মেয়ের মা

সন্তানের বিয়ে নিয়ে মা–বাবার কাজের অন্ত নেই। ছবি: সংগৃহীত
সন্তানের বিয়ে নিয়ে মা–বাবার কাজের অন্ত নেই। ছবি: সংগৃহীত

সাবিহার টেনশনে হাত পা কাঁপছে। তবে আজকের দিনে টেনশনে শুধু হাত পা কাঁপাকাঁপি কেন, চোখ উলটে ভিরমি খাওয়াও জায়েজ আছে। কারণ আজ সাবিহার মেয়ের বিয়ে। সন্ধ্যা সাতটা বাজতে চলল অথচ বরপক্ষের এখনো দেখা নেই। অপির বাবাকে সে অন্তত পাঁচবার বলেছে জামাইয়ের মামাকে একটা ফোন দিয়ে জানতে যে তাদের আসতে আর কত দেরী। মনসুর সাহেব তাঁকে কোনো পাত্তাই দেননি। সাহেবের কাজ কারবার দেখে সাবিহার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। আয়েশ করে মাটন চপ খাওয়া হচ্ছে। জামাই আসার পূর্বে খাবার পরিবেশনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নির্ঘাত তার স্বামী একেবারে রান্নাঘরে ঢুকে বাবুর্চির কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন। ছিঃ, কী লজ্ব্বা! রেবাকেও এখন দেখা যাচ্ছে প্লেট হাতে তার বাবার পাশে দাঁড়াতে। না দেখেও সাবিহা স্পষ্ট বুঝতে পারছে রেবার প্লেটেও মাটন চপ। পই পই করে ছোট মেয়েকে সে বলেছে জামা-কাপড়-মেকাপ যেন এক বিন্দু এদিক ওদিক না হয়। আর বছর তিনেক পরে রেবারও বিয়ে দেওয়ার সময় চলে আসবে। বড় বোনের বিয়েতে যে মেয়ে এত বড় হা করে মাটন চপ খায় তাকে ঘরের বউ কোন ছেলের মা করতে চাইবে? এখন এত মানুষের সামনে ডাকাডাকি করা কি ঠিক হবে?

‘সাবিহা’পা। উফফ দারুণ আয়োজন করেছ গো!। মেয়ের গলার সেটটা কয় ভরির? ’
সাবিহার মনটা ভালো হয়ে যায়। এমন একটা প্রশ্ন করা হয়েছে যার উত্তর দিতে তার খুবই ভালো লাগবে। ‘বারো ভরির, কুন্দনের কাজ করা। মাঝের বড় রুবিটা কিন্তু আসল। ’
‘সে তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কুন্দনের ডিজাইন এখন পুরনো হয়ে গেছে না? ’
‘আরে পুরনো ধাঁচ পরাই তো এখন স্টাইল। কী যেন বলে না, রেট্রো, হ্যাঁ রেট্রো স্টাইল। ’
‘বাপরে এত কিছুও জানো! ’
‘জানতে হয় রে সোনা, মেয়ের মা হলে অনেক কিছু জানতে হয়। ’

তা সাবিহা নিজেকে আদর্শ মেয়ের মা বলেই মনে করে। সবকিছু একেবারে নিখুঁতভাবে করতে পছন্দ করে। আর কাজ নিখুঁত হওয়ার জন্য হাতের সব ক’টি আঙুল বাঁকা করতেও সে দ্বিধা বোধ করে না। আর তাছাড়া এ বিয়ের জন্য কি কম খাটুনি গেছে? মনসুর সাহেবের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে আগামী পাঁচ বছরেও মেয়ের বিয়ে দেওয়া যেতো না।

নদীর ঢেউয়ের মতো কল কল হাসির আওয়াজে সাবিহা স্টেজের দিকে তাকায়। অপির বান্ধবীরা সবাই স্টেজে উঠে অপির সঙ্গে ছবি তুলছে। তাদের হরেক পদের বাহানা চারজন আলোকচিত্রী মিলে সামাল দিতে পারছে না। খুশি হওয়ার বদলে সাবিহা বিরক্ত হয়। তার দুই মেয়ের কারো মাথায় কোনো বুদ্ধি হয়নি। দুইটাই হয়েছে তাদের বাবার মতো। এ মিশু নামের মেয়েটার সঙ্গে এতো গলা জড়াজড়ি করে ছবি তোলার মানেটা কী? মিশু মেয়েটা চোখ ধাঁধানো সুন্দরি। যেন মর্মর পাথর কুঁদে তৈরী প্রতিমা। উজ্জ্বল গোলাপী গায়ের রঙ। এতো মেকাপ দিয়েও তার শ্যামলা, বোঁচা নাকের মেয়েটিকে ফর্সা বানানো যায়নি। একা বসে থাকলে বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু মিশুর পাশে বসায় মনে হচ্ছে কেউ সাবিহার দিকে আঙুল তুলে বলছে, ‘তোর মেয়ে কালো। ’ এই মিশু মেয়েটিকে স্টেজ থেকে নামানো দরকার।

স্টেজের দিকে যেতে যেতে সাবিহা শুনতে পায় বাম পাশের টেবিলে বসে এক মহিলা বলছে, ‘ধুর বউটা দেখতে ভালো না। এই মেয়ের এত ভালো বিয়ে ঠিক হলো কী করে? যৌতুক দিয়েছে কি না জানেন নাকি? ’

সাবিহা হতভম্ব হয়ে লক্ষ্য করে এই মহিলা আর কেউ না, তার আপন খালাতো বোন। যাদের সাথে বসে এই আলোচনা চলছে তারাও প্রত্যেকে আত্মীয়ের মধ্যেই পড়ে। ছুটে গিয়ে সাবিহার অনেক কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করলেও শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলিয়ে নেয়। মেয়ের মা’দের বিয়ের আসরে হট্টগোল করতে নেই। সব ঝামেলা মিটলে পরে সে দেখে নেবে তাদের। মুখের জোর তার নিজেরো কি কম?

‘সাবিহা’পা, বরপক্ষ আসার কতদূর? ’ ছন্দাকে দেখে সাবিহার সব রাগ পানি হয়ে যায়।

‘ছন্দা, বোন একটু দ্যাখ না রবিনটা কই। রবিনকে দিয়ে ছেলেপক্ষের কাউকে একটা ফোন করা তো। আমার সাহেবকে তো চিনিসই, কোন দিকে খেয়াল নাই। তার টিকিও খুঁজে পাচ্ছি না। আমি মেয়ের মা বুঝি ফোন করতে পারি? কেমন দেখায় না! ’

‘আরে তুমি কেন ফোন দিবা? তুমি শান্ত হয়ে বসো তো, আমি দেখছি। ’

সাবিহার এতক্ষণে একটু নিশ্চিন্ত লাগে। ছন্দার মতো কাজের মেয়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যেমন স্মার্ট তেমন লক্ষ্মী। রবিনের কপালটা ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্রী। পাশ করার আগেই চাকরি পেয়ে বসে ছিল। ছন্দা কোনো কাজের দায়িত্ব নেওয়া মানে সেটা যে করেই হোক, সে করেই ছাড়বে। তার ফুপাতো ভাইয়ের জন্য এতো ভালো বউ স্বয়ং আল্লাহই মিলিয়ে দিয়েছেন। নতুবা সাবিহা তো ওদের বিয়ে পছন্দই করছিলো না। বিয়ে ঠেকানোর জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি সে রাখেনি।

সাবিহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখতে থাকে। এই যে মিসেস আমিন একটা ছোট মতন বাক্স রাখলেন, শশী রেজিস্টার খাতায় লিখলো না। উফ, উপহারের স্টেশনে শশীকে রাখাটাই ভুল হয়েছে। আইবুড়ো মেয়েদের ওপর কোনো কাজের ভার দিতে নেই। পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই শশীর এখনো বিয়ে করা হয়ে উঠলো না। চিকিৎসক ছাড়া কারও সঙ্গেই বিয়ে দেবে না, শশীর মা’র ছিল এই পণ। কিন্তু কন্যা গর্বে গর্বিত বেচারি ভুলে গিয়েছিল যে দেশে এখনো শিক্ষা আর ব্যবহারের চেয়ে চেহারা আর কম বয়সের মূল্য বেশি। দিনে দিনে চিকিৎসক শশীর ডিগ্রির সংখ্যা যত বেড়েছে তত কমেছে পাণিপ্রার্থীর সংখ্যা। আর এখন যখন শশীর মা ইন্টার পাস ব্যবসায়ী পাত্রের সাথেও বিয়ে দিতে রাজি, বেঁকে বসেছে শশী নিজেই। তীব্র অশান্তি ও ঘরে। মনে অশান্তি নিয়ে হাঁটুর বয়সী ভাগনির বিয়েতে আনন্দ করে কে? রেবাকে রাখা দরকার ছিল ওখানে ওর কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে। সাবিহার মাথাটা ধরে আছে যেন, কেউ কোনো কাজ ঠিক মত করছে না। নিশ্চয়ই এখন খবর আসবে যে রান্নাঘর থেকে দুই ডেকচি খাবার উধাও হয়েছে। বিয়ে বাড়ীতে খাবার চুরি খুবই সাধারণ ঘটনা। কোনো খাবারের দোকানও ঠিক করে রাখা হয়নি এসব হুজ্জত যদি ঘটে যায় তবে তা সামলানোর জন্য। আজকে কি সব কিছু ঠিকঠাক মত হবে?

একুশ বৎসর বয়স আজকালকার দিনে বিয়ের জন্য কম বয়সই ধরা হয়। সাবিহা মেয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করেছে আরো দুই বছর আগে থেকে। এর কারণ তার মেয়েটি তার মত সুন্দর হয়নি, হয়েছে বাবার মত। শ্যামবর্ণ, নাকের গঠন ভালো না, তার ওপর স্বাস্থ্যও ভালো। দাঁতও সুবিধার ছিলো না, কিন্তু সেটি ১০ বছর বয়সেই ঠিক করা হয়েছে। কড়া ডায়েটে রেখেও মেয়ের স্বাস্থ্য কমেনি মনসুর সাহেবের আহ্লাদের জন্য। বাসায় খেতে না দিলে ঠিকই চুপি চুপি মেয়ের হাতে টাকা দিয়ে এসেছেন বরাবর। বাড়ন্ত বয়সে নাকি ক্ষুধা লাগে বেশি-এই হচ্ছে মনসুর সাহেবের অজুহাত। শ্যাম বর্ণ মেয়ে নিয়ে সাবিহার দুশ্চিন্তা কোনদিনও তিনি বোঝার চেষ্টা করেননি। মেয়ে দিন রাত বই পড়ে, চমৎকার গান গায় - এইসব নিয়ে মনসুর সাহেবের আদিখ্যেতাভাব সাবিহার অসহ্য লাগে। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি বিরক্ত হতেন। এমনকি এই যে এত ভালো ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, তারপরেও তাতে তিনি মত দিচ্ছিলেন না। শেষকালে সাবিহা তার শ্বাশুড়ি আর ভাসুরকে ধরে তাঁকে বিয়েতে রাজি করিয়েছেন। এত ভালো ছেলে কি গাছে ধরে?

ছেলের বয়স ত্রিশ বলে অপি প্রথমে খুব মন খারাপ করেছিলো। নয় বছরের গ্যাপে মনের মিল হবে তো? তার ওপর ছেলে থাকে কানাডায়। দিন রাত বরফ পড়া একটা দেশ। একা একা ওখানে গিয়ে কী করবে অপি? সাবিহা ধমক দিয়ে এইসব নাটক বন্ধ করেছে। ত্রিশ বছর ছেলেদের জন্য বিয়ের উপযুক্ত বয়স। বাড়ী গাড়ী করতে গেলে এটুকু সময় লাগেই। তার ওপর ছেলে পিএইচডির স্টুডেন্ট। বোকা-গাধা কেউ নিশ্চয়ই পিএইচডি করতে পারে না। বাবা-মা-ভাই দেশে থাকে, বড় দুই বোন বিদেশে। ছেলে চাইলেও দেশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবে না। আর হানিমুনে নায়াগ্রা ফলস নিয়ে গেলে কোথায় যাবে এসব মন খারাপ ভাব! নায়াগ্রা ফলসের পাশে মেয়ে আর জামাই এর ছবি সবাইকে দেখিয়ে কী কী বলবে সেসবও সাবিহার ঠিক করা। সবার আগে দেখাবে সে শর্মী ভাবীকে। তার মেয়ে আর জামাই গেছে কক্সবাজার। আজকাল মানুষ ডেট করতেও ওখানে যায়। তাই নিয়ে ভাবীর সে কি আহলাদ। কানাডার ছবি দেখলে নিশ্চয়ই ট্যাড়া হয়ে যাবেন।

“বর এসেছে বর এসেছে! ”

চলে এসেছে! সাবিহা দ্রুত ছোটে গেটের দিকে। সে না থাকলে বাচ্চা-কাচ্চা গেট ধরা নিয়ে কী কাণ্ড করে বসবে কে জানে। অদ্ভুত কোন বিশাল অঙ্কের টাকা চেয়ে বসার আগেই আটকাতে হবে। ছুটতে ছুটতে এক ফাঁকে স্টেজের দিকে তাকায় সাবিহা। আহ, কী মিষ্টি লাগছে তার মেয়েটিকে। চোখে জল আসি আসি করে সাবিহার। এতটুকু ছিলো না এই সেদিনও অপি? হাত চেটে চেটে চকবার আইসক্রিম খেতো। আহারে, তার মেয়েটাকে ওখানে সবাই আদর করবে তো?

“হবে না হবে না! পঞ্চাশ হাজারের এক পয়সা কম না! ” বাচ্চাকাচ্চার হৈ চৈ এ কানে তালা লাগার জো।
“ইশশ শখ কত! পঞ্চাশ টাকা দিবো। ”

সাবিহা বিরক্ত হয়ে দেখলো যে তার আত্মীয় স্বজন সবাই বাচ্চাদের সাথে তাল মিলিয়ে চেঁচাচ্ছে। মনসুর সাহেবকেও দেখা যাচ্ছে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।

“অ্যাঁই অপির বাবা, তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে কি তামাশা দেখছো? বাচ্চাগুলিকে থামাও না কেন! ”
“থামাবো কেন? দেখি না কারা জেতে! ”
“তুমি পাগল হয়ছো! কতক্ষণ জামাই বাবাজী গেটে দাঁড়ানো থাকবে! এখনি দশ হাজার টাকায় নামতে বলো! ” সাবিহা কড়া চোখে তাকালো।

মনসুর সাহেব সাবিহাকে বিলক্ষণ চেনেন। এই পানি গড়াতে গড়াতে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে না পড়া পর্যন্ত থামবে না। তাই ব্যাজার মুখে তিনি এগুলেন।

“আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে! দশ হাজার, ব্যাস, ঠিক আছে না? ”

বাচ্চাকাচ্চার দল কাতর ধ্বনি করে উঠলো। তার মাঝে ঝপাং করে বরের মামা মনসুর সাহেবের হাতে দশ হাজার টাকার খাম ধরিয়ে দিলেন। সাবিহা হাসিমুখে জামাইকে মিষ্টি আর সরবত খাইয়ে বরণ করে নিলেন। ডিজে মনের আনন্দে মিউজিক বাজাতে লাগলো, সবাই ডালা থেকে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে একাকার করে ফেললো। বরপক্ষ আনন্দ করতে করতে ঢুকলো। সাবিহা মনে মনে হাসলেন। ভাগ্যি বুদ্ধি করে আগেই কাবিনটা করিয়ে রেখেছিলেন সকালে। এত হট্টগোলে কি আর কাবিন করা যায়?

খাবার পরিবেশন করা শুরু হয়েছে। ছন্দাকে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি ছুটোছুটি করতে। এই টেবিলে কাবাব ঠিক মত এসেছে? ওই টেবিলে বসা বরের বন্ধুদের প্লেট তো খালি! সাবিহা এক পাশে বসে পড়েছে। আর পারছে না দৌড়াতে। বিয়ের অনুষ্ঠান যে এত পরিশ্রমের বিষয় তা সে আগে বুঝতে পারেনি। বসে বসে ছন্দা, শশী আর অন্যান্যদের নির্দেশনা দিচ্ছে। পায়ের ব্যথায় শয্যাগত হবার অবস্থা হলেও সবকিছু দেখতে হবে। মেয়ের মা যে! হঠাৎ এক কোণা থেকে ভেসে আসা গণ্ডগোলের আওয়াজে চমকে ওঠেন। কী হচ্ছে?

বরের বড় বোন বিশ্রীভাবে চিৎকার করছেন, সাথে তাল মিলিয়ে তাঁর স্বামী। সাবিহা দৌড়ে যায়।
“কী, কী হয়েছে রোকেয়া, আমাকে বলুন তো! ”
“কী হয়েছে মানে? ডেকে এনে বেইজ্জতি? হ্যাঁ? আমি জামাইএর বড় বোন। আর আমাকে কিনা আপনার ভাই বলে যে কাবাব শেষ, আর দেয়া যাবে না? ”

কাবাব শেষ! সাবিহা কিচ্ছু বুঝতে পারে না। “রবিন? ”

“আপা মাটন চপটা একটু শর্ট পড়েছে। বাবুর্চি বলছে দুইটা ট্রে নাকি মিসিং। ”

সাবিহা অসহায় ভাবে বলে, “আমি দেখছি, আমি এখনি বাইরে থেকে আনার ব্যবস্থা করছি। এই সামান্য বিষয় নিয়ে এত হৈ চৈ. . . ”

“সামান্য বিষয়! এটা আপনার কাছে সামান্য বিষয়! আপনার মেয়ের ভাগ্য যে আমার ভাই রাজি হয়েছে তাকে বিয়ে করতে। আর কাবাব শর্ট পড়বে না? মেয়ের যে স্বাস্থ্য! দেখেই বোঝা যায় খাবার কম পড়বে কী পড়বে না! ”

“এভাবে বিশ্রীভাবে কথা বলছেন কেন? ” ভাগ্নির অপমানে এবারে রবিন খেপে ওঠে। “আপনাদের ছেলেও বা কী এমন হীরার টুকরা! ”

“হীরার টুকরা না হলে এভাবে পিছে লেগে থেকে মেয়েকে গছান? আমার মাকে সোজা সরল পেয়ে আপনারা যা তা বুঝিয়ে রাজি করিয়েছেন। আমি যদি দেশে থাকতাম তাহলে এরকম একটা মেয়ের সাথে জীবনেও আমার ভাইয়ের বিয়ে দিতাম না। ”

সাবিহার মনে হতে থাকে সে এখনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। এসব কেন হচ্ছে? সবাই এভাবে চেঁচাচ্ছে কেন? অপি শুনে ফেলবে তো! তার কাঁপুনি দেখে ছন্দা এসে তাকে ধরে ফেলে। সাবিহার মনে হতে থাকে পৃথিবী থেকে সব আলো একটা একটা করে নিভে যাচ্ছে। ছন্দা তাকে ঠেলে একটা ছোট স্টোররুম জাতীয় কামরায় ঢুকিয়ে মাথায় পানির ছিটা দিতে থাকে। এর মাঝে ছন্দা পানি কোথায় পেলো?

“আপা, তোমার কি এখন একটু ভালো লাগছে? ”
“ছন্দা, তুই একটু ওখানে যা। রবিনকে হল্লা করতে মানা কর। অপি সব শুনে ফেলবে। আমার মেয়েটা খুব নরম, প্লিজ তুই যা। ”
“আপা তুমি একটু শান্ত হও। আমি অপির কোন অপমান হতে দেবো না। ”

লেখক
লেখক

সাবিহা ছন্দার গমনপথের দিকে বজ্রাহতের মত চেয়ে থাকে। ছন্দা তার মেয়ের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে, সে নিজে কি শাণিত ছুরির ফলা হয়ে ছন্দার বুকে একদিন বেঁধেনি? একেই কি বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ?

তবে ছন্দার সাথে যা হয়েছে তা কি সাবিহা বুঝে শুনে করেছে? ছোটবেলা থেকেই ঠিক করা ছিল যে রবিনের সাথে সোহার বিয়ে হবে। সোহা সাবিহাদের দূরসম্পর্কের কাজিন হলেও সবচেয়ে আদরের। প্রথমে খেলাচ্ছলে এবং শেষ পর্যন্ত পরিবারের সব মুরুব্বীরাই একমত। সোহা সবার অতি আদরের। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকুক। সবকিছু ঠিক ঠাক, মাঝখান দিয়ে রবিনটা বাগড়া বাঁধিয়ে বসলো। ভার্সিটি পাশ দিয়ে সে লায়েক হয়েছে। সোহা নাকি তার বোন আর বোনকে কোনভাবেই ওই দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব না। ঘরের মাঝে বিয়ে নাকি মধ্যযুগীয় চিন্তা ভাবনা।

প্রথমে সাবিহা ভেবেছিলো সবাই মিলে বসে চাপ সৃষ্টি করলে ঠিকই রবিন রাজি হয়ে যাবে। আর রবিনই বা কী এমন ছেলে? আর তাছাড়া রবিনের যখন মাত্র দশ বছর বয়স তখনই তার বাবা মারা যায়। সাবিহারা কি তাদের এতদিন দেখে শুনে রাখেনি? ফুপুকে যখন চাকরির জন্য দীর্ঘ সময় বাইরে থাকতে হতো, রবিন তো ওদের বাসাতেই থাকতো। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হওয়া। বিলক্ষণ সে জানে রবিন কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না। ভয়াবহ মাতৃআজ্ঞাকারী রবিন কিছুতেই যে তার মা’র কথা ফেলতে পারবে না সে নিয়ে সাবিয়া নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু মানব জীবনের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে সবচেয়ে কাছের মানুষটিকেও সবসময় ঠিকমত বুঝতে পারার অক্ষমতা। রবিনের যে কারো সাথে প্রেম থাকতে পারে সেটি ঘুণাক্ষরেও সাবিহার কল্পনাতে আসেনি।

ছন্দার কথা জানামাত্র কত হাঙ্গামাই যে সাবিহা করেছিলো তখন। রবিনের মা, অর্থাৎ তার ফুপুকে ইচ্ছেমতন কথা শুনিয়েছে সে। পারিবারিক বৈঠক ডেকে রবিনদের এক ঘরে করার মত অবস্থা করেছিলো সে। কিন্তু রবিনও একরোখা। সে বিয়ে করবে এবং ছন্দাকেই করবে - ব্যাস দ্বিতীয় আর কোন কথা নেই। শেষকালে সাবিহার বড় চাচা তার হাত ধরে ছোট ভাইকে ক্ষমা করে দিতে অনুরোধ করায় সে জেদ মনে চেপে রেখেই বিয়েতে মত দিয়েছিলো। তবে অপমানের হিসেব সে বিয়েতে নিয়েছে কড়ায় গণ্ডায়।

ছন্দাকে দেখেই সাবিহা নাক কুঁচকেছিল। এ কি মেয়ে? একে তো কাঠির মত শুকনো, তার ওপর গায়ের রঙটি কালো। তার ফুপু অবশ্য আহ্লাদ করে ছেলের বউকে শ্যামবর্ণ হিসেবে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, কিন্তু সাবিহার মতে ওটি কালোই। মাথায় চুলও কম, কান বরাবর ছাটা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। এরকম একটা মেয়েকে তার হ্যান্ডসাম ফুপাতো ভাইয়ের পাশে কেমন দেখা যাবে আর লোকেই বা বলবে কী? রবিনের পছন্দ দেখে সাবিহা হতভম্ব। তাদের পছন্দের মেয়ে রেখে এই গেছো পেত্মীকে বিয়ে করার জন্য ছেলে এত অস্থির?

মেয়ের বাসার অবস্থাও সাবিহার পছন্দ হয়নি। মেয়ের রুমে বিশাল আলমারি ভর্তি বই। এই করে করেই নির্ঘাত চোখে চশমা উঠেছে। ছন্দাদের পরিবার একেবারেই মধ্যবিত্ত পরিবার। তবে পরিবারের প্রতিটি সদস্য শিক্ষিত। বড় চাচা ছন্দার বাবার সাথে কথা বলে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে সাবিহা স্পষ্ট করে মেয়ের প্রতিটি খুঁত ধরিয়ে দেবার পরেও তিনি হাসিমুখে মেয়ের হাতে আংটি পরিয়ে দিলেন। অসহ্য রাগে সাবিহার গা জ্বলে গেলো।

বিয়ের দিন সাবিহা ইচ্ছে করেই দেরী করে পার্লারে সাজতে গেলো। শুক্রবার দিন সন্ধ্যায় উত্তরার অসম্ভব জ্যাম ছিল বরাবরের মতই। সোহা আর শশী - দুইজনের সাজ শেষ হবার পর সাবিহা সাজতে বসলো। কারণ নয়ন নামের মেয়েটিই সবচেয়ে ভালো সাজায়। সোহা অনেকবার অন্য মেয়ের কাছে সাজতে চেয়েছিল যেন তাড়াতাড়ি সাজগোজ শেষ হয়, সাবিহা ধমকে থামিয়েছিল। এত তাড়াহুড়া কিসের? তারা কি মেয়েপক্ষ যে একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে সব করতে হবে?

ওদিকে মুহুর্মুহু ফোনের রিংটোনের শব্দে পার্লার প্রকম্পিত। সাবিহা ফোন ধরার কোন আগ্রহই দেখালো না। শেষকালে অপরিচিত একটি মেয়ে যখন ফোন বন্ধ করতে বললো তখন সে তার মা’র ফোন ধরলো। বিরক্ত গলায় জানালো যে তারা না আসা পর্যন্ত যেন বরযাত্রী রওনা না হয়।

দুই ঘণ্টা পেরিয়ে যাবার পরেও সাবিহা না ফেরায় সবাই বিয়ের আসরে চলে গেলো। সাবিহার বড় চাচা কন্যাপক্ষকে কারণ ছাড়া অপেক্ষা করানোটা একেবারেই পছন্দ করছিলেন না। আর তাছাড়া শীতের রাত্তিরে সবকিছু শুনশান হবার আগেই বউ নিয়ে বাসায় ফিরতে চান। বউয়ের গায়ে সোনার গহনা থাকবে, দিনকালের কোনো ভরসা আছে?

বিয়ের আসরের প্রতিটি মুহুর্ত এখনো চোখ বন্ধ করলেই সাবিহার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাকে না নিয়েই বিয়ের আসরে চলে যাওয়ায় উপস্থিত পাঁচশো মানুষের সামনে চেঁচিয়ে রাগারাগি করে বিশাল সিন ক্রিয়েট করেছিলো সে। এমনকি ওয়েটারের হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিয়ে আছড়ে ভেঙে কোলাহল পূর্ণ কমিউনিটি সেন্টারটিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিলো।

‘শখ করে ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে ঘোরা কাউলা মেয়ে ঘরে আনতেছেন তো ফুপু, আমার কথা বাসী হলে পরে বুঝবেন! সে আপনার ছেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। আপনি তখন বৃদ্ধাশ্রমের মেঝে ঝাঁট দিয়েন। ’

“চুপ চুপ, কী বলছিস এসব” - বড় চাচী কড়া গলায় একটু জোরেই বলেছিলেন।

“থাক, আপনি আর কথা বইলেন না। আপনার নিজের বাচ্চা তো হয়ই নাই, এইজন্য রবিন অজায়গায় কুজায়গায় বিয়ে করলে আপনার কী? ”

হতভম্ব বড় চাচীর গাল বেয়ে নীরব অশ্রু ঝরছিল, কতকটা অপমানে আর কতকটা অবিশ্বাসে। আজ মনে করে সাবিহার ভেতরটা মরমে মরে গেলো। কেমন করে কথাগুলো বলেছিলো সে? জননীর মত স্নেহ করে তাদের বড় করা বড় চাচীর সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটা কেমন করে সে সবার সামনে নগ্ন করে দিতে পারলো?

এত কথা বলেও সাবিহার ক্ষোভ মেটেনি সেদিন। ছন্দার মামী-খালারা তাকে শান্ত করতে আসলে তাদের যা তা বলেছিলো সে।
“আপনারা এত কথা বলতে আসেন কেন? এটা আমাদের পরিবারের নিজস্ব ব্যাপার। মেয়েকে তো ঠিক শিক্ষা দিয়েই বড় করেছেন। শাঁকচুন্নির মত চেহারা! কি যাদু টোনা করে আমার ভাইকে বশ করেছে আল্লাহ জানেন। লিখে রাখেন আপনারা, আপনাদের মেয়ে আমাদের সবার জীবন ধ্বংস করে দেবে। ”

হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলায় এক মুহুর্তের জন্য সাবিহাকে থামতে হয়েছিল। চোখ তুলে সে দেখলো লাল শাড়িতে বধূ সাজের ছন্দা কোন ফাঁকে স্টেজ থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে চুপচাপ। তার চোখে অশ্রু নেই, দুঃখ কিংবা ক্রোধও নেই। চশমা বিহীন বড় বড় চক্ষু দু’টি জুড়ে আছে রাজ্যের বিস্ময়। সাবিহা হিংস্র ভাবে তাকিয়েছিল তার দিকে। ছন্দা একবারের জন্যও চোখ সরায়নি। রবিন কিছু বলতে এগুতে চাইলে এক হাত দিয়ে ছন্দা রবিনকে আটকেছিল। বিস্মিত চোখ জোড়া স্থির ভাবে সে নিবদ্ধ করেছিল সাবিহার চোখের ওপর। চোখের খেলায় সাবিহা সেদিন হেরে গিয়েছিল। যে মেয়ের লোকলজ্জ্বার ভয় নেই, নিজের লড়াই লড়তে প্রিয়জনকেও সাথে নেয় না, কটু বাক্য শুনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে - সে মেয়েকে হারানোর উপায় কী?

আজ এত বছর পর সাবিহা আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। মেয়ের দুঃখে নয়, নিজের দীনতায়; নিজের ক্ষুদ্রতায়। অপি যেমন নিষ্পাপ, ছন্দারও তো কোন দোষ ছিল না। তারই ভাইকে অন্তর দিয়ে ভালবেসেছিল, সেই ছিল ছন্দার একমাত্র অপরাধ।

“আপা. . . ”
চোখ মুছতে মুছতে ছন্দার দিকে তাকায় সাবিহা। “কী রে বোন? ”
“আপা, ওরা খুব আজেবাজে কথা বলেছে। ”
“তারপর? ”
“আপা তুমি ঠিক আছো তো? এখন তোমার শক্ত থাকা খুব দরকার। দুলাভাই হাউ মাউ করে কাঁদছেন। ”

মনসুর সাহেব কাঁদছেন! সাবিহা বোধশূন্য হয়ে যায়। “কাঁদছে কেন? হয়েছেটা কী? ”
“ওরা বলছে ছেলে নিয়ে চলে যাবে। তুমি যদি এখন গিয়ে বরের বোনের কাছে মাফ চাও, তাহলেই শুধু মেয়ে নেবে। ”

এক মুহুর্ত লাগে সাবিহার কথাটা বুঝতে; তবে একটি মুহুর্তই তার জন্য এখন যথেষ্ট। “আমি মেয়ে দেবো না। ওদের চলে যেতে বল। ”

“আপা, তুমি বুঝে শুনে বলছো তো? অপির কিন্তু আজ সকালে ছেলের সাথে কাবিন হয়ে গেছে। মেয়ে না দেয়ার অর্থ কিন্তু ডিভোর্স করতে হবে। ”

“ডিভোর্সই হবে। আমার মেয়ের বিয়ে হবে এক দিনের বিয়ে। ”

এই প্রথম ছন্দাকে মনে হয় সাবিহা কাঁদতে দেখে। “তুমি এমন কেন করছো আপা? তুমি গিয়ে একটু ক্ষমা চাইলে কী হয়? ”

“এরকম করতে হবে ছন্দা। তোর বিয়েতে যেমন আমি সাবিহা ছিলাম, এই জামাইয়ের বোনও তেমনি একটি সাবিহা। এরকম অসংখ্য সাবিহা আছে প্রতি ঘরে ঘরে। তুই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেয়ে, তুই সাহসী, তুই স্বাবলম্বী। তাই সাবিহা ঘরে আছে যেনেও তুই রবিনের হাত ছাড়িসনি। আমার মেয়ে পড়ে ভার্সিটিতে, সবে সেকেন্ড ইয়ারে। ও জীবনের কিছুই দেখেনি। এই ছেলেকে সে এক ফোঁটাও চেনে না। তার মা তার ভালো তার চেয়ে বেশি বোঝে, এই ভরসায় সে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছে। আজ যদি আমি মেয়েকে যেতে দেই, তবে আমি আর মা থাকবো না। একটা জীবন্মৃত মেয়ের জন্মদাত্রী হয়েই থাকতে হবে সারাজীবন। তোর কাছে মাফ চাওয়ার মুখ নেই রে, অন্তত মেয়ের চোখে অপরাধী না হয়ে থাকি। ”

ছন্দা এবারে জড়িয়ে ধরে সাবিহাকে। অসম বয়সী দু’জন নারী দু’জনের কাছ থেকে ভরসা আর ভালোবাসা পাওয়ার আশায় দম বদ্ধ করা একটি কক্ষে বসে থাকে চুপচাপ। ঘুলঘুলি দিয়ে বিয়ের লাল-নীল বাতির ফিকে আলো মাকড়শার জালের ফাঁক দিয়ে ছন্দার কপালে নকশা আঁকে। সাবিহার মনে হয় নকশার মাঝে অপির মুখ খানি আঁকা। একটি মায়াবতী মেয়ের হাস্যজ্জ্বল মুখ।

*সামারা তিন্নি: মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া।