পাতালরেলের কাব্য

জার্মান মেয়েদের চোখা চোখা হাতব্যাগের এক গুঁতো খেলে আমার কম ক্যালসিয়াম খাওয়া বাঙালি পাঁজরটা এক দফায় ফেঁসে যাবে। কিন্তু চাইলেও সটকে পড়ার উপায় নেই। মিউনিখ শহরের সকাল সাতটার এই পাতালরেলে একটা মাছিও উড়ে গিয়ে আরেক খানে বসার জায়গা পায় না। আমি তো কোনো ছার। তার ওপর হাতব্যাগওয়ালা মেয়ের চারপাশে মচমচে বিস্কুটের ঘ্রাণ। ফুলফল বাদ দিয়ে সুগন্ধি কোম্পানিগুলো ইদানীং কেক-বিস্কুটের দিকে ঝুঁকেছে। কী জ্বালা! আপাতত খোঁচা খাওয়ার আতঙ্ক থেকে বের হতে ব্যর্থ হয়ে ট্রেনের ছাদ বরাবর নাক উঁচিয়ে ম–ম পারফিউমের সাগরে ভেসে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছি।

এই পথ দিয়ে রোজ অফিসে যাই। এত দিনে এই ট্রেনযাত্রা সয়ে আসার কথা। কিন্তু উল্টো ঘেমেনেয়ে প্রতিদিন একই অস্থির অবস্থা। দুই স্টেশন পরেই ঘ্রাণময়ী কুমিরের চামড়া দিয়ে বানানো তার বহুমূল্য মাইকেল করস ব্যাগটা দিয়ে ডান পাঁজরে দড়াম এক ঘাঁই মেরে গটগটিয়ে নেমে গেল। ঘাঁই খেয়ে কেঁউ করে ককিয়ে উঠলে কেমন দেখায়। তাই খক খক কেশে কেঁউমেউ ধামাচাপা দিলাম। পথটা গোয়েথেপ্লাৎজ্য থেকে ম্যাক্স ওয়েবারপ্লাৎজ্য পর্যন্ত সাকল্যে আধা ঘণ্টার। সে হিসাবে এমন ঘাঁই, কেনু, পায়ে পাড়া খাওয়ার মতো বহু খারাবি কপালে লেখা আছে। সুতরাং, দাঁতে দাঁত চাপলাম।

এক স্টেশন পরেই কেতাদুরস্ত ট্রেঞ্চকোট চাপানো টিকলো নাকের এক চটপটে তরুণ এসে উঠল। উঠেই দরজার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানোর বিলাসবহুল জায়গাটা হাতিয়ে নিল। নিলে হবে কী, পিছিয়ে আর কই যাব। অগত্যা, মুখ বুজে তার বগলের চিপায় চিপকে থাকলাম। হাতের গরম কফিটা বগল বাবার ট্রাইজারে ছলকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে দেওয়ার কুটিল ইচ্ছাটা অতি কষ্টে গলা টিপে মারতে হলো। মিউনিখের পাতালরেলে চলতে হলে আকাশছোঁয়া ধৈর্য লাগে। সেই ধান্ধায় কফিতে লম্বা এক টান মেরে ধৈর্যের বাদশা ইয়াকুব নবীর কথা ভাবতে লাগলাম।

কাজে যাওয়ার অন্য আরও উপায় আছে। গাড়ি কিংবা সাইকেলে চালিয়ে যাওয়া যায়। এর কোনোটাই না করে রোজ এই জার্মান মুড়ির টিনে নিজেকে পুরে দেওয়ার কারণ, শহুরে রাস্তার অলিগলিতে গাড়ি চালাতে আতঙ্ক কাজ করে। সামান্য ভুলচুক হলে জার্মানরা যে ভাষায় গাল দিয়ে বসে, সেটা হজম করতে কড়া ডোজের হজমিগুলো লাগে। আবার সাইকেল ঠেঙ্গিয়ে যাব, এত বড় মাইকেল এখনো হয়ে উঠিনি। আসল কথা, গাড়িঘোড়া চালাতে ভয় লাগে। এহেন ভীতু আর সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীরা যেন নির্বিঘ্নে বুকে হেঁটে চলতে পারে, তার জন্যে এই শহরের পেটের ভেতরে আছে চমৎকার আঁকাবাঁকা রেলব্যবস্থা। এই সুড়ঙ্গ রাজ্যের আরেকটা আকর্ষণ হলো, এর একটা ম্যাঙ্গো পাবলিকীয় ব্যাপার আছে। মাটির ওপরে যে যত বড় তাবড়ই হোক না কেন, মাটির নিচে ঠেলাঠেলির ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা আমসত্ত্ব হয়ে যাওয়া সবাইকে এখানে খুব সাধারণ আর ভীষণ রকমের গড়পড়তা দেখায়।

সেই গড়পড়তা আমিই একলাফে হোমরাচোমরা ভিআইপি বনে গেলাম যখন দেখলাম, নতুন কেনা কমলালেবু রঙের জ্যাকেটের গায়ে স্টেশনের সিঁড়ি মোছার সরঞ্জাম নিয়ে ওঠা লোকটা আলতো করে তার ঝাড়ুর ডগাটা লাগিয়ে দিল। টং করে মেজাজ খিচড়ে চোখ রাঙিয়ে বসলাম প্রায়। ঠিক শেষ সেকেন্ডে লোকটা অপরাধী ভঙ্গিতে হেসে দারুণ ডিফেন্স খেলে কাবু করে দিল। মাথায় পাগড়ি দেখে বুঝলাম জাতে সে শিখ। আরও ভালো করে তাকিয়ে দেখি, আমাদের দুজনের গায়েই কমলা জ্যাকেট। আমারটার গায়ে মাঝারি দামের এক ব্র্যান্ডের লোগো আর তারটায়ে লেখা ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রেল কর্তৃপক্ষ’। দুটোই দেখতে প্রায় অবিকল। ঠিক যেন লাইফ জ্যাকেট! অনন্য হতে গিয়ে খালি অন্যতমই হতে হয়। ধুর! এবার আমি হেসে ফেললাম। পাগড়ি নাচিয়ে ঝাড়ু সর্দারও সাহস করে আরেক প্রস্থ চওড়া হাসি দিল। বাকিটা পথ আমরা দুজন ট্রেনের তাবত লোকের জানমালের দায়িত্ব নিয়ে লাইফ গার্ড সেজে দাঁড়িয়ে রইলাম।

পরের স্টেশনে সর্দারজি পেল্লায় সেলাম ঠুকে ঝাড়ুর ট্রলি ঠেলে নেমে গেল। বিকট ঘটাং শব্দ তুলে দরজার পাল্লা লাগল। এই মেড ইন জার্মান মুড়ির টিনগুলোর চেসিস অন্য ধাতুতে গড়া। এগুলো ভাঙে না, মচকায়ও না। চলতে থাকে তো চলতেই থাকে। একটা দুটো নতুন মডেল আছে বটে। হাত ছুঁলেই সিসিমফাঁক। আর বাকিগুলোর হাতল ধরে মুগুর ঘোরানোর ভঙ্গিতে ভিম পালোয়ানের চাপ দিলে তবেই দরজা খোলে।

আপাতত, জায়গা বদলের ধান্ধায় আছি। কতগুলো নতুন লোকের সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে এক পাঁড় মাতাল ঢুকেছে। তার হাতে ধরা রেড বুল দেখে মনে হচ্ছে, এই দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারার আগে রাতভর সে সস্তা বিয়ার আর না জানি কী সব দিয়ে ডিনার সেরেছে। ভকভকে বিটকেলে বদবু নাক দিয়ে নেমে একেবারে কলিজায় কড়া নাড়ছে। বাকি সবারও একই অবস্থা। কিন্তু মাতালকে কেউ ঘাটায় না। বরং তাদের প্রতি একটা চাপা সম্ভ্রম কাজ করে লোকের। তবে একবার একরকম বাধ্য হয়ে মাতাল ঘাটাতে হয়েছিল।

তখন অক্টোবর ফেস্ট চলছে। মিউনিখের বিখ্যাত বিয়ার ফেস্টিভ্যাল। নানান দেশ থেকে লোক এসে মাতাল হয়ে রাস্তার এধারে ওধারে পড়ে থাকে। ট্রেন বদলের সময়ে দেখি এক তরুণী দুই পাক ঘুরে সটান শুয়ে পড়েছে। নড়াচড়া নট। আর সঙ্গের ছেলেটা স্টেশনের খাম্বা জড়িয়ে হেড়ে গলায় বিজাতীয় ভাষায় গান ধরেছে। মুশকিল হলো, এরা বিপজ্জনকভাবে প্ল্যাটফর্মের একেবারে কিনারা ঘেঁষে বসে। দুই-তিন গড়ান দিলেই রেললাইনে পড়ে কম্ম কাবার। লোকজন পাশ কাটিয়ে যে যার মতো চলছে। নিরুপায় হয়ে এক দৌড়ে টিকিট কাউন্টারে খবর দিয়ে ফিরে এসে মাতাল পাহারা দিতে থাকলাম। গড়িয়ে গেলে উড়ে গিয়ে ঠেকাব। ছেলেটার অমন বিচ্ছিরি হাউহাউ গানেও মেয়েটার ঘুম ভাঙছে না দেখে ভয়ই লাগল যে মরেটরে গেল নাকি আবার। তখন তো এই আমিই একমাত্র ঠাঁয় দাঁড়ানো সাক্ষী। ভাগ্য ভালো, এর ভেতরেই মাতাল তোলার জন্য স্ট্রেচার নিয়ে পুলিশ-প্যারামেডিক হাজির। আমি যে সঙ্গের লোক নই, সেটা ইশারায় বুঝিয়ে চম্পট মারলাম। এরপর থেকে ঠিক করেছি, এসব কেস নির্বিকারে এড়িয়ে যাব।

কিন্তু আজকের এই রেড বুল গেলা মাতাল ষাঁড়ের কাছ থেকে পিছু হঠা যাচ্ছে না। সে গায়ের ওপর এসে পড়ছে। ‘কোন দেশ থেকে এসেছ গো?’, সুর করে সুধাল সে। মাতাল এবং পাগল খ্যাপাতে নেই, এই আপ্তবাক্য মেনে আস্তে করে বললাম, ‘বাংলাদেশ।’ ‘ওহ্! হিক্! মানে ইন্ডিয়া। দারুণ, দারুণ!’ আপ্তবাক্য চুলায় দিয়ে এবার কড়া জবাব দিলাম, ‘ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশ, দুইটা দুই দেশ—এটাও জানা নেই?’ হা হা করে ট্রেন কাঁপিয়ে এবার মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে লোকটা বলল, ‘বিরাট ভুল হয়ে গেছে। এই ভুল শোধরাতে কি আমি তোমার হাতে একটা চুমু খেতে পারি?’ বলেই সে ঠোঁট গোল করে নিশানা বরাবর এগিয়ে এল। আঁতকে হাত সরিয়ে পা চালিয়ে দ্রুত ভিড়ের গহিনে পালিয়ে গেলাম। পেছন থেকে অস্ফুট আফসোস শোনা গেল, ‘যাচ্চেলে, চলে গেল? একটাই তো চুমু খেতাম, দুইটা তো আর না, হিক!’

মারিনপ্লাৎজ। সরু চোখে দেখলাম, বেহেড লোকটা হেলেদুলে নেমে পড়ল। ট্রেন ঝেঁটিয়ে বেরিয়ে গেল আরও অনেকেই। মারিনপ্লাৎজ শহরের দোকানপাটের সবচেয়ে বড় আখড়া। সে সুবাদে এখানে প্রচুর লোকের অফিস। প্রায় খালি বগিটায় এবার দুই আসনজুড়ে এঁকেবেঁকে আধশোয়া হয়ে বসেছি। আরামে চোখ লেগে আসছে। সকালে ঘুম কম হয়েছে। হঠাৎ শুনি, মিউ মিউ আওয়াজ। কার আবার থলের বেড়াল বেরিয়ে গিয়ে ম্যাঁও–প্যাও জুড়ে দিল?

বহু কষ্টে চোখের পাতা তুলে দেখি নাইন ও’ক্লক বরাবর বছর চল্লিশের এক ভদ্রমহিলা কাঁদছেন। ভীষণ অস্বস্তিতে পড়া গেল। যে কজন লোকজন আছে, তারা কানে ঠুলি দিয়ে গান শুনছে নয় তো হাতের ফোনে মাথা ঢুকিয়ে বসে আছে। নারীর কান্না কেন, কারও চিল চিৎকারও এদের কানে যাওয়ার জো নেই। কী ভেবে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ‘অ্যা, ইয়ে, আপনি ঠিক আছেন তো?’ উত্তরে কান্নার গতি বাড়িয়ে দিয়ে সে ধপ করে ট্রেনের মেঝেতে বসে পড়ল। ভয়ংকর কিছু না ঘটলে লোকে এমন করে না। চরম গাধামির পরিচয় দিয়ে আমিও তার পাশে উবু হয়ে বসলাম। ঠিক কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না। ব্যাগে একটা চকলেট ছিল। হাতে গুঁজে দিলাম নিঃশব্দে। ছোট্ট মেয়ের কান্না থামানোর জন্যে বড়রা যা করে। হতভম্ব করে দিয়ে ভদ্রমহিলা হঠাৎ জাপটে ধরে ডুকরে উঠলেন। তার নাতিশীতোষ্ণ নাকের পানি-চোখের পানি টপটপিয়ে হাতে পড়ছে। অবস্থা তথৈবচ।

কান্নার ভেতর বিড়বিড়ানি শোনা গেল, ‘আমার হাসবেন্ড, উ উ...’। মনে মনে বললাম , ‘কী, মরে গেছে না সরে গেছে? যেটাই হোক, ল্যাঠা গেছে। আরেকটা খুঁজে নিলেই হলো। ‘মহিলার ইশারা বরারর বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি চোগলখোর চেহারার এক ষণ্ডামার্কা লোক পেশি ফুলিয়ে হাত পাকাচ্ছে। সম্ভাব্য পারিবারিক নির্যাতনের মামলা মনে হলো। মাঝে আমি কাবাব মে হাড্ডি হয়ে ঝুলে থাকলে এই লোক কিলিয়ে ভূত বানিয়ে দিতে পারে।’

এদিকে ট্রেন এসে ওডিয়নপ্লাৎজ থেমেছে। আমার ট্রেন বদলাতে হবে। দোটানায় থাকা আমাকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রমহিলা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মনে হলো। তারপর আমাকে বা চোগলখোর কাউকেই তোয়াক্কা না করে লম্বা একটা দম নিয়ে ঝাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে হাজার লোকের ভিড়ে মিলিয়ে গেল। খানিকক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তা মাপলাম। এই পাতালপুরির গহ্বরে কত কী–ই না ঘটে।

চলন্ত সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে পাতাল থেকে আরও পাতালে নেমে দ্বিতীয় ট্রেন ধরলাম। মাটির ঠিক কত নিচে আছি, ভাবলে মাথা ঝিম করে ওঠে। তাই আর ভাবি না। কাজের সুবাদে এক চায়নিজ ছেলেকে চিনতাম। প্রতিদিন আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে তার যাতায়াত। একদিন ভিড়ের ভেতর তার হঠাৎ মনে হলো সে মাটির নিচে আটকা পড়ে আছে আর এই কবর থেকে সে বেরোতে পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে মুখে ফেনা তুলে ফিট খেয়ে অ্যাম্বুলেন্স ট্যাম্বুলেন্স ডেকে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। এই মুহূর্তে আমার অবস্থাও কাছাকাছি। যদিও ভয় না পাবার চেষ্টা করছি। কারণ, ট্রেনটা আচমকাই প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি দিয়ে দুই স্টেশনের মাঝে থেমে পড়েছে। ঘোষণা ভেসে আসছে, ‘সাময়িক যান্ত্রিক গোলযোগ। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। বাতি নিভে গেলে ভয় পাবেন না।’ কপাল ভালো, বাতি নিভল না। তবে খানিক বাদে পরের স্টেশনে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে খালি বগিগুলো নিয়ে ট্রেন ফিরে গেল।

পরের ট্রেনে আমরা দ্বিগুণ মানুষ গাদাগাদি করে উঠছি। এবারের চালক বেশ রসিক। সে স্পিকারে সহাস্যে বলছে, ‘হ্যালো সবাই, তোমাদের ফোনগুলো সব ব্যাগে পুরে ভাঁজ করা কনুই সব সোজা করে ফেলো তো। দেখবে কত্ত জায়গা আমার ট্রেনে।’ তারপর কপট গাম্ভীর্যে যোগ করল, ‘নইলে আমি গাড়ি ছাড়ব না কিন্তু।’ হাসির একটা চাপা রোল উঠল। কিন্তু কাজ হলো জাদুর মতো। যন্ত্রগুলোকে বিসর্জন দিয়ে দুই ট্রেনের যাত্রী আমরা ঠিকঠাক এক গাড়িতে এঁটে গেলাম। ঠিক তেঁতুলপাতায় নয়জন কাহিনি।

আমার স্টেশন চলে এসেছে। বিটোফেনের ফিফথ সিম্ফনি চলছে স্টেশনজুড়ে। একটা দুটো হলদেটে ম্যাপল পাতা লোকের পায়ে–পায়ে ঘুরে শীতের বার্তা বিলোচ্ছে। এক কোণে চেয়ার পেতে খবরের কাগজ বেচতে বসেছে এক বুড়ো। কর্মব্যস্ত সকালের নিস্তরঙ্গ দৃশ্য। ‘এই নাও তোমার জন্যে থাই খাবার এনেছি। গরম গরম খেয়ে নাও দেখি।’ হাঁটার গতি কমিয়ে দেখি কাগজ বুড়োর সামনে এক তরুণী ধোঁয়া ওঠা কতগুলো বাক্স বের করছে। বুড়ো খানিকটা সংকোচে, সলজ্জে হাত বাড়িয়ে সেগুলো নিল। চেহারাই বলে দিচ্ছে ওবেলা বোধ হয় কিছুই খাওয়া হয়নি।

ঝকঝকে এই শহরের কোনাকানাচে এমন আধপেটা বহু লোক আছে। চামড়া মোটা বলে অনায়াসে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। কিন্তু আজকের এই ছোট্ট ঘটনায় তাক লেগে গেল। ভাবলাম, সামনে এই বুড়োর মতো কাউকে পেলে রেস্তোরাঁর খাবার না পারি, অন্তত গোটা দুই রুটি কিনে দেব। সকালটার শুরু হোক একটা সার্কেল অব গুড ডিড দিয়ে।

সিঁড়ির কাছে পৌঁছাতেই গুটিসুটি কম্বল মুড়িয়ে একজনকে ঝিমাতে দেখলাম। সামনে রাখা খালি মগটায় কটা ২০ আর ৫০ সেন্ট উঁকি দিচ্ছে। সেখানে আরও কয়টা আধুলি ফেলে গলা খাকরি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপত্তি না করলে আমি কি তোমাকে স্টেশনের বেকারি থেকে রুটি আর স্যান্ডুইচ কিনে দিতে পারি?’ উত্তর যা এল তাতে আমার গুড ডিড ফলানোর আশ মিটে গেল। ‘আরে ধ্যাৎ, রুটি কে খায়, তার চেয়ে ছয় বোতলের এক কেস বিয়ার কিনে দিয়ে যাও না। সাথে দুই প্যাকেট মার্লবোরো। আর পারো তো একটা দেশলাই‘। বলেই চোখের পাতা ফেলে লোকটা মুনি-ঋষির ধ্যানে বসল। কাণ্ড দেখে হাল ছেড়ে চলেই যাচ্ছিল্লাম; কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘তোমার মদ-বিড়ির পয়সা আমি জোগাতে যাব কোন দুঃখে?’ আর চরম ভুলটা সেখানেই। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো খিস্তির তুবড়ি ছুটল কম্বলের আড়াল থেকে। পড়িমরি করে সিঁড়ি টপকাতে লাগলাম। কানে আসছে, রুটির কপালে সে তখনো গুলি মেরে যাচ্ছে।

যেতে যেতে ভাবছি, কী এক বিচিত্র এই পাতালরেল। আর কী খ্যাপাটেই না এর কাব্যগুলো। (সমাপ্ত)

*ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার, গবেষক ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি