'সে আমার ছোট বোন'

বোনের সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখক
বোনের সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখক

আমরা তিন ভাই মোটামুটি পিঠাপিঠি। সেই তুলনায় একমাত্র বোনটি বেশ ছোট। বোনের জন্মদিন ভুলে যাওয়ার সুযোগ আসলে কম। মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পরদিন তার জন্ম। পরপর তিন ছেলের পর একটি মেয়ে হওয়ায় মা-বাবা দুজনেই ছিলেন বেশ আনন্দিত।

আমার বয়স তখন আট বছর। অত বেশি স্মৃতি তখনকার সময়ের নেই। তবে বোনের জন্মমুহূর্তে আমরা তিন ভাই বাইরে খেলতে গিয়েছিলাম। জন্মের বিষয়টি তখন আমাদের বুঝে আসেনি। আমাদের বাসায় একজন ধাই এসেছিলেন। আমার কোনো এক খালা বললেন, তোরা বাইরে খেলতে যা।

আমাদের তিন ভাইয়ের বেশ খিদে লেগেছিল। কিন্তু কারও কোনো খেয়াল আমাদের দিকে ছিল না।

আমাদের বাসায় ছোট্ট একটা আলমারি ছিল। সেটি তালা দেওয়া থাকত। আমার ছোট হাত ওর ভেতর ঢুকিয়ে টুকটাক কিছু বের করতে পারতাম। হঠাৎ আলমারির গ্লাসের ভেতর দেখি একটা বাটিতে তিনটা দশ পয়সার কয়েন। আমি দরজা ফাঁক করে হাত দিয়ে সেই কয়েন তিনটা নিলাম। এরপর তিন ভাই আনন্দে লাফাতে লাফাতে বাইরে যাই।

আমার ভালো মনে আছে, ওই ত্রিশ পয়সা দিয়ে আমরা তিন ভাই তিনটা আইসক্রিম ও তিনটা চকলেট কিনে খেয়েছিলাম!

ছোটদের বড়রা নানান বুঝ দেন। আমরাও বুঝ পেলাম, আল্লাহ আমাদের একটি বোন দিয়েছেন। শুরু হলো বোনকে আমাদের দেখভাল করার পালা। আম্মা ওকে বাটি থেকে চামচ দিয়ে তুলে তুলে দুধ খাওয়াতেন। আমাদের কাজ ছিল তার হাত-পা ধরে রাখা। যাতে সে দুধের বাটি ফেলে দিতে না পারে।

ওই দুধ খাওয়ার মুহূর্তে বোনটি যে কান্না করত, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করানো কঠিন। আম্মা দুধসহ চামচ ওর মুখের ভেতর ঢেলে চামচ বের করে ফেলতেন না সঙ্গে সঙ্গে। যেন সে দুধ ফেলে দিতে না পারে, তাই ওই ব্যবস্থা। এত কিছুর পরও কীভাবে যেন সে দুধ ফেলে দিতে পারত।

প্রতিদিন বোনের এই কান্না দেখে আমার এমন রাগ লাগত! মনে হতো মাকে মারি। এখন আমাদের সব ভাইয়ের আলাদা সংসার হয়েছে। ছেলেমেয়ে হয়েছে। বোনটি বড় হয়েছে। কিন্তু কী এক বিশেষ কারণে এই অধম বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে না।

বোনটি আমার খুব বেশি নেওটা ছিল। তার জগৎ ছিল বড়দাময়। অন্য দুই ভাইয়ের সঙ্গেও তার খাতির ছিল। মা-বাবার চেয়েও ভাইবোনের সম্পর্ক অনেক বেশি মধুর হয়। এটা সব পরিবারের জন্য সত্যি। সব মধুরতা নষ্ট হয়ে যায় সবাই বড় হয়ে গেলে।

বোনের স্বপ্ন ছিল সারা জীবন আমার সঙ্গে থাকবে। এমন দাবি করে সে প্রায়ই কথাটা বলত। প্রতিবারই এ কথা আমাকে খুব টাচ করত। আমি হতভাগা একমাত্র বোনটিকে নিজের কাছে রাখতে পারিনি। কেন পারিনি, এটা বর্ণনা করার বোধ হয় প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের হাজার হাজার পরিবারের ছবি এ রকমই। আমি শিওর যাদের অন্তত একটি বোন আছে, তারা ঠিকই বুঝবেন আমি কী বলতে চাইছি? বর্ণনা করে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে চাই না।

মজার ব্যাপার হলো, আট বছরের ছোট হলেও বোনটি মানসিকভাবে বড় হয়েছে আমার আগে। সম্ভবত প্রাকৃতিক কারণেই মেয়েরা আগে বুঝদার হয়। এমন কোনো আবদার নেই যা সে আমার কাছে করত না।

আমার প্রবাসজীবনের শুরু ১৯৯৭ সালে। এখনো আমার সংগ্রহে পাঁচ শর বেশি বই আছে। সবাই দেশ থেকে খাবার, কাপড়, শোপিস এসব আনেন। আমি আনি বই। আর এই বই কিনে কিনে পাঠিয়েছে আমার বোন।

একবার এক ভদ্রলোক দেশ থেকে আমার ছোট একটা পার্সেল নিয়ে এসেছিলেন। পার্সেলের মুখ খুলতেই উঁকি দিল বই। সে কী রাগ ওই ভদ্রলোকের। কেন তাকে দিয়ে বইয়ের বোঝা বওয়ালাম। এর উত্তর আমি দিতে পারিনি। উত্তর নেই তো আসলে।

চোখের আড়াল আসলেই মানুষের ওপর অনেক প্রভাব ফেলে। জীবন গোছাতে গিয়ে আমার নিজের যা কিছু সুকুমারবৃত্তি ছিল তার সব নষ্ট হয়ে গেছে। কী চমৎকার স্বপ্নই না ছিল জীবন নিয়ে। প্রবাসজীবন আমার মতো এ রকম হাজারো মানুষের স্বপ্নের মৃত্যু কারণ। কঠিন বাস্তবতায় প্রিয়জনকে দূরে ফেলেই রাখতে হয়। এ যেন নিয়তি!

বোনটা আমার নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। আমাদের সম্মতি নিয়েই। কিন্তু সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আমি নিষেধ করেছিলাম। সুন্দর ছেলেরা বেশির ভাগ ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়। বোন শুনল না। প্রেমের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে উভয়েই মিথ্যা বলে থাকে। সত্যি কথায় প্রেম হয় না। তাদের বড় সংঘাত ছিল ব্যক্তিত্বের।

আমার বোন যে ছেলেকে বিয়ে করেছিল, সে বছর তিনেকের মধ্যে বিদেশে গিয়ে আমার বোনকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিল। এ রকম ভদ্র চিট সচরাচর দেখা যায় না। আমার বোনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ সব সে বিদেশে যাওয়ার পর করেছে। আমি তাকে বলেছিলাম যে অভিযোগ করছ সেই অভিযোগ তোমার বাবাও তোমার মায়ের বিরুদ্ধে হরহামেশাই করে বলে আমার ধারণা। ছেলেটি খুব সুন্দর করে আলাদা হয়ে গেল।

এরপর কত চেষ্টা করলাম, বোনটি আর বিয়ে করতে রাজি হলো না। সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু গুলে খাওয়া বোন আমার হঠাৎ প্রচণ্ড ধার্মিক হয়ে গেল। এখন সে ‘বারো চাঁদের ফজিলত’ বই পড়ে। মাসের পনেরো দিন রোজা রাখে। তার এই পরিবর্তন আমার বুকে শেলের মতো বিঁধছে। এসব করে নাকি সে তার চলে যাওয়া স্বামীকে ফেরত আনবে।

এ রকম কথা কেউ কোনো দিন শুনেছে? অতি আধুনিক একটা মেয়ে যে এ রকম হতে পারে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবেন না। ধর্মীয় আচার পালন করা এক জিনিস আর গোঁড়ামি একেবারে ভিন্ন কিছু।

ভাইদের সীমাবদ্ধতা ছিল বলেই তার সংসারটা জোড়া দিয়ে দিতে পারেনি। সে নিজেও জানে না তার ভাইয়েরা তার জন্য গোপনে চোখের পানি ফেলে।

বোন বলে, বুড়ো বয়সে ফিরে এলেও নাকি সে তার স্বামীকে গ্রহণ করবে। গোঁড়ামি একটা মানুষকে কোন অন্ধকারে নিয়ে যায়, তা আমার চোখের সামনে উপস্থিত। একজন অপারগ বড় ভাইয়ের ছবি কেউ দেখতে চাইলে আমাকে দেখলেই চলবে। মাঝেমধ্যে মান্না দের ‘সে আমার ছোট বোন’ গানটি শুনি আর চোখের জলে ভাসি। আমি ফোন দিলেও ফোন ধরে না। তবু শুভ জন্মদিন রে, পাগলি বোন আমার।