মিশিগান বেঙ্গলসের জমজমাট পুরস্কার বিতরণী

অনুষ্ঠানে সিতারা বেগমকে সম্মাননা স্মারক ক্রেস্ট দেওয়া হয়। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রাপ্ত
অনুষ্ঠানে সিতারা বেগমকে সম্মাননা স্মারক ক্রেস্ট দেওয়া হয়। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রাপ্ত

‘রক্ত লাল’ গানের আবহ সুর ভেসে আসছিল মিলনায়তনের স্পিকার থেকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পদকপ্রাপ্ত একমাত্র জীবিত নারী মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) ডা. সিতারা বেগম ও তাঁর স্বামী চিকিৎসক ও মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম আবিদুর রহমান যখন মঞ্চে উঠছিলেন, তখন মিলনায়তনের কয়েক শ দর্শক দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। মঞ্চে তাঁদের ঘিরে রেখেছিল মিশিগান বেঙ্গলসের পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশু-কিশোরেরা।

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের বেভারলি হিলস শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশি আমেরিকানদের ক্রীড়া সংগঠন মিশিগান বেঙ্গলসের ব্যতিক্রমী বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।

গত রোববার (১৭ নভেম্বর) স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় শহরের গ্রোভ হাইস্কুল মিলনায়তনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ছিল বার্ষিক নৈশভোজ, গালা নাইট ও অ্যাওয়ার্ড বিতরণ। জমকালো এই অনুষ্ঠানে মিশিগান ছাড়াও ওহাইও রাজ্য ও কানাডা থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সিতারা বেগম ও এম আবিদুর রহমানকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে মিশিগান বেঙ্গলস। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ভাই লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে নিহত হলে সিতারা বেগম ও তাঁর পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। পরে মিশিগান অঙ্গরাজ্যে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেন।

মুক্তিযোদ্ধা দম্পতিকে লাল-সবুজ উত্তরীয় পরিয়ে দেয় এলিশা ভূঁইয়া ও রায়া সিরাজ। এ ছাড়া সিতারা বেগমকে সম্মাননা স্মারক ক্রেস্ট তুলে দেন সাইদ ফয়সাল ও রসি মীর। এরপর সিতারা বেগমের সাহসিকতার ওপর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেন শ্রেয়া হাসান। আবিদুর রহমান ও সিতারা বেগম সবার উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। এ সময় শ্রোতাদের অনেকেই চোখ মুছছিলেন।

এ বছর মিশিগান বেঙ্গলস ক্লাব প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে ক্রিকেট, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস ও দাবা টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। এতে কয়েক শ বাংলাদেশি অংশ নেন। এ ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশি আমেরিকান শিশুদের জন্য তিন মাসব্যাপী ফুটবল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ২০১৯ সালের জন্য ক্লাবের সফল খেলোয়াড়দের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

বক্তব্য দিচ্ছেন সিতারা বেগম। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রাপ্ত
বক্তব্য দিচ্ছেন সিতারা বেগম। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রাপ্ত

আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন মিশিগান বেঙ্গলসের কর্মকর্তারাসহ স্পনসর ও কমিউনিটির নেতারা। প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশি আমেরিকান চিকিৎসক ও কমিউনিটি নেতা ড. দেবাশীষ মৃধা। অনুষ্ঠানে তাঁকে ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক ও সমাজসেবক হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়। সব আয়োজনে নেতৃত্বের জন্য ক্লাবের পক্ষ থেকে রসি মীরকে সেরা সংগঠকের পুরস্কার দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুতে মিশিগান বেঙ্গলসের কার্যকরী কমিটি ও উপদেষ্টা কমিটিকে পরিচয় করিয়ে দেন উপদেষ্টা সাইদ ফয়সাল। কমিটির উপদেষ্টারা হলেন গোলাম মোস্তফা, মাহবুব চৌধুরী, ফরিদ চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহিন ইসলাম ও আবেদুর রাসুল। কার্যকরী কমিটির সদস্যরা হলেন সাইফ সিদ্দিকী, কৌশিক আহমেদ, মোহাম্মদ আলমগীর হোসাইন, মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন আজিজ, মারুফ মনওয়ার ও রসি মীর।

পুরস্কার বিতরণের পাশাপাশি নাচ-গানে জমজমাট ছিল অনুষ্ঠান। নৃত্য পরিবেশন করে ছোট্ট বন্ধু মঞ্জুরি, শায়রিন, তাজরী, রিদিতা, শ্রেয়া, রায়া, এলিশা ও রায়া। গান পরিবেশন করে শিশুশিল্পী অমিতা মৃধা, নাশিতা আজিজ ও জারা আনোয়ার।

শচীন দেববর্মনের গান ‘ঝিলমিল ঝিল’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন এমি ইসলাম, সুমাইয়া শাম্মা, শারমিন তানিম ও সানজিদা বন্যা। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন ফারজানা সানিয়া, সহেলী ও নাফিসা। জনপ্রিয় গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন রসি-শারমিন জুটি।

জেমসের ‘মা’ ও মাহিনের ‘ঘোড়াগুলো পৃথিবীটা নাকি’ গান দুটি পরিবেশন করেন শাফকাত রহমান। পাশাপাশি তৃণা বড়ুয়ার লালন ব্যান্ডের গান ‘গুরুর চরণ’, শিমুল ইউসুফের শাহনাজ রহমতুল্লাহর জনপ্রিয় গান ‘সাগরের তীর থেকে’ অতিথিদের মুগ্ধ করে। দ্বৈত সংগীত পরিবেশন করেন মোহাম্মদ নাজমুল আনোয়ার-এনী জুটি ও জাফরি-নিলুফা আক্তার জুটি। অনুষ্ঠানে অতিথি শিল্পী ছিলেন আরশিত, প্রিয়া ও অরবিন্দ। তাঁদের গলায় জনপ্রিয় কিছু গান দর্শকদের মন জয় করে।

ইংরেজি জনপ্রিয় ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের সঙ্গে ব্যতিক্রমী এক নাচ উপহার দেয় ছোট্ট বন্ধু রিহান, আতিফ, আরিয়ান, শাম্মা, শারমিন, বন্যা ও এমি। কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন এমি ইসলাম। ‘বিয়াইন সাব’ গানের সঙ্গে নৃত্য নিয়ে আসেন রসি, মারুফ, সাফী, রাদিয়া, শারমিন ও পুলক। মিশিগান বেঙ্গলসের ২০১৯ সালের কার্যক্রম নিয়ে আবির হাসানের নির্মিত ডকুমেন্টারি সবাইকে মুগ্ধ করে।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রাপ্ত
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রাপ্ত

অনুষ্ঠানে দেবাশীষ মৃধা বলেন, ‘মিশিগানে বাংলাদেশি কমিউনিটির এই আয়োজনের সঙ্গে থাকতে পেরে আমি আনন্দিত।’ বিভিন্ন পেশা ও বয়সের বাংলাদেশিদের একত্র করার জন্য তিনি আয়োজকদের ধন্যবাদ দেন। সেই সঙ্গে খেলাধুলার জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে কমিউনিটি একত্র করার কাজ করতে হবে বলে তিনি জানান।

উপস্থাপনায় ছিলেন পপি দাস ও উবেদা সাহিরা। পরিচালনায় ছিলেন রসি মীর, কৌশিক আহমেদ ও সাইফ সিদ্দিকী। ক্যামেরায় ছিলেন রুবু রহমান।

ক্রিকেটে এ বছর চ্যাম্পিয়ন হয় বেঙ্গল স্পার্টান্স। রানার্সআপ হয় মিশিগান বেঙ্গল হিরোস। সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন সামী শোকরানা। সেরা ব্যাটসম্যান তারেক খান ও সেরা বোলার হন সামী শোকরানা।

ভলিবল টুর্নামেন্টে মিশিগান বেঙ্গল ওয়ারিয়র্স চ্যাম্পিয়ন ও ব্লক অ্যান্ড রোল রানার্সআপ হয়।

দাবায় চ্যাম্পিয়ন হন ড. সাইদ আশরাফ, রানার্সআপ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন আজিজ, সেকেন্ড রানার্সআপ এহতেশাম রাব্বি।

টেবিল টেনিসে এককে চ্যাম্পিয়ন মারুফ মনওয়ার। রানার্সআপ মোহাম্মদ আলমগীর হোসাইন। দ্বৈত বিভাগে চ্যাম্পিয়ন সালাহউদ্দিন আজিজ ও মারুফ মনওয়ার। রানার্সআপ শাহিন ইসলাম ও আলমগীর হোসাইন।

পুরস্কার বিতরণী। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রাপ্ত
পুরস্কার বিতরণী। ছবি: সাইফুল আজম সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রাপ্ত

ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হন কৌশিক আহমেদ ও মারুফ মনওয়ার এবং রানার্সআপ হন সাইদ আশরাফ ও আলমগীর হোসাইন।

সবাইকে পুরস্কৃত করা হয়। পুরস্কার বিতরণী ও মঞ্চে সহযোগিতা করেন কৌশিক, রসি, পুলক, মারুফ ফিরোজ, মাহবুব ও সাইদ আশরাফ।

অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল মৃধা ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্পনসর করেছে জেনারেল মোটরস এশিয়ান কানেকশন, এআরজি গ্রুপ, এলিমেন্টারি ল্যান্ডিং, বেঙ্গলস অটো সেলস, এসসি রিয়েল এস্টেট, হোম সোর্স রিয়েলিটি ও অয়ারেন ফার্মেসি। অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার ছিল সিনে বাক্স।