লন্ডনে চলছে মাসব্যাপী নাট্যোৎসব

‘নেমেসিস-২’-এর একটি দৃশ্য । ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত
‘নেমেসিস-২’-এর একটি দৃশ্য । ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত

বাংলা সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়ে প্রতিবছরের মতো এবারও লন্ডনে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী বাংলা নাট্যোৎসব। এবারের উৎসবের প্রতিপাদ্য বিষয় রাখা হয়েছে—সন্ত্রাসবাদ, অভিবাসন ও পরিবেশ সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো।


১ নভেম্বর শুরু হওয়া এই উৎসব চলবে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত। নাটকের পাশাপাশি আরও চলছে চিত্র প্রদর্শনী, আলোচনা ও ওয়ার্কশপ। নাট্যোৎসবের উদ্বোধন করেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের লিড অ্যান্ড কালচারাল মেম্বার কাউন্সিলর সাবরিনা আকতার।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব, সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর। তিনি আয়োজকদের প্রশংসা করে বলেন, ‘এখানকার উৎসবের আয়োজন দেখে আমি অভিভূত। বাংলাদেশেও এ ধরনের মাসব্যাপী নাট্যোৎসব আয়োজন করা কষ্টসাধ্য।’

আসাদুজ্জামান নূর আরও বলেন, ‘সাধারণত নাটকে মানুষের দুর্দশাগুলোই প্রস্ফুটিত হয়। আমি চাই সারা বিশ্বের মানুষের দুঃখ দূর হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।’

টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আর্টস ডেভেলপমেন্ট অফিসার ও নাট্যোৎসবের কো-অর্ডিনেটর কাজী রোকসানা বেগমের পরিচালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ হাইকমিশনের মিনিস্টার (প্রেস) আশিকুন নবী চৌধুরী, কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির ড্রামা বিভাগের আলী ক্যাম্পবেল, লাফবারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইগ্র্যান্ট মেমোরি অ্যান্ড পোস্ট কলোনিয়াল ইমিগ্রান্টস প্রজেক্টের পরিচালক এমিলি।

একঝাঁক তরুণ-তরুণীর পরিবেশনায় পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্ট সেন্টারে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ইয়ুথ আর্টস ডিভিশন ‘এ টিম আর্টস’-এর প্রযোজনায় ‘নেমেসিস-২’ -এর মঞ্চায়নের মাধ্যমে শুরু হয়েছে নাট্যোৎসব।

ড. জেনান সালেহ ও তাসমিয়া তাহিয়ার লেখা নাটকটি সিরিয়া ও ইরাকে হামলা, ব্রিটেনে সন্ত্রাসী হামলা এবং পূর্ব লন্ডনের স্কুলছাত্রী বহুল আলোচিত শামীমা বেগমের সিরিয়ায় যাওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে তরুণদের মগজ ধোলাই ও পরবর্তী সময়ে তাঁদের সঠিক উপলব্ধিতে ফিরে আসার কাহিনি নিয়ে। নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন ড. জেনান সালেহ।

উদ্বোধনী দিনে ব্রাডি আর্টস সেন্টারে চিত্র প্রদর্শনীও শুরু হয়। এই চিত্র প্রদর্শনী চলবে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত। মুক্ত আর্টসের আয়োজনে ‘ত্রিবেনী—দ্য রিদম অব ওয়াটার’ শীর্ষক এই প্রদর্শনীতে বেশ কিছু চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। চিত্রশিল্পী মণি মুক্তা চক্রবর্তীর ৪০টি চিত্র নিয়ে একক চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন আসাদুজ্জামান নূর।

ছান্দসিকের পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত
ছান্দসিকের পরিবেশনার একটি দৃশ্য। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত

ব্রাডি আর্টস সেন্টারে ২ নভেম্বর বিকেল চারটায় অনুষ্ঠিত হয়েছে আসাদুজ্জামান নূর ও বিলেতের স্বনামধন্য অভিনেত্রী লিসা গাজীর আলাপচারিতা।

দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের উদ্যোগে একটানা উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে ‘আ সিজন অব বাংলা ড্রামা’। ২ নভেম্বর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রযোজিত সাংবাদিক বুলবুল হাসানের রচনা ও সায়েদা সায়েমা আহমেদের নির্দেশনায় নাটক ‘ডিসটোপিয়া’ মঞ্চস্থ হয়। ব্রাডি আর্টস সেন্টারে হলভর্তি দর্শক সমাগমে নন্দিত হয়েছে ‘ডিসটোপিয়া’।

মিয়ানমার থেকে শরণার্থী হয়ে আসা নাফ নদীতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এক কিশোরীর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প নিয়ে রচিত হয়েছে ‘ডিসটোপিয়া’। সংবাদপত্রে বা টিভিতে যাঁরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতার খবর পড়েছেন, দেখে শিহরিত হয়েছেন, এই নাটকে দেখে মনে হচ্ছিল চোখের সামনেই ঘটনাগুলো ঘটছে।

এক কিশোরীর মনস্তাত্ত্বিক সংকটকেই নাট্যকার মূলত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নাফ নদীতে গন্তব্যহীন নৌকা ভেসে চলছে, নারী পাচারকারী দালালের খপ্পর, খাবার নেই, ক্ষুধার জ্বালা, অসুস্থ বাবা, এত কিছুর পরও কিশোরী ফাহমিদা ভেঙে পড়েনি। ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে, সহযাত্রীদের মনোবল চাঙা করার আকুতি অব্যাহত রেখেছে। সহায়সম্বল সবকিছু হারানোর পরও বই সঙ্গে নিয়ে এসেছে ফাহমিদা। জ্ঞানচর্চায় তার প্রবল আগ্রহ।

নাটক শেষে ইশিতা আজাদের পরিচালনায় দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন নাট্যকার বুলবুল হাসান ও নির্দেশক সায়েমা আহমেদ।

‘ডিসটোপিয়া’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত
‘ডিসটোপিয়া’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত

৩ নভেম্বর প্রদর্শিত হয়েছে দুটি নাটক। পপলার ইউনিয়নে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নাটক ‘একটি অবাস্তব গল্প’। বিমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে রফিকুল হকের পরিচালনায়। একই দিনে একই সময়ে ব্রাডি আর্টস সেন্টারে মঞ্চ শৈলীর উদ্যোগে মঞ্চায়িত হয়েছে মনোজ মিত্রের লেখা ‘মেষ ও রাক্ষস’।

মহিলা অঙ্গনের উদ্যোগে ব্রাডি আর্টস সেন্টারে ৫ নভেম্বর বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ছিল ‘শাড়ি ডে’। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ‘জার্নালিজম ইথিকস ও স্ট্যান্ডার্ড’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

ডেইলি স্টার-এর আনন্দধারার এবং স্টার শোবিজের রাফি হোসেন কীভাবে থিয়েটার অ্যাকটিভিস্ট হলেন, সেই ইতিহাস বর্ণনা করেছেন ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে।

সোহায়া ভিশনের প্রযোজনায় রমিন্দর খায়েরের লেখা ও মুকুল আহমেদের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে ‘টেরর’ ৭ ও ৮ নভেম্বর কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির পিন্টার স্টুডিওতে।

ছান্দসিকের সদস্যরা। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত
ছান্দসিকের সদস্যরা। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত

ব্রাডি আর্টস সেন্টারে ৮ নভেম্বর আমরা থিয়েটার গ্রুপের পরিবেশনা এবং সাঈদা তাসমিয়ার লেখা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে ‘হোস্টাইল এনভায়রনমেন্ট’।

বক্তব্য দিচ্ছেন ইসহাক কাজল। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত
বক্তব্য দিচ্ছেন ইসহাক কাজল। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত

বাংলাদেশের প্রয়াত বিশিষ্ট নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুনের লেখা ও রুবায়েত শারমীনের নির্দেশনায় চারণের পরিবেশনায় ব্রাডি আর্ট সেন্টারে ৯ নভেম্বর মঞ্চস্থ হয়েছে ‘কোকিলারা’। কবি নজরুল সেন্টারে ৯ নভেম্বর সুর তাল পরিবেশন করেছে ‘মিউজিক—মন কা সংগীত’। দেবাশীষ ব্যানার্জির লেখা ও নির্দেশনায় ইস্টার্ন থেসপিয়ানস ৯ ও ১০ নভেম্বর কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির পিন্টার স্টুডিওতে পরিবেশন করেছে ‘এ ওয়েক’।

মেসেজ কালচারাল গ্রুপ পরিবেশন করেছে মুহিব চৌধুরীর লেখা ও নির্দেশনায় এবং গুলজার আহমেদের পরিচালনায় নাটক ‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড’। স্বাধীনতা ট্রাস্টের উদ্যোগে ১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে পূর্ব লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস বর্ণনা ‘বেঙ্গলি হিস্ট্রি ওয়াক’।

ব্রাডি আর্টস সেন্টারে কৌশিক চক্রবর্তী ও রঞ্জন ব্যানার্জির লেখা ‘প্রেরণা’ পরিবেশন করেছে বেঙ্গল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। এসেক্স ইন্ডিয়ানসের পরিবেশনায় ড. অর্পিতা রায়ের লেখা ও নির্দেশনায় ব্রাডি আর্টস সেন্টারে ১৬ নভেম্বর মঞ্চায়িত হয়েছে ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’। একই দিনে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির গ্রেট হলে আইএমডি অ্যান্ড বলি ফ্লেক্স পরিবেশন করেছে ‘ইস্ট সাইড স্টোরি’।

বক্তব্য দিচ্ছেন আবু মুসা হাসান। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত
বক্তব্য দিচ্ছেন আবু মুসা হাসান। ছবি: নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের মাধ্যমে প্রাপ্ত

১৬ নভেম্বর পূর্ব লন্ডনের কবি নজরুল সেন্টারে টাওয়ার হ্যামলেটসের সিজন অব বাংলা ড্রামার আয়োজনে ছান্দসিক পরিবেশন করেছে ‘জেনোসাইড ইন টি এস্টেটস ইন নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু বছর ধরে গবেষণা করছেন অপূর্ব শর্মা। তাঁর দীর্ঘ আট বছর গবেষণার ফসল ‘চা-বাগানে গণহত্যা-১৯৭১’ গ্রন্থ। চা-বাগানে সিরাজুল আবদাল ছাড়াও আরও যাঁরা নির্মমতার শিকার হয়েছেন, তাঁদের কাহিনি ছান্দসিকের বাচিকশিল্পীদের বর্ণনায় এসেছে। দর্শক অশ্রুসিক্ত হয়ে তন্ময় হয়ে শুনেছেন সেই সব ঘটনা।

মুজিবুল হক মণির লেখা ও নির্দেশনায় ১৭ নভেম্বর ব্রাডি আর্টস সেন্টারে মঞ্চস্থ হয়েছে ‘লন্ডনি কানাই’। একই দিনে সুদীপ চক্রবর্তীর পরিচালনায় থিয়েটার নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ওয়ার্কশপ ও মুক্ত আর্টস পরিবেশন করেছে মিউজিক অ্যান্ড আর্ট।

স্পেস থিয়েটারে ২১ ও ২২ নভেম্বর দুই দিন সন্ধ্যা সাতটায় মঞ্চায়িত হবে জুম ফারুকের লেখা, শাবজ রাজভান্ড ও জুম ফারুকের নির্দেশনায় ‘লাইক আ রেম্বলিংগ স্টোন’ এবং ২৩ নভেম্বর সোয়াস ইন্ডিয়ান ড্যান্স সোসাইটি পরিবেশন করবে ‘অধৈর্য’।

রিচমিক্সে ২৩ ও ২৪ নভেম্বর রাধারমণের পরিবেশনায় টি এম আহমেদ কায়সারের লেখা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হবে ‘মহুয়ার পালা’। ব্রাডি আর্টস সেন্টারে ২৩ ও ২৪ নভেম্বর শনি ও রোববার তারুন জাসানির লেখা ও মুকুল আহমেদের নির্দেশনায় ‘গহরজান’ মঞ্চায়নের মাধ্যমে মাসব্যাপী বাংলা নাট্যোত্সবের সমাপ্তি হবে।