প্রবাসজীবনের বন্ধু ও অন্যান্য

ছবি: লেখক
ছবি: লেখক

সিঙ্গাপুরে আসার জন্য যখন সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে গেল, তখন থেকে ভাবতে শুরু করলাম দেশটি সম্পর্কে। দেশটি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। যে দেশে যাইনি সে দেশের নানান বিষয় সম্পর্কে জানার প্রশ্নই আসে না। মানুষের মুখে যতটুকু শুনতাম, তাই বিশ্বাস করতাম। লোকমুখে শুনে তেমন কোনো ধারণা হতো না।

নিজে নিজে ভাবতাম, একটা অপরিচিত দেশে যাব সেখানে কীভাবে একা একা থাকব! কেউ আমার পরিচিত নয়। আসার আগে চিনতাম, আমার পরিবার আর দেশের মানুষ। তা ছাড়া আর কাউকে চেনার কথাও নয়। এভাবে চেনা না চেনার মধ্য দিয়ে দিনগুলো পার করতে লাগলাম।

বাংলাদেশ থেকে আমরা মোট ৪০ জন একসঙ্গে এসেছিলাম। তখন আমি চিনতাম ৩৯ জন মানুষকে। আমি ছাড়া ৩৯ জন ছিল আমার পরিচিত। তারাই ছিল আমার স্বজন। তারাই ছিল আমার দ্বিতীয় জীবনের বন্ধু। সব সুবিধা-অসুবিধা সেই ৩৯ জনকে নিয়ে। কোম্পানির এইচআর আমাদের নিয়ে এসেছিল কিয়ান টেক নামক জায়গায়।

সিঙ্গাপুর আসার আগে বুঝতাম না সে দেশের মানুষগুলো দেখতে কেমন! মানুষের ব্যবহার কেমন। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, গাছগাছালি এসবই বা দেখতে কেমন। আসার পর সব কৌতূহল নিজ চোখে দেখতে শুরু করলাম। রান্না করতে জানতান না। এ দেশে রান্না করার জন্য কাজের কেউ নেই। আমাদের দেশে রান্নাবান্না নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু এ দেশে নিজের কাজ নিজে করতে হয়।

সিঙ্গাপুরে আসার পর কোম্পানির মানবসম্পদ বিভাগ আমাদের প্রত্যেকের হাতে ২০০ সিঙ্গাপুর ডলার অগ্রিম দিয়েছিল। যদিও প্রত্যেকে দেশ থেকে আসার আগে সামান্য কিছু সিঙ্গাপুর ডলার সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।

চারজন সদস্য হয়ে একটা গ্রুপ তৈরি করে সংসার শুরু করলাম। সেটা হলো আমার প্রবাসজীবনের প্রথম সংসার। পুরুষ মানুষের সংসার। একজনের কাছে হিসাবের সব দায়িত্ব দিয়ে শুরু করলাম সংসার। স্বল্পপরিসরে হাঁড়িপাতিল, চালডাল, তেল, লবণ, মসলা, তরকারি ছাড়া আরও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনলাম। প্রথম কদিন চারজনে মিলে রান্নার কাজ শুরু করে দিলাম। যেহেতু কেউ রান্না করা আগে থেকে জানতাম না, সেহেতু সবাই একসঙ্গে রান্নার কাজ করতাম। কদিন যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম একেকজন একেক দিন রান্না করবে।

মাছ-মাংস কেউ রান্না করতে পারতাম না। শুধু নিরামিষ তরকারি, ডিম, ডাল, আলুভর্তা রান্না চলতে লাগল। আমরা কেউ রান্না জানতাম না! যে যা রান্না করত তা–ই ভালো লাগত। প্রথম প্রথম যদিও খেতে পারতাম না, কিন্তু উপায় ছিল না। পরে সব মেনে নিতে লাগলাম। জিবের মুখরোচক সব স্বাধ ত্যাগ করে ধীরে ধীরে বাস্তবজীবনের স্বাধের প্রেমে পড়ে গেলাম। কে কী রান্না করল, সেটা কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। পেটের ক্ষুধা নিবারণ করার কাছে কোনো স্বাধ খুঁজতাম না। যা কিছু রান্না করা হতো, সবই অমৃতসম মনে হতো।

অনেক দিন হলো নিরামিষ, ডাল, আলুভর্তা, ডিম খাওয়া হচ্ছে—এখন থেকে মাছ-মাংস খাওয়া হবে। সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন থেকে মাছ-মাংস রান্নার চেষ্টা করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লটারির মাধ্যমে রান্নার মেনু ভাগ করা হলো। চারজন চার দিন একেক রকম আইটেম রান্না করবে। আইটেম রাখা হলো মাছ, মাংস, ডিম, আলুভর্তা-ডাল। আমি অনেক আশা করেছিলাম আমার ভাগে যেন আলুভর্তা আর ডাল রান্নার মেনুটা পড়ে! কিন্তু, তা আর হলো না! আমার ভাগে পড়ল মাছ রান্না।

তিনজন তিন দিন রান্না শেষ করল এবার এল আমার পালা। কেনা হলো কই মাছ। দোকান থেকে পরিষ্কার করে বাসায় আনার পর ভালোভাবে লবণ-হলুদ দিয়ে ধুয়ে শুরু করলাম প্রবাসজীবনের প্রথম মাছ রান্না! রান্না শেষে তরকারি নামানোর কিছুক্ষণ পর দেখি কই মাছের লেজ আর পিঠের ওপর ছোট ছোট আঁশ রয়ে গেছে! তখন কী আর করা, ফেলে দিলাম সব রান্না তরকারি। আবার সেই ডিমভাজি। কাটিয়ে দিলাম একটি রাত! সেই থেকে আজ পর্যন্ত কই মাছ খাওয়ার প্রতি আর কোনো আগ্রহ দেখাই না!

একেক দিন একেকজন রুটিন অনুযায়ী বাজার করতাম। বাজার করা, রান্না করা, কাপড়চোপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা এসব করতে লাগলাম। প্রতিদিন একজন একজন সিরিয়াল অনুযায়ী ঘর পরিষ্কার করা ছাড়াও প্রতি মাসের শেষে যৌথভাবে ঘর পরিষ্কার করতে লাগলাম।

প্রতিদিন সকাল পাঁচটার সময় ঘুম থেকে উঠতে হতো। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। তবু উঠতে হতো! আস্তে আস্তে দেশের সব আরাম-আয়েশ এ দেশে এসে ভুলতে লাগলাম। তখন দেশে রেখে আসা প্রিয়জনদের কথা খুবই মনে পড়ত। যখন সময় পেতাম সবার সঙ্গে টেলিফোনে হাসিমুখে কথা বলতাম। কাউকে কিছুই বুঝতে দিতাম না। মা বুঝতে পারত কি না, জানি না। তবে আমি এমনভাবে কথা বলতাম, বোঝার কোনো সুযোগ ছিল না।

চেনা বন্ধুদের ছেড়ে এ দেশে এসে খুঁজে নিলাম অচেনা বন্ধু। রুমের সদস্যরা হয়ে উঠল সব থেকে আপন। হাসি-আনন্দ যতই করতাম কিন্তু শূন্যতা একটা থেকেই গেল। রুমের সবার সঙ্গে থেকে শূন্যতা ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। সেই চেষ্টা ছিল মিথ্যা চেষ্টা! নিজের সঙ্গে নিজে প্রতিটা মুহূর্ত মিথ্যা চেষ্টার অভিনয় করতাম। মনকে খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করে রীতিমতো হয়ে উঠলাম আমি এক তুখোড় অভিনেতা।