জাপানের 'কাকুনিন' নিশ্চয়তা আর ভরসার পাথেয়

‘শিসা কাকুনিন কানকো’ প্রক্রিয়াতে ব্যক্তিটি তাঁর নিজের ভুল বা সঠিকের ব্যপারে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারতেন। ছবি: লেখক
‘শিসা কাকুনিন কানকো’ প্রক্রিয়াতে ব্যক্তিটি তাঁর নিজের ভুল বা সঠিকের ব্যপারে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারতেন। ছবি: লেখক

রহস্যজনক সব কর্মপদ্ধতি আর বিজ্ঞানভিত্তিক কর্ম পরিচালনায় জাপানের জুড়ি মেলা ভার।

সাত মিনিটে বিশাল একটা ট্রেন পরিষ্কার করাই হোক কিংবা চাইকি সুতা দিয়ে মেপে চায়ের কাপ সাজানোই হোক। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে একটু হাস্যকর মনে হলেও অতিপ্রয়োজনীয় দৈনন্দিন জীবনে জাপানিদের মেনে চলা রীতিনীতিগুলো যেমন বিজ্ঞানসম্মত, তেমনি এক শ ভাগ নিখুঁত কর্মপদ্ধতির পাথেয়।

জাপানিদের ‘শিসা কাকুনিন কানকো’র বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘ঠিক আছে-নিশ্চিতভাবে’। ছবি: লেখক
জাপানিদের ‘শিসা কাকুনিন কানকো’র বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘ঠিক আছে-নিশ্চিতভাবে’। ছবি: লেখক

যেমন একটি হচ্ছে ‘শিসা কাকুনিন কানকো’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ঠিক আছে-নিশ্চিতভাবে’ কিন্তু সেই ঠিক থাকার নিশ্চয়তা দেওয়ার যে পদ্ধতি, সেটা সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্টেশনগুলোতে স্টেশন অ্যাটেনড্যান্ট (একি ইন) অথবা ট্রেনচালক আঙুল তুলে নির্দিষ্ট ঘটনা যা নিশ্চিত করতে হবে, তার দিকে তাক করে মুখ দিয়ে সেটা উচ্চারণ করে নিশ্চিত করে থাকেন। ১৯০০ সালের দিকে এই পদ্ধতি উদ্ভাবন হয় জাপানে। জাপান অধ্যুষিত তৎকালীন চীনের দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়ানে রেল দুর্ঘটনা রোধে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। রেলপথের চালক সামনের রেললাইনের বিভিন্ন সিগন্যাল দেখে সেটা নিশ্চিত হয়েছেন বুঝতে‌ নিজেই সিগন্যাল বাতির দিকে আঙুল তুলে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেন ‘হাই’ (হ্যাঁ আমি নিশ্চিত!)। এই প্রক্রিয়াতে ব্যক্তিটি তাঁর নিজের ভুল বা সঠিকের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারতেন। একইভাবে অন্য ব্যক্তিরাও এই প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ রেলওয়ে বা রেলপথ নিরাপদ রাখা সম্ভব ছিল। পরে যা পশ্চিমা সমাজে ‘point and acknowledge’ নামে পরিচিতি পায়। নিউইয়র্কের পাতালরেলে এ ব্যবস্থা চালু আছে।

রহস্যজনক সব কর্মপদ্ধতি আর বিজ্ঞানভিত্তিক কর্ম পরিচালনায় জাপানের জুড়ি মেলা ভার। ছবি: লেখক
রহস্যজনক সব কর্মপদ্ধতি আর বিজ্ঞানভিত্তিক কর্ম পরিচালনায় জাপানের জুড়ি মেলা ভার। ছবি: লেখক

‘কাকুনিন’ বা নিশ্চিত করার জন্য নির্ধারিত ব্যক্তিটি সিগন্যাল বাতি বা প্ল্যাটফর্মের সতর্কতার জন্যই শুধু নয় বরং মস্তিষ্ক, হাত, মুখ, চোখসহ সব প্রয়োজনীয় ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগিয়ে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা থেকে মানুষ এবং যন্ত্র উভয়কেই নিরাপদ করে থাকেন। যার কারণে এর আরেক নাম ‘ইয়োবি সাশি কোশো’ (yubisashi kosh)। এই পদ্ধতি প্রায় ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ রাখার অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, ট্রেন চালনা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি, কিছু কিছু স্থানে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, এ রকম হাজারো ক্ষেত্রে প্রতিদিন জাপানিরা কাকুনিন কানকো পদ্ধতি কাজে লাগায়।

আমাদের দেশে রেললাইনগুলোতে, প্ল্যাটফর্মে আর রাস্তার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যদি কাকুনিন কানকো পদ্ধতি কাজে লাগানো যেত, তাহলে কি অনেক নির্মম দুর্ঘটনা এড়ানো যেত না? জাপানিরা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিজ্ঞানের আলোয় তাদের দেশটাকে পৃথিবীর ১ নম্বর উদাহরণের দেশে পরিণত করেছে। আমারাও কি চাইলে পারব না?