিনতে মানুষের অসুবিধা হয় না। কিন্তু ব্যয় যখন আয়ের চেয়ে অনেক বেশি হয়, তখন মানুষের মধ্যে একরকমের হতাশা দেখা যায়। মানুষ বাজারের জিনিসপত্র কিনতে পারে না। আবার একটি আদর্শ মানের রোজগার থাকার পরও মানুষ অনেক সময় জিনিসপত্র কিনতে পারে না। জিনিসপত্রের সরবরাহ কমে গেলে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে বাজারের দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। এর ফলে একধরনের সাময়িক অস্থিতিশীলতা দেখা যায়।

পেঁয়াজ নিয়ে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে অস্থিতিশীল এক অবস্থায় পড়েছে। আকাশছোঁয়া দামের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে পেঁয়াজের বাজার।

কিন্তু হঠাৎ করে কেন এ রকম পেঁয়াজসংকট তৈরি হলো? আর এবারই কি প্রথম এ রকম কোনো সংকট তৈরি হলো? আমরা যদি অতীত পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখি প্রায়ই বাংলাদেশে নানা দ্রব্যে এ রকম সাময়িক সংকট তৈরি হয়। কিন্তু কেন? সরকার কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খায়?

এবার যখন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিল, তখনই অনুমেয় ছিল বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বাড়তে পারে। আমরা যেহেতু ভারতের কাছ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করি, সেহেতু এটা ভাবা অমূলক নয়। এটা নিশ্চয়ই সরকারও জানত। আর যদি সরকার এটা না জানে, তবে এটা সরকারের অদূরদর্শিতা।

ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর সরকারের হয়তো ধারণা ছিল বাংলাদেশে পেঁয়াজের যথেষ্ট মজুত আছে। আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছ থেকেও এ রকম আশার বাণী শুনেছি। কিন্তু সরকারের ধারণা ও আশ্বাসের সঙ্গে বাজারের বাস্তব চিত্র পুরোপুরি বিপরীত। পেঁয়াজের দাম বেড়েছে রকেট গতিতে।

সরকারের ধারণা, একধরনের অসৎ ব্যবসায়ীর কারণে এ রকম সংকট তৈরি হয়েছে। হ্যাঁ, পরে টন টন পচা পেঁয়াজ আবিষ্কার এ ধারণা সত্যি করেছে। কিন্তু এই অসৎ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের কাজ। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর নেওয়া ও পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করা। অসৎ ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে আগে থেকেই গুদাম থেকে বাজার পর্যন্ত পেঁয়াজ সরবরাহ নিশ্চিত করলে এ রকম সংকট তৈরি হতো না।

পেঁয়াজসংকটের মধ্যেই জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে লবণের মূল্যবৃদ্ধির কথা। সরকার বারবার বলতে চাইছে, লবণের কোনো সংকট নেই। কিন্তু জনগণ আশ্বস্ত হতে পারছে বলে মনে হয় না। যেহেতু আগেরবার দায়িত্বশীল মন্ত্রীর আশ্বাসের পরও পেঁয়াজ নিয়ে মানুষ ভুগেছে, সেহেতু সরকারের আশ্বাসে মানুষ নিশ্চিত হতে পারছে না।

বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সব সময় কঠিন কাজ বলে আমরা জানি। কিন্তু সরকারের কাজ হলো সেই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করা। সরকারের চেয়ে বেশি শক্তি আর কারও তো নেই। সরকার চাইলেই অসৎ ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে পারে।

অসৎ ব্যবসায়ীরা যুগে যুগে ছিল। আর এখন এ রকম অসৎ ব্যবসায়ী তো বাংলাদেশে ভরা। আমরা এদের শেয়ারবাজারে দেখেছি, আমরা এদের ব্যাংকে দেখেছি। কিন্তু তারা কি আসলেই বিচারের আওতায় এসেছে? যারা অন্যায় করে টাকার পাহাড় গড়ে, তাদের বিচার করতে না পারলে এই সংকট চলতেই থাকবে। আজ পেঁয়াজ-লবণ, কাল হয়তো অন্য কিছু।

বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে মোবাইল কোর্টের ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। প্রতিনিয়ত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা শাস্তি পাচ্ছে। বড় ব্যবসায়ী থেকে মাঠপর্যায়ের ব্যবসায়ীরা শাস্তি পাচ্ছে। যার কারণে ব্যবসায়ীদের একটা গ্রুপ সরকারের প্রতিপক্ষ হয়তো হচ্ছে। যাদের কারণে এ রকম সংকট তৈরি হতে পারে।

তবে আমার কাছে মোবাইল কোর্টের লাগামহীন ব্যবহারের চেয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দরকার সব সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। আমাদের দরকার কোনো দ্রব্যে ভেজাল থাকলে তা তুলে নিয়ে সঠিক মান নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা। জেল-জরিমানা করার চেয়ে দ্রব্যের মানোন্নয়নে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সব সময় পার্টনারশিপ ডায়ালগ দরকার।

বিদেশে ব্যবসা করতে হলে সরকারের কাছ থেকে প্রতিটি দ্রব্যের জন্য সার্টিফিকেট নিতে হয়। আমাদেরও বিএসটিআই আছে। যদি মোবাইল কোর্টকে এত দায়িত্ব নিতে হয়, তাহলে তাদের কাজ কী? বিএসটিআইকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তারা যখন কোনো দ্রব্যের সার্টিফিকেট প্রদান করে, তা যেন জনগণ বিশ্বাস করে।

বাংলাদেশে যত বাজার সংকট তৈরি হয়, তার বেশির ভাগ অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে। কিন্তু কেন এই ব্যবসায়ীরা বারবার সিন্ডিকেট করার সুযোগ পাচ্ছে, তা বিশদ পর্যালোচনা করে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের সমস্যা হলো, যখন সমস্যা তৈরি হয়, তখন আমরা সাময়িকভাবে সমাধানের চেষ্টা করি। একটি স্থিতিশীল বাজার তৈরি করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিকল্প নেই।

ড. মো. ফজলুল করিম: পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।