সন্তান হারানো বাবাকে কী সান্ত্বনা দেব

2
2

আমার রাতের ডিউটি চলছে। প্রতিদিনের মতো অফিসে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে গল্প করছি। কাজ শুরু করার নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা আগেই অফিসে পৌঁছে যাই। তাই গল্প করার সুযোগ মেলে।

প্রবাসে কাজের ব্যস্ততা, পারিবারিক সমস্যা, শারীরিক অসুস্থতায় প্রায়ই প্রবাসীদের মন খারাপ থাকে। মনের মধ্যে অজানা শঙ্কা, ভয় নিয়ে আমাদের দিন পার করতে হয়। অফিসে এসে আমরা বাংলাদেশিরা একসঙ্গে বসে একটু আড্ডা–গল্পে মেতে উঠি। কাজ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে এ আড্ডা।

অনেক সময় তুচ্ছ সামান্য গল্প শুনেও সবাই হাসিতে ফেটে পড়ি। মানুষের যখন আনন্দের অভাব হয়, তখন মানুষ সামান্য কারণেও হাসে বা হাসার অভিনয় করে যায়। আবার অনেক সময় হাসির গল্পেও হাসি আসে না। মনে বেদনা পুঞ্জীভূত হলে তখন মস্তিষ্কে হাসি নিয়ন্ত্রিত অংশ সাবকর্টেক্স কাজ করে না।

আজকে আমাদের গল্প শুরু হয় আরেক সহকর্মীকে নিয়ে। তিন জিমে গিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিয়ে ক্যাপশনে লেখেন, সুস্থ থাকতে হলে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। তাঁর ভাবখানা এমন যে প্রায়ই ব্যায়াম করেন। অথচ তিনি ব্যায়াম না করে ছবি তুলেই বের হয়ে যান। আমরা সেই ছবি দেখে একেকজন একেক কথা বলছি আর হাসাহাসি করছি। এমন সময় মতিউর ভাইয়ের মোবাইল বেজে উঠল। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটু দূরে সরে কল রিসিভ করলেন। এরপর তাঁর মুখে আর কোনো কথা নেই। মোবাইল কানে দিয়েই দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মাটিতে বসে পড়লেন। তাঁর চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে। সবাই হতভম্ব হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।

মুহূর্তে আনন্দময় পরিবেশে বিষাদে ছেয়ে গেল। আমি উঠে গিয়ে তাঁর পাশে বসে বললাম, ‘কী হইছে ভাই, আপনি কাঁদছেন কেন?’ কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর তিনি বললেন, ‘ভাই, আমার ছোট মেয়ে মারা গেছে।’ আর কিছু বলতে পারলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। সবাই মতিউর ভাইকে ঘিরে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

আমি মতিউর ভাইয়ের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি, মোবাইলে ওপাশে এখনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। আমি মোবাইলটা কানে দিয়ে বললাম, ‘হ্যালো কে বলছেন? বাড়িতে কী হয়েছে? মতিউর ভাই কান্না করছে?’ তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেলাম।

আশ্চর্য, মোবাইলের ওপাশ থেকে আমার প্রশ্নের জবাবে কেউ কিছু বলছে না। শুধু বেদনাদায়ক কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। এমন বিষাদময় কান্না শুনে সহ্য করতে পারলাম না। মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মতিউর ভাইকে বললাম, ‘আপনার বাড়ির কারও নম্বর দিন কথা বলি। এভাবে কান্না করে কী হবে, ভাই। আপনি শান্ত হোন।’ যদিও তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। প্রিয় সন্তান হারানোর বেদনায় বাবাকে কী বলে সান্ত্বনা দিতে হয়, তা আমার জানা নেই।

মতিউর ভাই তাঁর চাচির নম্বর দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ফোন দিলাম। কয়েকবার বাজার পর একজন ফোন ধরে ওপাশ থেকে হ্যালো বললেন। বললাম, ‘আমি মতিউর ভাইয়ের সহকর্মী বলছি। বাড়িতে কী হয়েছে, আমাকে কি বলা যাবে?’ ‘হ্যাঁ বাজান, আমাদের মতিউরের ছোট মাইয়া পানিত পইরা মইরা গ্যাছে।’ তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিয়ে জানতে পারলাম। মতিউর ভাইয়ের ছোট মেয়ে, যার বয়স মাত্র এক বছর। সবে হাঁটা শিখেছে। সে নাকি অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে বাড়ির আঙিনায় খেলছিল। ছোট শিশুর মা অসুস্থ হওয়ায় বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আধা ঘণ্টা পর বাইরে বের হয়ে তিনি অন্য বাচ্চাদের দেখতে পান, কিন্তু তার ছোট মেয়েকে দেখতে পান না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এদিক-ওদিক মেয়েকে খুঁজতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর বাড়িসংলগ্ন পুকুরে মেয়ের মৃতদেহ দেখতে পান, যা দেখে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। একজন মায়ের পক্ষে এমন অবুঝ সন্তানের লাশ দেখার ক্ষমতা নেই।

মতিউর ভাই কাঁদছেন। আর আমরা সবাই তাঁকে ঘিরে মন খারাপ করে বসে আছি। অনেকের চোখ ছলছল করছে। আমি তাঁর কান্না সহ্য করতে না পেরে অন্যত্র চলে গেলাম।

কিছুক্ষণ পর আমাদের সিনিয়র সেফটি অফিসার সুব্রত ভাইকে ফোন দিলাম। বিস্তারিত জানানোর পর তিনি বললেন, ‘মতিউর কি দেশে যাবে?’
‘হ্যাঁ ভাই, দেশে গেলে তো ভালোই।’
‘ঠিক আছে আমি মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করতেছি।’

সুব্রত ভাই আর কথা বাড়ালেন না। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সঙ্গে মতিউর ভাইকে ফোন দিলেন। সুব্রত ভাই মতিউরের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে আশ্বাস দিলেন, তাঁর দেশে যাওয়ার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা তিনি করবেন।

প্রবাস থেকে ইচ্ছে করলেই দেশে যাওয়া যায় না। কোম্পানি ছুটি মঞ্জুর করলে বিমান টিকিট কিনতে হবে। তা ছাড়া অনেক সময় বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না। টিকিট কেনার জন্য সঙ্গে টাকাও তো থাকা চাই। অনেক প্রবাসীই বেতন পাওয়ার পর নিজের খরচ বাবদ সামান্য টাকা রেখে সব টাকা দেশে আপনজনদের জন্য পাঠিয়ে দেন।

সুব্রত ভাই এইচআর ও বসদের সঙ্গে আলোচনা করে মতিউরের ছুটি মঞ্জুর করালেন। শুধু তা–ই নয়, পরের ফ্লাইটের বিমান টিকিটও অনলাইনে কেটে আমাকে ফোনে বললেন, ‘মতিউরের দেশে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছি। আপনি মতিউরের সঙ্গে কথা বলে তাকে সান্ত্বনা দিন। আর তাকে সকালে অফিসে আসতে বলুন। আমি সকালে তার বিমান টিকিট ও ছুটির ব্যাপারে আনুষঙ্গিক কাজ সেরে দেব।’

সকালে মতিউর অফিসে এলে তাঁর চেহারার দিকে তাকাতে পারলাম না। আমি নিশ্চিত, তিনি প্রিয় সন্তান হারানোর বেদনায় সারা রাত ঘুমাননি। হয়তো সারা রাত কেঁদেই পার করে দিয়েছেন। সুব্রত ভাই মতিউর রহমানকে অফিসে ডেকে সান্ত্বনা দিয়ে তাঁর হাতে বিমানের টিকিট ধরিয়ে দিলেন।

সুব্রত ভাইয়ের কথা শুনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রধান। তিনি যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, শুনে সত্যি আমি কৃতজ্ঞ হলাম। এর আগেও তিনি কয়েকবার এভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

মানুষ মানুষের জন্য। সুব্রত ভাইয়ের এই ভালো কাজ হয়তো আমরা মনে রাখব না। কিন্তু যারা উপকৃত হয়েছে, তারা আজীবন মনে রাখবে। তারা মনে না রাখলেও সৃষ্টিকর্তা ঠিকই তাঁকে এর প্রতিদান দেবেন। ভালো মানুষেরা প্রতিদানের আশায় কিছু করেন না। তাঁরা বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সুখানুভূতি লাভ করেন।

মতিউর ভাই ভগ্নহৃদয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন। জানলাম, তাঁর হাতে কোনো টাকা নেই। সুব্রত ভাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিলে হয়তো তাঁর এ অবস্থায় দেশে যাওয়া হতো না।

তাঁর কথা শুনে উপলব্ধি করলাম, আমারও মাস শেষে হাতেও কোনো টাকা থাকে না। কোনো জরুরি কারণে বাড়ি যেতে হলে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। প্রত্যেক প্রবাসীর উচিত বাড়িতে টাকা পাঠানোর পরও কিছু টাকা নিজের কাছে রাখা। কখন কোনো জরুরি অবস্থায় প্রয়োজন হয়, তা তো বলা যায় না৷

প্রবাসে সবচেয়ে কষ্টকর হলো আপনজনদের মৃত্যুসংবাদ শুনে সারা রাত বিছানায় ছটফট করা। শেষবিদায়ে আপনজনের পাশে না থাকাটা যে কতটা কষ্টকর, তা প্রবাসী ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারে না।

*ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর