আমরা কি আসলেই একা

আমি যে বিষয় নিয়ে আজকে এই লেখা লিখছি, সেটি খুব সহজবোধ্য বিষয় নয়। তাই প্রথমে কিছু কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলব, ধৈর্য ধরে পড়তে থাকুন। পরে এর মানে বোঝা সহজ হতে পারে।

আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। কেবল হালকা গোঁফ, দাড়ি উঠতে শুরু করেছে। মেয়েদের দিকে আস্তে আস্তে ভালো করে লক্ষ করা শুরু করেছি। এইটের বৃত্তি পাওয়ার সুবাদে আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেওয়া হয়েছিল। সেই সাইকেলে করে আমি মোটামুটি ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় গলি-ঘুপচি দিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। আমার এক বন্ধু ছিল। থাকত কলোনিতে। কোন কলোনি, সেটা নাই–বা বললাম। একদিন সাইকেলে করে সেই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছি,

হঠাৎ করে চোখ পড়ল, কোনো একটা কলোনির দোতলার বারান্দায় একটা মেয়ে কেবল গোসল করে এসে চুল শুকোচ্ছে।
হয়তো চোখের ভুল কিন্তু আমার মনে হলো, সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু করে হাসছে।
পুরো ব্যাপারটা আমার মাথার মধ্যে দারুণভাবে দাগ কেটে গেল। আমি সাইকেল চালিয়ে চলে গেলাম। কিছুদূর গিয়ে আবার ঘুরে এলাম। কিন্তু আমি মেয়েটাকে আর দেখতে পেলাম না। খুব মনটা খারাপ হলো।

যাহোক, সে বেলায় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম, ওই বিল্ডিংয়ে অমুক তলায় কোনো মেয়ে থাকে কি না, সে চেনে কি না। বন্ধুর বক্তব্য হলো, এটা ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় কলোনিগুলোর মধ্যে একটা। এখানে হাজার হাজার মানুষ বাস করে, তার মধ্যে হাজার হাজার মেয়ে থাকে।

আমি যে বিল্ডিংয়ের কথা বলছি, সেই বিল্ডিং নাকি গোটা পঞ্চাশেক হবে। আমার মনে হলো সে গুল মারছে, এ মেয়েটাকে চেনে এবং সে চায় না, আমি কোনোভাবে মেয়েটাকে খুঁজে পাই। তো এরপরে সেদিন বাসায় চলে এলাম। কিছুদিন পরপর সাইকেল চালিয়ে সেই কলোনিতে আমার যাওয়ার বাতিক শুরু হলো। আমি বেশ কয়েকবার গেলাম কিন্তু কিছুতেই সেই মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি এখন দিনের বিভিন্ন সময় যাত্রা শুরু করলাম। ভাবলাম হয়তোবা বিকেলে না গিয়ে সকালে, দুপুরে কিংবা রাতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু বিধি বাম, কিছুতেই কিছু হলো না। এবার সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে যাতায়াত শুরু করলাম, হয়তোবা রোববার পাইনি, সোম-মঙ্গল-বুধ কোনো একদিন পাব। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।

এদিকে আমার বন্ধু আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। সে খুব বুদ্ধিমান, আমাকে বাস্তবতা বোঝানোর চেষ্টা করল।

মনে কর, সত্যিই সেদিন ওই মেয়েটাকে তুই দেখেছিস। এমনও তো হতে পারে যে সে অন্য কলোনিতে থাকে বা অন্য কোনো জেলায় থাকে। এখন এমন কি হতে পারে না যে সে হয়তো বেড়াতে এসেছে আত্মীয়ের বাসায় কয়েক দিনের জন্য। আচ্ছা, ধরে নিলাম সেখানেই থাকে মেয়েটা, কিন্তু সে তোর থেকে হয়তো বয়সে বড়। আচ্ছা, সে হয়তোবা তোর সমবয়সী কিংবা ছোট, কিন্তু তার হয়তোবা অন্য কাউকে পছন্দ। আর তুই তো কথা বলে দেখিসনি। তোর ধারণা, সে তোর দিকে তাকিয়ে আছে। এমন তো হতে পারে, সে হয়তোবা অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছিল বাইরে তাকিয়ে। আমি কোনোভাবেই দমে যাচ্ছি না দেখে এবার সে আসল অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করল আমাকে। অঙ্ক খুব ভালো বুঝিস তুই। নিজেই হিসাব করে দেখ না, কলোনিতে কত হাজার মেয়ে আছে। তার মধ্যে কত অংশের বয়স তোর বয়সের কাছাকাছি। তার মধ্যে কারা এই এলাকায় থাকে, তার মধ্যে কত অংশের চেহারা তোর বর্ণনা দেওয়া চেহারার সঙ্গে মিলে যায়। যাদের মিলে যায়, তাদের মধ্যে কত অংশের চোখ তোর দিকে তাকিয়ে হাসি দেওয়ার মতো খারাপ।

প্রতিটা কথা বলে বন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে আর আমি খাতায় একটা করে ভগ্নাংশ লিখি। একে একে তার পয়েন্টগুলোতে তুলছি আর এমনি আন্দাজে কিছু ভগ্নাংশ বসাচ্ছি। আমাদের আশা যে মোট কলোনির মেয়ের সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে গুণফলটা হয়তোবা অনেক বেশি কিছু আসবে। কিন্তু না, এল না। এক–এর চেয়ে বেশ কম এল। মন কি আর অঙ্ক মেনে চলে, মিনমিন করে মেনে নিলাম তার কথা। এবার আসল কথায় আসি, ছোটবেলার সেই শিক্ষা আমাকে বড় হয়ে দারুণ একটা জিনিস বুঝতে সাহায্য করেছে।

ড্রেক ইকুয়েশন
১৯৬১ সালে ডক্টর ফ্রাঙ্ক ড্রেইক একটি অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এই যে আমরা ভিনগ্রহের মানুষ এলিয়েন ইউএফও ফ্লাইং সসার বা সায়েন্স ফিকশনের বিভিন্ন বিষয়ে মানুষ ছাড়াও অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব কল্পনা করি, সেটা আসলে কতটা কল্পনা আর কতটা বাস্তব। অঙ্ক করে বের করতে পারি এটা? আসলে ড্রেইক ইকুয়েশন (Drake Equation) এ ধরনের একটা ক্যালকুলেশন ছাড়া আর কিছু না। মনে করা যাক, এই গ্যালাক্সিতে কয়েক শ বিলিয়ন নক্ষত্র (আমাদের সূর্য যেমন একটা নক্ষত্র) রয়েছে। এই নক্ষত্রগুলোর কত শতাংশের গ্রহ রয়েছে? আমরা জানি, সবার নেই। কিন্তু ধরে নিই অর্ধেক পরিমাণ নক্ষত্রেরই তাদের চতুর্দিকে ঘূর্ণায়মান গ্রহ আছে (এই অনুমান ১৯৬১ সালের পরে পরিবর্তন হয়েছে)। এখন এই গ্রহগুলোর মধ্যে কোনগুলো এমন দূরত্বে আছে নক্ষত্র থেকে যে সেখানে লিকুইড পানি থাকতে পারে। লক্ষ করে দেখুন, নক্ষত্রের খুব কাছে গ্রহ থাকলে (যেমন আমাদের সূর্যের বুধ ও শুক্র গ্রহ) পানি থাকতে পারবে না অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে, আর অনেক দূরে থাকলে (যেমন বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন) এত ঠান্ডা হবে সেটা যে সেখানেও জলীয় আকারে পানি থাকতে পারবে না। এখন পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে আমাদের যে ধারণা, তাতে বেশির ভাগ বিজ্ঞানী একমত যে প্রাণ থাকতে হলে জলীয় আকারে পানি থাকতেই হবে। পানি ছাড়া প্রাণ এখন পর্যন্ত মানুষ কল্পনা করতে শেখেনি। সুতরাং এমন গ্রহ থাকতে হবে, যেটা তার নক্ষত্র থেকে খুব দূরেও নয়, আবার খুব কাছেও নয়; মাঝামাঝি একটা জায়গায়। এই জায়গাটাকে আমরা বলতে পারি, প্রাণের আবির্ভাবের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাময় এলাকা (Habitable Zone)। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি, গ্রহগুলোর কিছু অংশ হ্যাবিটেবল জোনে থাকতে হবে।

শুধু হ্যাবিটেবল জোনে থাকলেই হবে না, সেখানে প্রাণের উদ্ভব ঘটতে হবে। এখন যেই সম্ভাবনাগুলোর কথা বলব, সেগুলো হলো সত্যিকারের অজানা, মানে বিজ্ঞানীদের আসলেই কোনো আইডিয়া নেই, এগুলো কীভাবে বের করতে হবে বা আসল মান কত হতে পারে।
১.
সব হ্যাবিটেবল জোনে থাকা প্ল্যানেটে যে প্রাণের উদ্ভব হবে, এমন কোনো কথা নেই। তার ভগ্নাংশ পরিমাণ কয়েকটিতে প্রাণের উদ্ভব হয়তো হয়েছে।
২.
যেগুলোতে শেষ পর্যন্ত প্রাণের উদ্ভব হয়েছে, সেই প্রাণীগুলোর মধ্যে হয়তোবা কয়েক অংশ বুদ্ধিমান প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।
৩.
যেসব প্রাণী বুদ্ধিমান প্রাণীতে পরিণত হয়েছে, তাদের মধ্যে কিছু অংশ কেবল হয়তো প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ লাভ করেছে, সেসব বুদ্ধিমান প্রাণী যারা প্রযুক্তি অর্জন করেছে, তাদের সঙ্গে হয়তো আমরা রেডিও ব্যবহার করে যোগাযোগ করতে পারব।

সুতরাং তর্কের খাতিরে বা অঙ্কের খাতিরে আমরা ধরে নিতে পারি যে চেষ্টা করতে থাকলে একদিন হয়তোবা আমরা অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের সন্ধান পাব। আসুন, আমরা গোড়া থেকে আবার মূল ইকুয়েশনটা বোঝার চেষ্টা করি।

N= R* fp*ne*fl*fi*fc*L
R=নক্ষত্র তৈরি হওয়ার হার, আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রতিবছর একটা করে আমাদের সূর্যের ৩ গুণ ভরের মালমসলা নক্ষত্র তৈরি করে। এখন এটা দিয়ে একটা নক্ষত্রও হতে পারে আবার দশটাও হতে পারে।
ধরে নিলাম সূর্যের সমান ৩টা তৈরি হলো। সুতরাং R=3
fp= নক্ষত্রের যে ভগ্নাংশের গ্রহ আছে
ne= গ্রহগুলোর যে ভগ্নাংশ হ্যাবিটেবল জোনে আছে (এগুলোকেই exo planet বলে, এখন পর্যন্ত ৩৪০০ আমরা আবিষ্কার করেছি, কয়েক বিলিয়ন আছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা)
fl= exoplanet এর যে ভগ্নাংশের মাঝে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। পৃথিবীর কথা ভাবলে আমরা জানি, এর মান কমপক্ষে ১। কিন্তু আমরা চাই আরও অন্য গ্রহে প্রাণ দেখতে বা খুঁজতে। এর মান আসলে কী আমরা জানি না।
fi= এই অদ্ভুত প্রাণীদের মাঝে বুদ্ধিমান প্রাণীর অংশ। এর মান কত, তা–ও আমরা জানি না।
fc= এই বুদ্ধিমান প্রাণীদের যে ভগ্নাংশ প্রযুক্তি অর্জন করেছে কমিউনিকেশন করার অর্থাৎ রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে যাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া সম্ভব। এর মানও আমরা জানি না।
L= সভ্যতার স্থায়িত্বকাল। এবার আসি একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ধারণায়। কোনো সভ্যতাই স্থায়ী নয়, প্রাণীর উদ্ভব হয় তারা আস্তে আস্তে সভ্যতা অর্জন করে বুদ্ধিমান হয়, একসময় কমিউনিকেশন সক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু সেটাও চিরকালের জন্য নয়। অর্থাৎ সভ্যতা উদ্ভব হয় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমরা কেবল সেসব প্রাণীকেই দেখতে পাব কিংবা ডিটেক্ট করতে পারব, যারা তাদের সভ্যতার স্থায়িত্বকালের মাঝে রয়েছে। সুতরাং এমন হতে পারে, আমরা ধ্বংসস্তূপ দেখতে পারি একটি সভ্যতার। অর্থাৎ একটি গ্রহ পেতে পারি, যেখানে আগে সভ্য প্রাণী ছিল কিন্তু এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। হয়তোবা এমনও কোনো গ্রহ দেখতে পাব, যেখানে প্রাণের কেবল উদ্ভব হয়েছে আজ থেকে মিলিয়ন বছর পর হয়তোবা সেই প্রাণ থেকে বুদ্ধিমত্তা উদ্ভব হবে।

এখন কি মনে হচ্ছে যে এটা একটা ফাউল ইকুয়েশন, আসলে এটা আমাদের তেমন কোনো তথ্যই দেয় না।

কথা খুব একটা মিথ্যা নয়, কিন্তু ডক্টর ড্রেইক ইকোয়েশন বের করার পরে কিছু মান বসিয়ে দেখিয়েছিলেন যে আমরা হয়তোবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একা নই। তিনি যে হিসাব করেছিলেন তা এ একম—

R∗ = 1 yr−1 (বছরে একটি করে নক্ষত্রের উদ্ভব হয়েছে)
fp = 0.2 - 0.5 (প্রায় 20 থেকে 50 শতাংশ নক্ষত্রের গ্রহ রয়েছে)
ne = 1 to 5 (প্রতিটা নক্ষত্রের একটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত গ্রহের প্রাণের উদ্ভবের সম্ভাবনা রয়েছে)
fl = 1 (যাদের প্রাণের উদ্ভবের সম্ভাবনা রয়েছে, তারা সবাই প্রাণের উদ্ভব ঘটাবে)
fi = 1 (যেখানেই প্রাণের উদ্ভব হবে, সেটাই আস্তে আস্তে বুদ্ধিমান প্রাণীতে পরিণত হবে)
fc = 0.1 to 0.2 (10 পার্সেন্ট থেকে 20 পার্সেন্টের মধ্যে কমিউনিকেশন করার চেষ্টা করবে)
L = 1000 to 100,000,000 years (এ রকম সভ্যতার স্থায়িত্বকাল হবে 1000 বছর থেকে 100 মিলিয়ন বছর)

এভাবে ধরে নেওয়া মানগুলো বসিয়ে সমীকরণে পাওয়া যায় N = 20

এরপরে অনেক হতাশাবাদী বিজ্ঞানী হতাশাব্যঞ্জক কিছু সংখ্যা বসিয়ে হিসাব করে দেখিয়েছেন, আসলে N এর মান খুবই কম। তার মানে আমরা একাই পুরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে

R=1.5–3 yr−1, fp • ne • fl = 10−5, fi = 10−9, fc = 0.2, L = 304 years
N= 9.1x 10-11

অন্যদিকে কিছু অতি উৎসাহী এবং আশাব্যঞ্জক বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, 15 মিলিয়নের বেশি প্রাণী থাকার সম্ভাবনা আছে
R = 1.5–3 yr−1, fp = 1, ne = 0.2, fl = 0.13, fi = 1, fc = 0.2, L = 109 years
N= 15,600,000

কয়েক যুগ ধরে SETI (search for extra terrestrial intelligence) নামে যে ইনস্টিটিউশন নিরন্তর ভিনগ্রহের প্রাণী খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাদের মূল প্রেরণা কিন্তু এই ইকুয়েশন। পৃথিবীতে অজস্র বিজ্ঞানী আছেন, যাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তাঁরা অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব পাবেন। আমি হয়তো সেই মেয়েটাকে খুঁজে পাইনি তখন ড্রেইক ইকুয়েশন বুঝতাম না বলে, বিজ্ঞানীরা কি এত বোকা? কিন্তু এখনো হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো কিছু ঘটেনি আসলে, আমাদের মহাকাশে বিচরণ এতটাই কম যে এ নিয়ে মন্তব্য করার মতো সময় এখনো আসেনি। জলজ্যান্ত প্রাণী না খুঁজে পেলেও তার ধ্বংসাবশেষ, নিদেনপক্ষে পানির অস্তিত্বসহ বাসযোগ্য গ্রহ ভ্রমণসীমার মাঝে খুঁজে পাওয়াটাই এখন সময়ের ব্যাপার।