সঙ্গীদের চাপ: সন্তানদের চাওয়া ও আমরা

মা ও সন্তান। অলংকরণ: সোহাগ পারভেজ
মা ও সন্তান। অলংকরণ: সোহাগ পারভেজ

বেশ আগে থেকেই একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। নানা কারণে লিখিনি। শেষমেশ লিখেই ফেললাম আমার স্বল্প জ্ঞানে। আমি লিখি আমাদের সমস্যা উল্লেখ করে। আমার চিন্তাভাবনামাত্র, দ্বিমত থাকতে পারে। বিষয়টা বেশ সংবেদনশীল। কোনো দেশ, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ছোট বা অসম্মান করে লেখা হয়নি। আমি ক্ষমাপ্রার্থী, যদি কেউ এমন ভাবেন।

বর্তমান সময়ে আমাদের সন্তানদের চাওয়া–পাওয়া অনেক বেড়ে গেছে। যেমন ধরুন, স্মার্টফোন কেনা, বেশি দামি ক্যামেরা কেনা, ল্যাপটপ কেনা (দরকার না থাকলেও), যখন-তখন দেশের আনাচকানাচে ঘুরতে যাওয়া, নতুন বাইক কেনা বা বেশি বেশি পার্টিতে বা ঘুরতে যাওয়া, বেশ কতগুলো দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি বা কাপড়চোপড় কেনা ইত্যাদি। বেশির ভাগ সময় সন্তানদের মাথায় এসব চিন্তা আসে আশপাশের বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়–পরিজন থেকে (না, আমি কাউকে দোষারোপ করছি না বা বলছি না)। আর এসব না দিলে বা করলে সন্তানেরা ঠিকমতো পড়াশোনা বা কথা শুনতে চায় না মা–বাবার। ইংরেজিতে একটা টার্ম আছে—‘পিয়ার প্রেশার’ বাংলায় বলে ‘সঙ্গীদের চাপ’।

বাচ্চারা বড় হতে হতে বন্ধুদের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাবে এবং মা–বাবার সঙ্গে কম সময় কাটাতে শুরু করে। ফলস্বরূপ, বন্ধুরা সন্তানদের চিন্তাভাবনা ও আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি ‘সঙ্গীদের চাপ’-এর সারমর্ম। ‘সঙ্গীদের চাপ’ ইতিবাচক প্রভাব হতে পারে—উদাহরণস্বরূপ, যখন এটি আপনার সন্তানকে স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে ভালো করতে বা খেলাধুলা বা অন্যান্য ক্রিয়াকলাপে জড়িত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে। অন্যদিকে, সঙ্গীদের চাপগুলো নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যখন এটি আপনার সন্তানকে ধূমপান, মদ্যপান, মাদকদ্রব্য ব্যবহার করার চেষ্টা করতে বা অনিরাপদ সংবেদনশীল কার্যক্রম (সব দেশের জন্য বা সব ধর্মের জন্য প্রযোজ্য নয়) বা অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের দিকে প্রভাবিত করে।

‘সঙ্গীদের চাপ’ নেতিবাচক প্রভাবগুলো হ্রাস করতে এবং ইতিবাচককে সর্বাধিকতর করতে সহায়তার জন্য এখানে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—

১.
সন্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং খোলামেলা ও সৎ যোগাযোগকে উৎসাহিত করুন। যেসব সন্তানের মা-বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে, তাদের সিদ্ধান্ত বা সমস্যা সম্পর্কে মা–বাবার পরামর্শ নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
২.
‘সঙ্গীদের চাপ’ কী, তা আপনার সন্তানকে বুঝতে সহায়তা করুন। যদি সে কী ঘটছে এবং কেন, তা বুঝতে পারে, তবে নেতিবাচক প্রভাবগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে।
৩.
আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেই মানগুলোকে (ফ্যামিলি ভ্যালু) শক্তিশালী করুন। ফ্যামিলি ভ্যালু বোঝানো যেতে পারে উদাহরণ টেনে, আপনি থেকে শুরু করে আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, যাদের ভালো অর্জন, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা ইত্যাদি উদাহরণ টেনে বোঝানো যেতে পারে।
৪.
আপনার কিশোর–কিশোরী সন্তানদের নিজস্ব ক্ষমতা এবং আত্মসম্মানকে লালন করুন, যাতে তারা অন্যদের দিয়ে প্রভাবিত না হয়।
৫.
আপনার সন্তানকে কীভাবে প্রয়োজনে দৃঢ় হবে, তা শেখান এবং গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তার দৃঢ় আচরণের প্রশংসা করুন। যেমন ধরুন, স্কুলে কেউ বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে, তাতে সে যেন ভেঙে না পড়ে, শক্ত হাতে মোকাবিলা করে, রাগ বা গোলমাল না করে।
৬.
আপনার সন্তানকে একটু আলাদা ভাবনা করার সময় দিন। আপনি যেমন বলবেন, ঠিক তেমনই সন্তান করবে বলে আশা করবেন না।
৭.
বেশি ভেঙে পড়লে আপনার সন্তানকে কী করা উচিত, এর জন্য তার কাছ থেকে শুনুন এবং কী আপনার সন্তানের আচরণকে প্রভাবিত করে, এমন সমস্যাগুলো সম্পর্কে আপনি আরও আবিষ্কার করতে পারেন।
৮.
পরিবারের শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। আপনার সন্তানের বুঝতে হবে যে নেতিবাচক আচরণের ফলাফল রয়েছে।

পুনশ্চ: আমার মেয়ে এখনো অনেক ছোট, ওকে নিয়ে আমি ভয় পাই। পরিবারকে সময় দেওয়া এবং সন্তান লালনপালন অনেক কঠিন কাজ। আমি আমার মা–বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ যে আমাকে ‘সঙ্গীদের চাপ’ বা ‘পিয়ার প্রেশার’ তাঁরা বোঝাতে পেরেছিলেন এবং ফ্যামিলি ভ্যালু শক্ত রেখে যাচ্ছেন। তবে সময় অনেক পাল্টেছে, মডার্ন ট্রেন্ড এবং চোখধাঁধানো জিনিসের প্রতি আসক্তি ছোট–বড় প্রায় সবারই আছে, সন্তান লালনপালনের ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জে জয়ী কি আমি বা আমরা (নতুন বাবা-মা) হতে পারব?

তথ্যসূত্র: অস্ট্রেলিয়ান অনলাইন মিডিয়া, নিউজ পেপার। সুনির্দিষ্টভাবে কোনো রেফারেন্স দিতে চাইছি না। শুধু ভুল বোঝাবুঝি থেকে দূরে রাখার জন্য বা সব দেশ বা কালচারের সঙ্গে নাও মিলতে পারে।

*এম মাহমুদুল হাসান, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া