নার্সিসিজম: স্বার্থপরতা বনাম আত্মপ্রেম

প্রতীকী ছবি। প্রধম আলোর ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। প্রধম আলোর ফাইল ছবি

নার্সিসিজম শব্দটার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন, এটির একটি নেগেটিভ অর্থ রয়েছে। এর মানে হলো, নিজের প্রতি নিজেই মুগ্ধ হয়ে থাকা এবং অন্য কারও প্রতি কোনো কিছুতেই মনোযোগ না দেওয়া।

কিন্তু একটা মজার অরিজিনাল স্টোরি আছে এটার। সেটা অনেকেই জানেন না। গ্রিক মিথলজি থেকে পাওয়া যায়, নার্সিসাস নামে এক সুদর্শন যুবক ছিল। ইকো নামের এক দেবী তাকে প্রেম নিবেদন করে। কিন্তু সে তা প্রত্যাখ্যান করে। ইকো তখন তাকে অভিশাপ দেয়, একসময় সে তার নিজের রূপের দেমাগে নিজেই কাবু হবে।

সত্যি তা–ই হয়। একদিন সে পানি খেতে যায় পুকুরে। পানিতে নিজের ছায়া দেখে নিজের প্রেমে নিজেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিনের পর দিন। আর এভাবেই সে মারা যায়। পরে সে এক ফুলে পরিণত হয়। যার নাম দেওয়া হয় নার্সিশাস ফুল।

এরপর থেকে অনেক কবি–সাহিত্যিক, বিশেষ করে রেনেসাঁ যুগে, এই নার্সিসিজম নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গল্প–কবিতা রচনা করেন। কালের পরিক্রমায় সেটা অত্যধিক স্বার্থপরতার একটা প্রতিশব্দ হিসেবে পরিণত হয়।

চলুন নার্সিসিজম শব্দের এখনকার জন্য মানানসই একটা প্রতিশব্দ দেওয়া যাক আত্মপ্রেম।

আত্মপ্রেম কি খুব একটা খারাপ শব্দ?

মোটাদাগে মোটেই তা নয়। নিজেকে ভালোবাসা খারাপ কিছু নয়, যদি তাতে অন্যের ক্ষতি না হয়। সমস্যা হলো, অতিরিক্ত আত্মপ্রেম মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। আর তাই আত্মপ্রেমিক মানুষেরা অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল কম হয়ে থাকে। আত্মপ্রেমিক মানুষ আর নার্সিসিস্টদের অনেক ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ড. রামানি এই বিষয়ে গবেষণা করেন ও কিছু বই লিখেছেন এই নিয়ে।

সত্যি কথা বলতে কী আমি যখন এই নিয়ে একটু পড়াশোনা করি, আমার মনে হয়েছে, কে আত্মপ্রেমিক নয়? আমি নিজেই কিন্তু আত্মপ্রেমিক। কিন্তু প্রকারভেদে কিছু কিছু নার্সিসিস্ট অপরের জন্য যথেষ্ট মনোবেদনার ও কষ্টের কারণ হয়ে থাকেন।

বইগুলো যখন পড়ি তখন প্রত্যেকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত কোনো না কোনো মানুষের মিল খুঁজে পাই। কিন্তু আমার এই লেখার উদ্দেশ্য মোটেই অঙ্গুলিনির্দেশ করা নয়। বরং আত্মপ্রেমিকদের প্রকারভেদ সম্পর্কে মজার কিছু স্টাডি রয়েছে সেগুলো তুলে ধরা।

ফেসবুকের এই যুগে মানুষের নার্সিসিজম যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। আগেই বলেছি নার্সিসিজম খারাপ কিছু নয়, সব সময়। বরং বড় বড় সেলিব্রিটি, লেখক, কবি–সাহিত্যিক, মডেল, এমনকি অভিনেতা, খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী বা জীবনে উল্লেখযোগ্য রকম সফল মানুষের মধ্যে নার্সিসিজম বেশি লক্ষ করা যায়। নার্সিসিস্ট মানেই কি তাহলে সফল ব্যক্তি? মোটেই নয়। কিন্তু সফল ব্যক্তিদের মধ্যে নার্সিসিজমের শতকরা হার বেশি।

নার্সিসিজম কোনো রোগ নয় বরং একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যার মধ্যে এ ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকে তাকে চিকিৎসা দিয়ে ভালো করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক বিতর্ক রয়েছে। আর যেহেতু একে রোগ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে না, তাই এর চিকিৎসার দরকার আছে বলে দাবি করা যাচ্ছে না। তাই যার মাঝে এই বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে, তাকে নয় বরং তার সঙ্গে যারা রয়েছে, মানে যারা ভিকটিম, তাদেরই মনোবিজ্ঞানীরা সাহায্য করে থাকেন।


রামানির মতে, এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষদের পরিবর্তন করা সম্ভব। তবে তাদের পরিবর্তন হয় খুবই ধীরে। গ্লেসিয়ারের মতো। খুব ভালো হয় যদি তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যাটা বুঝতে পারেন এবং অন্যদের বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করতে পারেন।

আমি কিন্তু এই লেখায় কীভাবে নার্সিসিস্ট এড়িয়ে চলতে হয় কিংবা সামলাতে হয়, তা নিয়ে কথা বলব না। বরং এই বৈশিষ্ট্যের প্রকারভেদ নিয়েই আলোচনা সীমিত রাখব।

এ বিষয়টা নিয়ে আমি লিখতে চাই ফেসবুকের ক্লোজড একটা গ্রুপে। এ কথা বলার পর আমার স্ত্রী বলে উঠল, ‘তুমি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রিতে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি বেচার চেষ্টা করছ।’

আমি বললাম, ‘দেখ সেই গ্রুপের মেম্বার হলেও, আমি কিন্তু খুব বেশি পরিমাণে নার্সিসিস্ট নই।’

বউ তখন যা বলল তাতে খুব রাগ হলো। সে বলে বসল, ‘আমার ধারণা, এই কথাটা তুমি নিজে থেকে বলনি। সেদিন ট্রাম্প বলেছে না, I am the least racist person you will ever meet. তুমি মনে হয় সেখান থেকেই কনসেপ্ট ধার করে কথা বলছ।’

যা হোক, বউদের কথায় মহৎ কাজ করতে পিছুপা হওয়া ঠিক না। (নার্সিসিস্টদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তারা কাছের মানুষদের কথা খুব একটা গায়ে মাখে না)।

আগের কথায় ফিরে যাই। মোটামুটি চার ধরনের আত্মপ্রেমিক মানুষের কথা বেশি বলা হয়ে থাকে।

টক্সিক নার্সিসিস্ট বা ক্ষতিকর আত্মপ্রেমিক

এ ধরনের আত্মপ্রেমিকেরা সবচেয়ে বেশি মানুষের অনিষ্ট করে থাকে। তারা সব সময় অ্যাটেনশন চাইতে থাকে এবং তাদের প্রচুর সময় দিতে হয়। সময় না দিলে তারা ভীষণ রকমের রিঅ্যাক্ট করে, এমনকি অন্যের ক্ষতি করে বসে। তাদের একটুও অনুশোচনা হয় না এই কারণে। খুব বেশি কাছের নয় এমন মানুষের সঙ্গেও তারা এ ধরনের কাজ করতে পারে। যাদের মাঝে এই সমস্যাটা প্রবল তারা সাইকোটিক কাজকর্ম করে থাকে। যেমন পার্টনারকে শারীরিকভাবে আহত করার কিংবা সামাজিকভাবে বা মানসিকভাবে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন রকম অসহনীয় পরিস্থিতিতে তারা ফেলতে পারে। এরা চুরি করতে পারে, ডাকাতি করতে পারে কিংবা খুনও করতে পারে। পুরো ব্যাপারটাই তারা করে নিজেদের বাহাদুরি দেখানোর জন্য। এরা মোটেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। বরং এদের সঙ্গে যারা থাকে, তারাই বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে তাদের লুকিয়ে রাখতে সমাজ থেকে।

ক্লজেট নার্সিসিস্ট কিংবা গুপ্ত আত্মপ্রেমিক 

এই ধরনের আত্মপ্রেমিকদের বোঝা বা শনাক্ত করা খুব কঠিন। এদের মধ্যে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে মানুষকে মুগ্ধ করার প্রবণতা দেখা যায়। এরা নিজেদের ধারণা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায় না। কিন্তু নিজের বিশ্বাস থেকে একচুল পরিমাণ সরতেও রাজি থাকে না। মানুষকে তাদের প্রশংসা করতে একরকম বাধ্য করে তারা। আর সেটা না পাওয়া পর্যন্ত তারা বিভিন্ন রকম চেষ্টা চালিয়ে যায়। অন্যের সাফল্যে তারা খুব বেশি বাক্য ব্যয় করে না। এদের মধ্যে ঈর্ষাবোধ প্রকট হলেও সব সময় তা প্রকাশ পায় না। কারও কারও মাঝে অপরের প্রতি সহানুভূতি কিংবা সহমর্মিতার অভাব দেখা যায়। কিন্তু যেহেতু তারা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে জানে তাই কেউ কেউ কিছু গৎবাঁধা বাক্য বিসর্জন করে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি তার কাছে আপনার নিজের কোনো সাফল্যের কথা বললে সে সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনের কোনো সাফল্যের সঙ্গে এর মিল আছে তা আপনাকে বলে দেবে। তারা নিজেদের জীবনের গল্প যখন বলে, তখন একরাশ ব্যর্থতার গল্প শোনাবে বলে শুরু করে, কিন্তু শেষ করে তারই মাঝে লুকানো একরাশ সাফল্যের কথা শুনিয়ে। কারও কারও মধ্যে আবার প্যাসিভ ব্র্যাগিং বা পরোক্ষভাবে নিজের গুণগান গাওয়ার অভ্যাস লক্ষ করা যায়। এদের মাঝে একটা ভেরিয়েন্ট আছে, যারা নিজেদের ভিকটিম হিসেবে প্রচার করে। যে পৃথিবীটা বুঝল না যে তারা আসলে কতটা ভালো। কিংবা তারাই আসলে ভুল সময়ে জন্মগ্রহণ করেছে। আজ থেকে এক শ বছর পরে হয়তো মানুষ তাদের কথা বুঝতে পারবে। কিংবা এক শ বছর আগে জন্ম নিলে সে আইনস্টাইন হতে পারত।

এক্সিবিশনিস্ট নার্সিসিস্ট বা লোক দেখানো আত্মপ্রেমিক 

এরা হচ্ছে গুপ্ত আত্মপ্রেমিকের একদম উল্টো। এরা মোটেই কেয়ার করে না কে কী ভাবল। বরং আত্মপ্রেমটাকে তারা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চায়। এদের মধ্যে স্পটলাইটে থাকার চেষ্টাটা খুব লক্ষণীয়। এদের অনেকেই খুব ভালো ভালো কাজ করে অন্য মানুষের জন্য। কিন্তু উদ্দেশ্যটা থাকে নিজের আত্মপ্রেমটাকে ঢাকঢোল পিটিয়ে সবার কাছে জাহির করা। আগেই বলেছি আত্মপ্রেম সবটা খারাপ বস্তু নয়। এ ধরনের আত্মপ্রেমিকদের থেকে বহু মানুষের উপকার হয়। এ জন্য এদের অনেক সময় কমিউনাল নার্সিসিস্টও বলা হয়। এদের থেকে কিন্তু খুব কাছের মানুষেরা সাধারণত বেশি উপকার পায় না বরং কষ্ট পায়। যেহেতু তারা মানুষের মনোযোগ খুব পছন্দ করে তাই তাদের জীবনের লক্ষ্য হলো, ‘আপনি আমাকে পছন্দ করতে পারেন কিংবা অপছন্দ করতে পারেন, কিন্তু চাইলেও উপেক্ষা করতে পারবেন না।’ তারা এটা ভাবে যে তারা যেন পুরো পৃথিবীটাকে সেভ করতে প্রতিদিন চেষ্টা করছে। সে জন্য সবার উচিত তাদের নিরন্তর ধন্যবাদ দেওয়া। মানুষের কাছ থেকে ভ্যালিডেশন তাদের খুব নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি দাবি।

বুলি নার্সিসিস্ট কিংবা মুখ খারাপ আত্মপ্রেমিক 

এরা নিরন্তর মানুষকে পচিয়ে যায়। কিন্তু অন্য কেউ তাদের পচালে তাদের মোটেই ভালো লাগে না। জার্মান ভাষায় একটা শব্দ আছে schadenfreude. এর মানে হলো অন্যের দুরবস্থা দেখে একটু মজা নেওয়া। কিংবা অন্য কাউকে বিব্রত করে আনন্দ পাওয়া। এ ধরনের আত্মপ্রেমিকদের মাঝে এর ভীষণ রকমের ব্যাপ্তি দেখা যায়। বন্ধুবান্ধবদের একটু কটু কথা বলে আনন্দ করার প্রবণতা সব দেশের সব সমাজে দেখা যায়। কিন্তু এর মধ্যে একজন থাকে যে বন্ধুদের সবাইকে বিভিন্ন রকম আজেবাজে কথা শোনালেও নিজের কোনো রকমের কথা শুনতে রাজি থাকে না।

শেষমেশ আরেকবার বলে যাই আত্মপ্রেম কোনো রোগ নয় কিংবা সব সময় খারাপ কিছু নয়। এটি একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা ভীষণ রকমের সফল, ধনী কিংবা ভাগ্যবান মানুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কিন্তু যখন আশপাশের মানুষেরা এই বৈশিষ্ট্যের জন্য ভুগতে থাকে তখন এটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সবার মাঝেই কম বেশি এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেহেতু কোনো ডাক্তার একে সারাবে না, তাই নিজে থেকেই নিজের এই বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে পারাটা কল্যাণের। তাতে অপরের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সমব্যথীতা বাড়বে বলে আশা করা যায়। অপরের প্রশংসা করুন, তাতে আপনার নিজের আত্মপ্রেম কমতে পারে।