বেড়ানো: সেতুর বুকে নৌকা

লিটল ম্যাজিশিয়ান। অদূরে দেখা যাচ্ছে স্তালিনিস্ত দালানের একাংশ। ছবি: শেখ সানি আমান
লিটল ম্যাজিশিয়ান। অদূরে দেখা যাচ্ছে স্তালিনিস্ত দালানের একাংশ। ছবি: শেখ সানি আমান

আকাশ থেকে মাঝেমধ্যে ছেলেমানুষি ইচ্ছা এসে মনের ভেতর ভর করে।

এই যেমন এটাও মনে হয়, মিশেল একটা অর্থব্যবস্থা দেখে এসেছি, বসবাসও করছি এককালের পশ্চিম জার্মানিতে। কী এমন অসুবিধা হতো, যদি ড্রেসডেনের বদলে হামবুর্গ শহরটা পূর্ব জার্মানির ভাগে পড়ে যেত সে সময়। যদিও লেপেপুঁছে অনেক অদরকারি প্রাচীন গন্ধ উড়িয়ে দিতে জার্মানরা সিদ্ধহস্ত। এই উড়িয়ে দেওয়ার নাম তারা দিত ‘রেনোভিয়েরেন’। তবু চলতে-ফিরতে টুপটাপ ঠিকই চোখে পড়ে যেত নানা রকমের পুরোনো দিনের সাম্য, এ আমি নিশ্চিত। গুনগুন করে মৌসুমি ভৌমিক গেয়ে উঠতাম মনের ভুলে, ‘সব এক ধাঁচ—সব এক রং তুমি কোথায় থাকো অনন্য?’

তারপর পাশ দিয়ে ভুস করে কোনো প্রাচীনপন্থী শৌখিন বুড়ো কিংবা বুড়ি তাদের সাধের ফেলে না দেওয়া লক্কড়ঝক্কড় ট্রাবান্টটা চালিয়ে যেতেই পারত। ওটার মিতব্যয়ী অবকাঠামোর কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঢুকে পড়তাম জিডিআর ঐতিহ্য রেখে দেওয়া কোনো চায়ের দোকানে। অনাড়ম্বর দেয়ালে ঝোলানো থাকত মস্কোপন্থী নেতা পল হোনকার। ব্যাক ব্রাশ করা সাদা চুল-কালো ফ্রেমের চশমা। তার চোখে এক পলক দুই পলক চোখ রেখে তারপর দুনিয়ার এই তন্ত্র সেই বাদ নিয়ে হাবিজাবি ভাবতাম, চা খেতাম-ঝিমাতাম।

আমি চা খেলে সাধারণত ঝিমিয়ে পড়ি। কারণে অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক যেমন তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে, ব্যাকটেরিয়াগুলা সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে পড়ে। সে রকম আমার অতি চায়ে হয়েছে মেলাটোনিন রেজিস্ট্যান্ট। যা হোক, ঝিমাতে ঝিমাতে আমার মনে হতো কোনো কোল্ড ওয়ার স্পাই বসে আছে কোনার চেয়ারে। শরীরের সব হাড় গুঁড়ো করতে ওস্তাদ স্তাসির পুলিশও হতে পারে সে।

অথচ হামবুর্গে কোনো প্রলেতারিয়েতের ইউটোপিয়া স্মৃতি নেই। যুদ্ধস্মৃতি আছে অনেক। তন্ত্রমন্ত্র আর জীবনের বিস্তার-জীবনের ক্ষয় নিয়ে ভাবার জন্য এ শহরও কিন্তু ঢের জোগান দিতে জানে।

মেঘলা মেঘলা একটা ছুটির দিনে হামবুর্গনিবাসী বাংলাদেশিদের ১৫ সদস্যবিশিষ্ট অভিযাত্রী দল মাগদেবুর্গ সেন্ট্রাল স্টেশনে পৌঁছে গেল। স্টেশনে নামার আগ থেকেই আমার মনে হচ্ছিল মানুষ কতটুকু স্মৃতি রেখে দিতে চায়? আমার নানু যেমন স্মৃতি রেখে দেন পাট পাট।

নিচে নদী ওপরে অ্যাক্যুডাক্ট। অ্যাক্যুডাক্টের পাশেই আমরা। ছবি: রওনক জাহান
নিচে নদী ওপরে অ্যাক্যুডাক্ট। অ্যাক্যুডাক্টের পাশেই আমরা। ছবি: রওনক জাহান

আম্মুকে তাঁর ছোট্টবেলার মেরুন রঙের খেলনা টি-সেটটা নানু ছুঁতে দিতেন না। তারপর কত বেলা গড়াল। আমিও টুপ করে আম্মুর কোলে নেমে এলাম। আমি সেই ছয় জোড়া কাপ-পিরিচ, রুপালি ছোট গোল তালা দেওয়া কাচের এ-পার থেকেই দেখে গিয়েছি যতবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা হতো। এখন নানু বড়মা হয়েছেন অনেকের। তবু অটুট আছে তাঁর স্মৃতির সংরক্ষণ। নানুকে কোনো জাদুঘরের দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি খুব ভালো করতেন বলে আমার শক্ত বিশ্বাস।

আসলে মাগদেবুর্গ এসেছিলাম এদের অভিনব জলসেতু দেখার জন্য। আমাদের অভিযাত্রী দলে নয়জন পূর্ণ বয়স্ক। বাকি ছয়জন অল্প বয়স্ক হলেও জাঁদরেল আছে। সারা ট্রেন বড়দের ভালোই ব্যস্ত রেখেছে টুক টুক কথা দিয়ে—হুটোপুটি কাজ দিয়েও। এত দিন দেখেছি হামবুর্গের টানেলের ওপর জাহাজ চলতে। তো আজ আমরা সবাই মিলে দেখতে চাই সেতুর ওপর জলযানের আনাগোনা।

মাগদেবুর্গ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হালে লাইপযিশ কিংবা পটসডামের মতো সোভিয়েত ব্লকের আওতায় চলে যায়। দুই জার্মানির একত্রীকরণের পর সাক্সন-আনহাল্ট স্টেটের রাজধানী হয় এটি। পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা জলসেতুর চেহারা দেখা ছাড়াও মাগদেবুর্গের ব্যাপারে আমার ভেতর আরেকটু উত্তেজনা কাজ করছিল। উত্তেজনাটা এই শহরের রেখে দেওয়া জিডিআর স্মৃতি দেখার জন্য। জিডিআর স্মৃতি হচ্ছে জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক। সোজা কথায় পূর্ব জার্মানির স্মরণ।

বার্লিনেও স্ট্রাউসব্যর্গার প্লাতজ থেকে আলেকজান্ডার প্লাতজ হেঁটে যেতে যেতে দেখেছি সার বাঁধা সব সৈন্যের মতো সমজাতীয় দালান। হাতড়ে হাতড়ে পুরোনো দিন খুঁজে দেখার কালে চট করে সেই মৌসুমি ভৌমিক সেখানেও চলে আসেন সব এক ধাঁচ সব এক রঙের বার্তা সঙ্গে নিয়ে, আমার গলায়। দেয়ালে ম্যুরালে আছে পুরোনো বার্লিনবাসীর নস্টালজিয়া। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গড়ার অঙ্গীকার।

সত্যি কথাটা বলেই দিই। ‘গুড বাই লেনিন’-এর অ্যালেক্স ছেলেটা তার আট মাসের কোমাফেরত মাকে প্রচণ্ড শক সেই সঙ্গে মায়ের জীবন বাঁচাতে চলমান চকচকে পুঁজিবাদের ওপর হারিয়ে ফেলা সমাজতন্ত্রের সাদামাটা ঝালর বসিয়ে দিয়েছিল। সে বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে জিডিআরের সময়টাকে খুঁজে দেখতে ইচ্ছা করেছে আশপাশে এই যা। এর চেয়ে বেশি কিছু না। পৃথিবীব্যাপী অট্টালিকার পাশেই ক্ষুধার্তদের ছাপরাঘর আমাকে হতাশ করে। দেনা মেটাতে শিশুখাদ্যের দিকে হাত বাড়ানো রাষ্ট্রের দৈন্যে বিস্মিত হই। যুদ্ধ-উত্তর জার্মানদের প্রবল আত্মসংকট থেকে সামগ্রিকভাবে বেরিয়ে আসার চেষ্টাটাও আমি বুঝতে চেষ্টা করি।

ট্রেন স্টেশন থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এই তো এই নব্বইয়ের দশকেও এখানে ডয়েচে রাইখযবান স্টিম ইঞ্জিনের ধোঁয়া উড়িয়ে গন্তব্যে ছুটত। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আম আলটেন থিয়েটার নামের একটা ধূসর রঙের (সত্যি ধূসর, ওরা রাস্তা-সিঁড়ি-ভবন সব সিমেন্ট কালার দিয়ে রেখেছে!) জায়গা পার হতে হতে হালকা গুগল করে হতাশ হতে হলো। এই শহরের বিরাট একটা অংশ আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর নিয়ম মেনে নতুন করে বানানো হয়েছে। ইস্টার্ন ব্লকের সেই হোমোজেনাস এবং মনোটোনাস লাইন দিয়ে বানানো বাড়িঘর-দোকানপাট, এক রঙে-এক প্যাটার্নে বানানো সরকারি অফিস তাকালেই যে খুব দেখতে পাওয়া যাবে এমন না।

তবে আছে এখনো কিছু। এই যেমন সিটি সেন্টারের বিশাল ফোয়ারাটার আশপাশে এখনো কিছু পঞ্চাশের দশকের স্তালিনিস্ট নিও ক্ল্যাসিক্যাল ঘরানার দালানকোঠা দেখা যায়। বহুতল ও প্রশস্ত। এতটা অভিন্ন দেখতে অভ্যস্ত নই, তাই হয়তো কেমন ‘এবিসি ব্লকের গোলকধাঁধায়’ পড়ে যাই। এই গোলকধাঁধা কিন্তু অটো ফন গুয়েরিকে স্ট্রাসে কিংবা লাইটারস্ট্রাসেও সামান্য দেখা দিয়েছিল। সব একটু এদিক-ওদিক সুরে এক কথা বলেছে, বলেছে আমার সঙ্গে চল।

আমরা অবশ্য কোনো দিকে না তাকিয়ে সেই বিখ্যাত ওয়াটার ব্রিজের দিকেই চললাম। ট্রাম চলে এ শহরটায়। আমাদের ট্রামে চড়তে হবে। ট্যাক্সি নিতে হতে পারে যত দূর বুঝতে পারছি। হাঁটতেও হবে বেশ অনেকটা পথ। এই দ্রুত ও মন্থর গতির ভেতর দিয়েই মাগদেবুর্গকে চিনে নিতে হবে যতটুকু পারা যায় এক-আধবেলা। অবশ্য এমন তাড়া নিয়ে শহর দেখা ঠিক না। বোঝা যায় না শহরটাকে। আমি যেমন ট্রামের জানালা দিয়ে রোমান এমপায়ারের ভারী একখানা দাপট আর অটোনিয়ান বলে কিছু একটা ছিল এখানটায়; এর বাইরে খুব গভীর কিছু ওইটুকু দেখায় বুঝে নিতে পারিনি। এ ছাড়া অস্ট্রিয়ান স্থপতি ও চিত্রশিল্পী হুন্ডার্টভাসার বিচিত্র এক দালানচিত্র আছে এ শহরে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে ব্রাইটার ভেগের কাছে গোলাপি রঙের দরদালান বেয়ে যেন ঝরনার মতো কালো-খয়েরি মার্বেল পাথর নেমে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখলে এ রকমই মনে হয়। কাছে যাইনি আমরা তবে গ্রিন সিটাডেল নামের আবাসিক ঘরবাড়ি-হোটেল-দোকানপাটসংবলিত এই অদ্ভুত দুর্গ অথবা কমপ্লেক্স তৈরির কনসেপ্টটা কিন্তু ভীষণ অর্থবহ। হুন্ডার্টভাসার ভেতরে বাইরে রঙিন এই গ্রিন সিটাডেল নির্মাণের প্রেরণা ছিল ‘Oasis of humanity and nature within a sea of rational houses’; চমৎকার না?

দুপুরবেলা হালকা একটা পুঁজিবাদীদের ম্যাকডোনাল্ডস ব্রেকের পর পথে নামতেই ঝুমবৃষ্টি শুরু হলো। আমাদের দলে অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও যেমন ছিলেন, তেমন ছিল স্ট্রলারে চড়ে বড় ভাইকে কিন্ডারগার্টেনে নামিয়ে দিতে যাওয়া টলমলে নিরক্ষর শিশুও। বৃষ্টির তাড়া খেয়ে অতি দ্রুত ট্যাক্সির সংস্থান করতে পারলাম আমরা।

তবে সে এক বিরান ভূমিতে নেমে গেলাম সবাই মিলে ঠিক কোন কারণে, একদম মনে পড়ছে না। হাঁটতে হয়েছিল অনেকটা পথ। কেন হাঁটতে হয়েছিল আমাদের? আমার সফরসঙ্গীদের কারও হয়তো মনে আছে। ফোন করে জেনে নেওয়া যেত। তবে এই না মনে করতে পারাটা উপভোগ্য লাগছে লিখতে লিখতে। বিস্মৃতই থাকুক, অসুবিধা নেই। বেশ লম্বা ছিল সে পথ। কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হাঁটতে আকাশ অনেকবার তার রং বদলে ফেলেছিল। কখনো ধূসর, কখনো ম্যাড়মেড়ে সাদা আবার কখনো অকারণ হরষ জাগানিয়া নীল।

সংগৃহীত ছবি। আমাদের কাছে কোনো ড্রোন ছিল না।
সংগৃহীত ছবি। আমাদের কাছে কোনো ড্রোন ছিল না।

পুরো পথ ছিল অদ্ভুত রকমের গল্পমুখর। পথ, বৃষ্টিভেজা পথের গন্ধ, বাতাসে হালকা দুলে ওঠা সবুজের ভেতর দিয়ে একদল মানুষ নানা রকমের গল্প করতে করতে এগোচ্ছে কোথাও। তারা কেউ নিশ্চিত না সামনে কি কোনো বিস্ময় অপেক্ষা করছে, নাকি ‘ধুরো! এইটা কিছু হলো? এই দেখতে এত হাঁটাহাঁটি করলাম-পা ব্যথা করলাম!’ বলে ফেলবে।

গুগল ম্যাপ দেখিয়ে দেওয়ার আগেই অবজারভেশন টাওয়ারটা নিজ থেকেই দেখা দিয়ে ফেলল। ভাসাস্ট্রাসেনক্রয়েজ নামের বিচিত্র যজ্ঞ অপেক্ষা করছে আর একটু গেলেই। অবজারভেশন টাওয়ারের ওপর থেকে গালিভারের চোখে তখন আমাদের কেউ কেউ লিলিপুট খাল, লিলিপুট নদী, লিলিপুট পণ্যবাহী জাহাজ দেখার জন্য অত্যুৎসাহী হয়ে পড়লাম।

ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলো মোটেও ভীতিকর নয়, হাতলওয়ালা ও এই-ই চওড়া। কিন্তু এ রকম সামান্য উঁচু গন্তব্যে সিঁড়ি বাইবার সময় আমি ইদানীং কেন যেন পানির ট্যাংকের খাড়া মই বেয়ে ওপরে উঠতে থাকা ভিতু কিশোরের প্যানিক হালকা ফিল করি। এই উচ্চতাভীতি সাময়িক হলেই বেঁচে যাই। কিছুদিন আগেও ছোট-মাঝারি পাহাড় চড়া বিষয়ে আমার খুব বেশি কিছু যেত আসত না। এখন মা হওয়ার পর পাঁচতলার রেলিং ছাড়া ছাদ থেকে কেউ নিচে তাকাতে বললেও ‘উ মাগো!’ বলে পেছনে সরে আসার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

টাওয়ারে উঠে অবশ্য মনে হচ্ছিল এত বোকা কিসিমের হাত কেন ঘেমে ওঠে আমার! চমৎকার দেখা যাচ্ছে নতুন করে একটু একটু গড়া অথচ পুরোনো আদলের ছিমছাম একটা শহর। হালকা সবুজ-গাঢ় সবুজ, মাঝেমধ্যে বসতির চিহ্ন, বয়সী গুরুগম্ভীর গির্জার শরীর, নিপাট কলকারখানা আর অবশ্যই মিটেললান্ড আর এলবে হাফেল নামের দুই ক্যানেলের এলবে নদীর ওপর ভর করা। আর কীভাবে কীভাবে তাদের যেন এক হয়ে যাওয়া। তাদের এই সংযোগটা ঘটায় ভাসাস্ট্রাসেনক্রয়েজ নামক জলসেতুটি। প্যাঁচ লেগেই যায় কারবারটা বুঝতে চাইলে। ওই পরিস্থিতিতে আমি সেসব প্রকৌশলীর কথা বিশেষভাবে স্মরণ করতে চাইলাম, যারা এ রকম একটা প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়ে জার্মান নৌপথে মালবাহী জাহাজগুলোকে ভীষণ সুবিধা করে দিতে পেরেছে অবশেষে।

কৃত্রিম এই নৌবাহী জলপ্রণালির কাছে যেতে যেতে বিকেল হয়ে গেল। আলোটা নরম। পানিতে স্পর্শ লাগে মৃদুমন্দ বাতাসের। খবর আসে পণ্যবাহী স্টিমার এই এক্ষুনি যাবে এই পথে। দুই পাশে সেতুর চিরায়ত হাতল। মাঝে জলে ভাসবে নৌযান আর কংক্রিটের পথ ধরে যাবে আমাদের মতো পথিক দল কিংবা সাইকেল। আবার হাঁটতে হাঁটতে গ্রিলের বাইরে নিচে তাকালে দেখা যাবে অনুভূমিক রেখা ধরে বয়ে যাচ্ছে এলবে নদী।

১৯৩০ থেকেই এলবে হাফেল খাল-মিটেললান্ড খাল-এলবে নদীতে পণ্যবাহী নৌযান চলাচলের জটিলতা এবং সময় কমাতে এই কানালব্রুকের (জার্মান ভাষায় কানাল মানে খাল, ব্রুকে মানে সেতু) কাজ শুরু হয়। বিশ্বযুদ্ধ এবং দুই জার্মানির মধ্যে এরপর ইস্পাত-কংক্রিটের দেয়াল পড়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন কাজের কোনো অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। দেয়াল ভাঙার পর আবার সেই অসমাপ্ত নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের যাত্রা শুরু হয়। ২০০৩ সালে এসে অবশেষে মাগদেবুর্গ কানালব্রুকে কার্গো চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যায়। খাল দুটি কানালব্রুকে তৈরির আগে এলবে নদীর উল্টো দিকে মিলে গিয়েছিল। শুকনা মৌসুমে বিশেষ করে এলবে নদীর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানিপথে পণ্য পারাপার বেশ অসুবিধাজনক ছিল সে সময়। প্রায় ১২ কিলোমিটার রাস্তা এখন আর পাড়ি দিতে হয় না কার্গোদের।

পানির খুব আস্তে কেঁপে ওঠা দেখতে দেখতে অপেক্ষা করতে ভালো লাগছিল নৌকা-স্টিমারের জন্য। ছোটখাটো জাহাজ একটা গেলে মন্দ হতো না। আমাদের অপেক্ষারত দলের ভেতর থেকেই খবর এল, সেতুর বুকে নৌকাটৌকা দেখা শেষ হলেই আমাদের ছুটতে হবে। ছানাপোনা, স্ট্রলার-প্র্যাম, ঢাউস সাইজের ব্যাগ, কেক-পাস্তা নিয়ে তারপর ট্যাক্সিটা নিতে হবে, ট্রেনটা ধরতে হবে। না হয় ভীষণ দেরি হয়ে যাবে।

অচেনা শহরটায় থেকেও যেতে হতে পারে। একবার মনে হলো কী সর্বনাশ। রাতে থেকে যাওয়ার মতো বাড়তি জিনিসপত্র তো সঙ্গে নেই! দৌড় না দিয়ে যাব কই?

আবার কে যেন মনের ভেতর ডাক দিয়ে জানায় কাল রোববার। পরিচিত রেভে, নেটো, এডিকা তো আছেই এই শহরে। উঠে পড়া যাবে কোনো পান্থশালায়। সেখানকার জানালাটা পাঁচতলার ওপরে হলে ভালো হয়। কাচের এ-পাশ থেকে যত দূর বুঝতে পারি আমার অস্বস্তিকর উচ্চতাভীতি অত কাজ করে না।

জানালা দিয়ে আরেকটু তবে দেখা যাবে নতুন শহরে সেই পুরোনো অনন্য আকাশ, সেই পূর্ব-সেই পশ্চিম।

রওনক আপা-তুহিন ভাই, রোশনি আপু-আমান ভাই, নিনিয়া আপু-ফরিদ ভাই, আপনাদের সবাইকে (আদনান তোমাকেও) অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার সুন্দর একটা ভ্রমণস্মৃতির অংশ হয়ে থাকার জন্য। সবার আপ্রাণ চেষ্টায় দৌড়ে শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরতে পারার স্পিরিটটা দীর্ঘদিন মনে থাকবে। হুড়মুড় ট্যাক্সি স্মৃতিও কিন্তু খুব মনে থাকবে। ওটা সবাইকে বলা যাবে না। ওটা সিক্রেট।

নিনিয়া আপুর আব্বু পায়ে এ রকম কষ্ট নিয়েও যেভাবে আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন, শ্রদ্ধা তাঁর জন্য।

আমাদের সব বাচ্চাকাচ্চার কেয়ারিং বড় আপু রাইসা, বুঝদার টুকটুকি মানাল, গপ্পবুড়ি আঈরা, দারুণ পর্যবেক্ষক ফারযান এবং আমার দুটি খুদে ভ্রামণিক-তোমরা সেদিন এমন জাঁদরেল প্রজাপতির মতো ঘুরে বেরিয়েছিলে! তোমাদের জন্য দিনটা আরও সুন্দর-আরও বর্ণিল হয়ে উঠেছিল।

আর একটা কথা, লিখতে কেমন ভুলেই গিয়েছি; অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পরপর দুটি স্টিমার এসেছিল আমাদের দেখা দিতে। ভারি সাবলীল ছিল তাদের গতিবিধি। মনেই হয়নি কংক্রিটের কোনো সাঁকো পেরোচ্ছে তারা, বরং নির্বিকার জলে আলোড়ন তুলেছিল চেনা পথে।

দূরে বহু দূরে যাওয়ার তাড়া ছিল বলে একসময় ছোট ছোট দুটি বিন্দু হয়ে মিলিয়েও গেল।