কঠিন এক অসুখ: পারিবারিক সহিংসতা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

চিকিৎসকদের সম্পর্কে পরিচিতজনদের একটা সাধারণ অনুযোগ হচ্ছে, কাজের সময় তাঁদের ফোন করে পাওয়া যায় না। ঘটনা সত্য। আমি নিজেও কাউকে ফোন করে পাই না। আমাকেও কেউ ফোন করে সময়মতো পায় না। তারপরও ব্যতিক্রম বলে একটা শব্দ আছে। মাঝেমধ্যে ব্যাটে বলে মিললে বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন ধরে ফেলি। এক ভরদুপুরে আমি এভাবেই একজনের ফোন ধরে ফেললাম। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর অপর প্রান্তের মানুষটির সঙ্গে আমার যে আলাপচারিতা হলো, তার জন্য আসলেই আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। ডমেস্টিক ভায়োলেন্স কিংবা পারিবারিক সহিংসতা আমরা প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে কিংবা টিভি নিউজে দেখি। কিন্তু আমাদের পরিচিত কারও সঙ্গে কিংবা আমাদের নিজেদের সঙ্গে যে এমনটা হতে পারে, সেটা কোনোভাবেই বিশ্বাস হতে চাই না।

পারিবারিক সহিংসতার সংজ্ঞা নিয়ে আমাদের বেশির ভাগের ধারণা অস্পষ্ট। যে সমাজে বেড়ে উঠেছি, তাতে আমি জানতাম যতক্ষণ পর্যন্ত গায়ে হাত তোলা না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। ক্ষেত্রবিশেষে দু-একটা চড়চাপড়ও কোনো ব্যাপার না। এমনকি এই শতাব্দীতে এসেও প্রতিনিয়ত ভিকটিম শেমিং করা হয়, অর্থাৎ সহিংসতার শিকার ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয়—তুমি আসলে ঠিক কী করেছিলে, যার জন্য সে তোমাকে মারল? প্রশ্নটির মাঝেই প্রশ্নকর্তার অবিশ্বাস তীব্রভাবে প্রকট। যদি কেউ কিছু না-ই করে, তবে খামোখা একজন মানুষকে কেন কষ্ট দেওয়া হবে?

আমি দু-তিন দিন আগে রাতে নিউজলেটারে একজন বাংলাদেশি জেনারেল প্রাকটিশনারের আত্মকাহিনি পড়ছিলাম। একজন চিকিৎসক যে প্রায়ই ভায়োলেন্সের শিকার নারীদের সাহায্য করছেন, তিনি নিজে আট বছর একজন অ্যাবিউসিভ স্বামীর সংসার করেছেন। তাঁর প্রতিদিনের রুটিন ছিল কাঁদতে কাঁদতে কাজে যাওয়া, ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা রোগী দেখা এবং আতঙ্ক নিয়ে বাসায় ঢোকা। অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপ এবং ফোরামে যখন কোনো নারী তাঁর অ্যাবিউসিভ জীবনকাহিনি লিখে সাহায্য চান, আমি দেখেছি তিন ধরনের কমেন্টে সেই পোস্ট ভরে যায়। এক গ্রুপ অত্যন্ত উগ্র ভাষায় বলে, এ রকম জামাইয়ের সঙ্গে থাকার কোনো মানেই হয় না। আর এক গ্রুপ বলে ধৈর্য ধরে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে এবং তৃতীয় অতি ক্ষুদ্র একটি গ্রুপ বলে, এটা তোমার প্রাপ্য নয়, নিজের পরিবারে নিরাপদ থাকার অধিকার প্রত্যেক মানুষের আছে এবং তুমি যদি চাও আমি বলতে পারি কে কী ধরনের সাহায্য তোমায় দিতে পারে। সমস্যা হচ্ছে, এই গ্রুপের মন্তব্য বাকি দুই গ্রুপের মার মার কাট কাট ধরনের বাগ্‌বিতণ্ডায় প্রায়ই চাপা পড়ে যায়। আট বছরের দীর্ঘ সংসারে সেই চিকিৎসক অনেকবার তাঁর পরিচিতজনদের কাছে সাহায্য চেয়েছেন, সিদ্ধান্ত চেয়েছেন। তাঁকে বলা হয়েছে, তুমি বেশি ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড, তুমি বেশি ডিমান্ডিং। অথবা তোমার জামাই একটা অমানুষ এবং তুমি এখনই বাসা থেকে বাচ্চা নিয়ে বের হয়ে যাও। দুই ধরনের পরামর্শই ভিকটিমের কানে আসে এভাবে, ‘তুমি তোমার কারণেই অত্যাচারিত হচ্ছ, হয় তুমি দোষী, নয় দুর্বল।’

পারিবারিক সহিংসতা যে কী ভয়াবহ ব্যাপার, সেটা প্রথম টের পেয়েছিলাম আমার খুব কাছের একজন মানুষ তাঁর কাহিনি যখন বলেছিলেন। আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম তাঁর ভীতি, আমি কি তাঁকে জাজ করছি? আমি কি বিশ্বাস করছি তাঁর কথা? কারণ, যাঁকে নিয়ে বলা হচ্ছে আমি যে তাঁকেও চিনি এবং বেশ পছন্দ করি। কথা বলার একপর্যায়ে আমি সত্যিকার অর্থে ঘামাতে শুরু করলাম। কারণ, আমি আর নিতে পারছিলাম না তাঁর কষ্ট। ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের সব কাউন্সেলিং তুচ্ছ করে আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, তুমি প্লিজ এ সম্পর্ক থেকে বের হয়ে যাও, আমি সাহায্য করব। আপনজনেরা এই ভুলটিই করে বসেন। তাঁরা কষ্ট নিতে না পেরে জোরপূর্বক সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভবত সেটি সঠিক পরামর্শ। শুধু বলার ভঙ্গির কারণে এই পরামর্শ ভিকটিমকে কোনো সাহায্য করতে পারে না। বরং তিনি আরও গুটিয়ে যান। তাহলে আসলে আমরা করবটা কী?

সাহায্য করার আগে জানা দরকার পারিবারিক সহিংসতার অর্থ কী? শরীরে আঘাত করা কিংবা কোনো অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখানো যে সহিংসতা, সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা যেটা জানি না সেটা হচ্ছে, ডমেস্টিক অ্যাবিউস হচ্ছে একধরনের বিধ্বংসী আচরণ, যা দ্বারা একজন চায় আরেকজনের ওপরে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে। এ আচরণ হতে পারে শারীরিক কিংবা মানসিক। সত্যি বলতে কি, মানসিক আঘাত শারীরিক আঘাতের চেয়ে বহুগুণে ধ্বংসাত্মক। ক্রমাগত হীন আচরণের শিকার একজন ব্যক্তি নিজের ওপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করতে থাকেন। একজন অ্যাবিউসিভ ব্যক্তি সেটির সুযোগ নেন এবং তাঁকে আরও মানসিক চাপের মাঝে ঠেলে দেন, যার পরিণতি বেশির ভাগ সময়ে হয় ভয়াবহ। যেসব ব্যবহারকে সাধারণত সহিংসতা বলে জ্ঞান করা হয় না, সেগুলোর কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে—

১.
দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্রমাগত ভয়ভীতি দেখানো (যেমন, তুমি যদি এখন সবাইকে বলে দাও তাহলে তোমার বাবা-মা সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না)।
২.
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ (ব্যক্তির অর্জিত অর্থ তাঁকে খরচ করতে না দেওয়া কিংবা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ভরণপোষণ না দেওয়া)।
৩.
বাচ্চাদের সামনে অথবা বাইরের মানুষের সামনে ইচ্ছাপূর্বক হেয় করা।
৪.
স্টকিং কিংবা নজরদারিতে রাখা। অর্থাৎ কারণ ছাড়া সব সময় সন্দেহ প্রকাশ, ই-মেইল কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাসওয়ার্ড দিতে বাধ্য করা, ব্যক্তি মতামত প্রকাশে বাধা দেওয়া, অনুমতি ব্যতীত লুকিয়ে মেসেজ চেক করা ইত্যাদি।
৫.
বন্ধু কিংবা পরিবারের মানুষদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা।
৬.
প্রতিটি মুহূর্তের খবর জানতে চাওয়া এবং অবিশ্বাস করা।
৭.
যৌন হয়রানি।
৮.
নেম কলিং কিংবা এমন নামে ডাকা, যাতে ব্যক্তি কষ্ট পান।
৯.
চেহারা, পোশাক, দুর্বলতা ইত্যাদি নিয়ে রূঢ় কথা বলা অথবা সবার সামনে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।

আপাতদৃষ্টিতে ওপরের অনেক উদাহরণকেই সাধারণ কিংবা বাড়াবাড়ি মনে হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। একবার কপালে কাটা দাগ আর বাহুতে কালশিটে নিয়ে ২২ বছরের এক মেয়ে আমাকে বলছিলেন, ‘তিনি (স্বামী) বলে যে আমাকে কেউ পছন্দ করবে না, আমি এত বিশ্রী দেখতে। সে তো ভুল বলে না। আমি ওকে ছেড়ে চলে গেলে সারা জীবন আমাকে একা থাকতে হবে।’ অথচ আমার চোখে মেয়েটি ছিল পরির মতো সুন্দর। তিন বছর ধরে ভয়ংকর নির্যাতনের একটা সম্পর্ক সে চালিয়ে যাচ্ছে একাকিত্বের তীব্র ভয়ে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একজন ব্যক্তি এ রকম অত্যাচার দিনের পর দিন সহ্য করে যান।

একজন মানুষ যে কিনা সৌভাগ্যবশত কখনো অত্যাচারের সম্মুখীন হননি, তাঁর কাছে ব্যাপারটা অচিন্তনীয়ই বটে। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে এটা সাদা-কালো ডোরাকাটা কোনো সমস্যা নয়। ধূসর রঙে সমস্যাটি ঘেরা। প্রথম এবং প্রধান সমস্যা হচ্ছে, এমন একজন মানুষের কাছ থেকে ভিকটিম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যাঁকে তিনি আপনজন মনে করেন। ভালোবেসে বিয়ে করেছেন কিংবা জীবনের অনেক কিছুর জন্য সেই মানুষটির ওপর তিনি নির্ভর করেন। বিশেষ করে ঘরে যদি কোনো শিশু থাকে, তবে ব্যাপারটি আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। পারিবারিক চাপ, সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক চাপ এবং আত্মবিশ্বাসহীনতার মতো সাধারণ কারণ ছাড়াও কেন একজন ব্যক্তি একটি অবমাননাকর সম্পর্ক থেকে বেরোতে পারে না, সে ব্যাপারে ড. লিওনর ওয়াকারের একটি থিওরি আছে—সাইকেল অব ভায়োলেন্স।

এই সাইকেলের তিনটি ধাপ। প্রথমটি হচ্ছে টেনশন বিল্ডিং। এই ধাপে সাধারণত গৃহে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সামান্য কিছুতেই অনেক রাগারাগি, চিৎকার, ঝগড়া ইত্যাদি হতে পারে। শেমিং, নেম কলিং, সন্দেহ ইত্যাদি এই ধাপেই হয়। ভিকটিম সাধারণত এই ধাপে নিশ্চুপ থেকে কিংবা নিজেকে সরিয়ে নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে এক্সপ্লোশন, অর্থাৎ অ্যাবিউসার ধ্বংসাত্মক আচরণ করে যেটা হতে পারে শারীরিক, ঘরের জিনিস ভাঙা অথবা মানসিক। শেষ ধাপকে বলা হয় হানিমুন ফেজ। হানিমুন ফেজে তিন ধরনের ব্যবহার দেখা যায়। অ্যাবিউসার অনুশোচনা অনুভব করেন এবং নিজের ব্যবহারকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। যেমন ‘আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল কিংবা তুমি তো জান তুমি এ রকম কথা বললে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারি না’ ইত্যাদি। অথবা সে হয় ভিকটিমকে অথবা অন্য কিছুকে দোষ দেওয়ার চেষ্টা করে। এই পর্যায়ে বেশির ভাগ সময়ে অ্যাবিউসার সংসারের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। বারবার ক্ষমাপ্রার্থনা, উপহার কিনে দেওয়া, ঘরের কাজে সাহায্য করা ইত্যাদি ব্যবহার দেখা যায়। এ পর্যায়ে ভিকটিম আশ্বস্ত হয় যে সম্ভবত সহিংসতা আর কখনো তাঁদের সংসারে কালো ছায়া ফেলবে না, ক্ষণিকের ভুল ছিল সেটা। এরপর আসে ‘ডিনায়েল ফেজ’। অ্যাবিউসার এবং ভিকটিম দুজনেই আগের ঘটনাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যান। ভিকটিম নিজেকে আশ্বস্ত করে যে একই ভুল বারবার নিশ্চয়ই ঘটবে না, আর কে না জানে যে সংসার বা সম্পর্ক মানেই হচ্ছে ত্যাগ স্বীকার করা। সমস্যা হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে হানিমুন ফেজ ধীরে ধীরে জীবন থেকে ফিকে হয়ে যায় এবং টেনশন বিল্ডিং ফেজ ফিরে আসে। পৃথিবীর কোনো মানুষ যেমন ফেরেশতা নয়, তেমনি শয়তানও নয়। এ ক্ষেত্রে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের একটি বিখ্যাত লাইন ব্যবহার না করে পারছি না, ‘পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে কিন্তু খারাপ বাবা একটিও নেই।’ সুতরাং ভিকটিম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আশায় থাকেন যে তাঁর ভালোবাসার মানুষটি অবশ্যই বদলাবেন।

সাইকেল যে কখনো ভাঙা পড়ে না, তাও কিন্তু নয়। কিছু মানুষ হয়তো আসলেই বদলায়। কিছু ক্ষেত্রে সাইকেলের মাঝের বিরতি কয়েক বছর অবধি গড়াতে পারে। আশা করি বোঝাতে পেরেছি কেন একজন ভিকটিমের জন্য ‘ডিভোর্স নিলেই পার’ পরামর্শটি সব সময় উপযুক্ত পরামর্শ হয়ে উঠতে পারে না।

‘মাই ফ্রেন্ড সেইড আই শুড গেট আ ডিভোর্স। ওয়েল, আই ফাইল্ড ফর ওয়ান। নাউ মাই ফ্রেন্ড ইজ সেয়িং আই শুড নট বি সো হ্যাপি। ডাজন্ট ডিভোর্স মিন হ্যাপিনেস?’ কথাগুলো আমাকে আমার বয়সী একজন নারী বলেছিলেন এবং আমি এখনো ভুলতে পারি না। কথাটা তিনি হাসতে হাসতেই বলেছিলেন, কিন্তু আমি কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাঁর আনন্দ স্বাভাবিক নয়। প্রচণ্ড মানসিক চাপে তাঁর বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার হয়েছে। এটা এমন একটা মানসিক অসুখ, সেখানে কিছু সময় রোগী ম্যানিক কিংবা সাদা কথায় ভীষণ আনন্দ এবং উত্তেজনায় ভরপুর থাকে কিছু সময় থাকেন প্রবল বিষণ্নতায়। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর একটি চমৎকার জীবন ছিল। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভালো চাকরি করেন, ফুটফুটে দুটি বাচ্চা, গত ক্রিসমাস হলিডেতে গ্রিস ঘুরে এসেছেন। তিনি কিছুতেই স্বীকার করতে চাইছিলেন না নিজের কাছে যে তিনি পারিবারিক সহিংসতার শিকার। সম্ভবত কখনো স্বীকার করতেনও না যদি একদিন ছোট বাচ্চাটা ভয় পেয়ে প্রতিবেশীকে বলে না দিত। সেদিন ডিউটি শেষে আমি অসম্ভব ডিস্টার্বড ছিলাম এবং রাতে ঘুমাতে পারছিলাম না। নিজেকে অথর্ব মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম আমি তাঁকে কোনো সাহায্য করতে পারিনি। পারিবারিক সহিংসতার রোগী ডিল করা আমার কাছে কোনোভাবেই সহজ মনে হয় না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম তাঁর মনের দ্বিধা। কেমন করে তিনি পারবেন সেই মানুষটিকে ঘৃণা করতে যিনি তাঁর প্রথম অ্যানিভার্সারিতে লাল গোলাপের বাগান সাজিয়ে ফেলেছিলেন? কীভাবে মেনে নেবেন যে যার জন্য তিনি তাঁর পরিবার ছেড়ে আরেক দেশে পাড়ি জমিয়েছেন, তাঁকে এত কষ্ট দিচ্ছেন? পরের দিন আমি কনসালট্যান্টের সঙ্গে কথা বললাম। হাউ ক্যান আই হেল্প হার? উত্তরটা সহজ—তাঁর বাইপোলার ট্রিট করার চেষ্টা করা যাক, কারণ সেটি মেডিকেল প্রবলেম। আর তার প্রধান সমস্যার সাহায্য? ইউ ক্যান জাস্ট লিসেন অ্যান্ড হেল্প হোয়েন শি ইজ রেডি।

শুধু তাঁর মনের কথা শোনো। এবং আমি তাই করেছি। একপর্যায়ে আবিষ্কার করেছি, কিছু সমস্যা এমন থাকে, যার এক লাইনের সমাধান থাকে না। অন্তত বাইরের কেউ সমাধান দিতে পারে না। সমাধান যদি করতে হয়, তবে করতে হয় তা নিজেকেই। পারিবারিক সহিংসতা ঠিক সে রকম একটি সমস্যা। ভিকটিম প্রকৃতপক্ষে কী পরিস্থিতিতে আছে, তার মানসিক শক্তি কতটুকু—এগুলো জানা অন্য কারও পক্ষে অসম্ভব। আমরা ততটুকুই জানতে পারি যতটুকু সে আমাদের বলছে। রিসার্চে দেখা গেছে শতকরা ৮০ ভাগ নারী অনেক রেখে ঢেকে তাঁদের সমস্যার কথা জানান। প্রাণ সংশয় না হলে খুব অল্প নারীই তাঁদের প্রকৃত সমস্যা খুলে বলেন। কেন তাঁরা সমস্যার কথা বলতে পারেন না, সেটির উত্তর সাইকেল অব ভায়োলেন্স খুব ভালোভাবেই দেয়। আমরা সবাই সবকিছু জানি, কিন্তু জানা এবং করার মাঝে বিস্তর ব্যবধান। কিছুটা পানিতে না নেমে বই পড়ে সাঁতার শেখার মতো অবস্থা।

তাহলে আমাদের করা উচিত কী? উত্তর সহজ কিন্তু করা ভীষণ কঠিন। উপদেশ দেওয়া আমাদের বেশির ভাগের মজ্জাগত অভ্যাস। কেউ যখন তাঁদের জীবনের কঠিনতম মুহূর্তের কথা সাহস করে বলে, তখন দরকার তাঁকে দোষ না দিয়ে ধৈর্য ধরে শোনা। কোনো উপদেশ কিংবা পরামর্শ না—জাস্ট লিসেন। তাঁকে জানানো যে এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং সে কোনোভাবেই দায়ী নয়। তাঁকে জানানো যে কেউ তাঁর পাশে আছে এবং যখনই তিনি সাহায্য চাইবেন, কেউ এসে তাঁর হাত ধরবেন। ব্যাপারটি যিনি শোনেন তাঁর জন্যও সহজ নয়। প্রায়ই দেখা যায় যিনি সাহায্য করেন, তিনিও প্রবল মানসিক চাপ অনুভব করেন। এটাকে বলা হয় ভাইকারিয়াস ট্রমা। একবার একটা আর্টিকেলে পড়ছিলাম যে বেশির ভাগ নারীর অন্তত সাত থেকে দশটি প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় একটা নির্যাতিত সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার জন্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ প্রচেষ্টায় কয়েক বছর গড়িয়ে যায়।

সুতরাং টেক হোম মেসেজ হচ্ছে, বিশ্বাস করুন এবং কথা শুনুন। সব সমস্যার সমাধান বড়ি গিলিয়ে সম্ভব নয়। কিছু সমস্যার সমাধান হয় সময়ে। ধৈর্য ধরে পাশে থেকে একজন ভিকটিমকে তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে দিন। সব সময় সেই সিদ্ধান্ত আপনার কাছে সঠিক বলে মনে হবে না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের ভুললে চলবে না, দিন শেষে তাঁর জীবনের ওপর তাঁর অধিকার এক শ ভাগ। আমরা তো নিমিত্ত মাত্র।

সামারা তিন্নি: মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া।