নীল পানির দেশে-২

বোল্ডার বিচের তীর ধরে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই পাথুরে চূড়া থেকে গ্রট্টো দেখা যায়। ছবি: লেখক
বোল্ডার বিচের তীর ধরে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই পাথুরে চূড়া থেকে গ্রট্টো দেখা যায়। ছবি: লেখক

অনেক কষ্টে পার্কিং ম্যানেজ করে আমরা ঢুকলাম ‘ব্রুস পেনিনসুলা ন্যাশনাল পার্ক’ টোবারমুরিতে; আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। এত বেশি মানুষ ঘুরতে আসে, এ জন্য এখন সবাইকে সময় বেঁধে দেয়। সম্রাট আগে থেকে অনলাইনে পার্কিংয়ের টিকিট কিনে রাখায় আমাদের আর কোনো সমস্যা হলো না। তবে হাতে মাত্র তিন ঘণ্টা সময়। পার্কিং থেকে গ্রট্টোতে যেতে দুই কিলোমিটার হাঁটা এবং যাওয়ার জন্য তিনটা ট্রেইল আছে। ভাবলাম, একটা দিয়ে যাই আর অন্য একটা দিয়ে ফিরে আসি। প্রথমে আমরা ‘মার লেক’ ট্রেইলটা নিলাম; ঘণ্টা দেড়েক বনের ভেতর আর কিছু সময় লেকের পাশ দিয়ে।


ট্রেইলের শেষটা একেবারে বোল্ডার বিচে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। সামনে শ্বেতশুভ্র পাথরের বিছানো রাস্তা আর তার পেছনে আকাশ আর পানি আলাদা করার কোনো উপায় নেই। বোল্ডার বিচের তীর ধরে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই পাথুরে চূড়া থেকে গ্রট্টো দেখা যায়। লাখো বছর ধরে জর্জিয়ান উপকূলের তীরে পানিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাথরের এই সূক্ষ্ম গুহা। এ যেন নীলাভ সবুজ জলরাশির ক্যানভাসে খোদাই করা পাথরের চিত্রকর্ম। গ্রট্টোর একেবারে নিচে নামতে হলে প্রায় ১২ মিটারের মতো পাথরের দেয়াল বেয়ে ঝুলে নামতে হবে। লেক হিউরনের নীলাভ পানি থেকে জেগে ওঠা রহস্যময় পাথরের চূড়াগুলো সত্যি এক নান্দনিক দৃশ্য তৈরি করেছে। পাহাড় থেকে মাটি, চিরযৌবনা সবুজ গাছের গন্ধ আর হাজারো পাখির গান। ভালুকের দেখা না পেলেও ছোট কাঠবিড়ালগুলো একটু পরপর উঁকি মেরে আমাদের দেখে আবার হারিয়ে যায়।

গ্রট্টো থেকে আরেকটু সামনে এগিয়ে ইন্ডিয়ান কোভ। তিন দিকে পাথরের পাহাড় দিয়ে ঘেরা, আরেক দিকে দিগন্তজোড়া উন্মুক্ত জলরাশি, তার মাঝখানে সুন্দর একটা বিচ। এত টলমলে পরিষ্কার পানি টোবারমুরিতে আর কোথাও নেই। এবার আর কোনো কথা নেই। পানি ঠান্ডা কেমন, তা বোঝার আগেই এক দৌড়ে সবাই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হিমশীতল পানিতে প্রতিটি হাড়ে ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে গেল। পানি এতই স্বচ্ছ যে গলাপানিতে নেমেও পা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। কিছুক্ষণ পানিতে আবার কিছুক্ষণ ওপরে উঠে পাথরের ওপর বসে সূর্যের আলোয় গরম হয়ে আবার ঝাঁপ। কোভের ওপর দিয়ে পাহাড় হয়ে একটা ট্রেইল চলে গেছে, এই ট্রেইলটা অনেক কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। সেই ক্লিফের ওপর থেকে সাহসী ছেলেমেয়েগুলো পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমাদের এত সাহস নেই, কিন্তু আমি আর রাজীব দুরুদুরু বুকে ক্লিফ থেকে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম।

নীলাভ সবুজ জলরাশি যেন ক্যানভাসে আঁকা করা চিত্রকর্ম। ছবি: লেখক
নীলাভ সবুজ জলরাশি যেন ক্যানভাসে আঁকা করা চিত্রকর্ম। ছবি: লেখক

ঘোরাঘুরি শেষে এবার পার্কিং লটে ফিরে আসার পালা। ফেরার সময় আমরা ‘জর্জিয়ান বে’ ট্রেইলটা নিলাম। বনের মধ্যে দিয়ে একেবারে গ্রামের মেঠোপথের মতো রাস্তা বানানো। সমান রাস্তা পেয়ে নামিরা, নেহান ও নুহা সামনে ছুটতে লাগল, আর আমরা ওদের অনুসরণ করতে লাগলাম। পার্কিং লটে ফিরে এবার আরেক দফা গাড়িতে রাখা সেদ্ধ ডিম, কলা ও কেক দিয়ে উদর পূর্তি করে রওনা দিলাম সবেল বিচের পথে।

নীলাভ সবুজ জলরাশি দেখতে ঢুঁ মারতে পারেন টোবারমুরিতে। ছবি: লেখক
নীলাভ সবুজ জলরাশি দেখতে ঢুঁ মারতে পারেন টোবারমুরিতে। ছবি: লেখক

টোবারমুরি থেকে ঘণ্টা খানেকের পথ সবেল বিচ। বিচে যাওয়ার পথে সবেল ফল নামে ছোট একটা ঝরনাও আছে। দুটিই আমাদের টরন্টো ফেরার পথে পরে; এ জন্যই ঘুরে যাওয়ার পরিকল্পনা। ফলটা যদিও আহামরি তেমন কিছু না, কিন্তু বিচটা আসলেই অনেক সুন্দর। সবেল বিচে গেলে মনে হয় কলাতলী বিচে চলে এসেছি। দূর থেকে প্রথমেই চোখে পড়ে দিগন্তজোড়া জলরাশি আর ঝোলানো ওয়েলকাম সাইনটা পুরোপুরি আমাদের কক্সবাজারের মতো মিলে যায়। সবচেয়ে সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায় এই বিচ থেকে। আমরা একেবারে সূর্যাস্তের একটু আগেই পৌঁছলাম। লাল টুকটুকে সূর্যটা টুপ করেই পানিতে মিলিয়ে গেল, আর পশ্চিম আকাশে রেখে গেল তার লালচে আভা। প্রচণ্ড বাতাসে ঠান্ডা লাগা শুরু হলো, আমরা আর বেশিক্ষণ বসতে পারলাম না। প্রিয় শহরটাকে বিদায় দিয়ে আমরা বাড়ির পথে রওনা হলাম।

পাহাড় থেকে মাটি, চিরযৌবনা সবুজ গাছের গন্ধ আর হাজারো পাখির গানে মুগ্ধ হন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক
পাহাড় থেকে মাটি, চিরযৌবনা সবুজ গাছের গন্ধ আর হাজারো পাখির গানে মুগ্ধ হন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক

*ফেরদৌস আমিন, টরন্টো, কানাডা