বাকির কাগজ

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

জোহরার সামনে বসে রাগে-অভিমানে সোবহানের শরীরটা গরম হয়ে আবার পরক্ষণেই ঠান্ডা হয়ে যায়। এখনই হাসতে ইচ্ছে করছে আবার পরক্ষণেই চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে। অস্ফুট স্বরে শুধু বলে, জোহরা, জোহরা তুমি!

জোহরার আবেগ ক্রমেই চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবুও যথাসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে থেমে থেমে বলতে থাকে, তুমি দয়া করে আমার কথাগুলো শুনবে।

: কী তোমার কথা, কীই-বা হবে শুনে।

: আমি আর বিয়ে করিনি। আজও তোমারই স্ত্রী আমি। তুমি যখন যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলে, নীরবে সম্মতি দিয়েছি। তোমাকে আটকাইনি। তুমি যখন যুদ্ধে যাও, আমাদের বিয়ের বয়স মাত্র ছয় মাস। মনে আছে?

: মনে থাকবে না মানে? অবশ্যই আছে।

: যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তুমি আবার বিয়ে করেছ, তাই না?

: হ, করেছি। এখন আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে আর নাতি-নাতনিসহ আটজন।

এবার জোহরার কান্না আর বাঁধ মানে না। সোবহানও সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো চেষ্টা করে না। একপর্যায়ে জোহরা কিছুটা শান্ত হয়ে এলে সোবহান বলে, আচ্ছা, আচ্ছা বউ...।

সোবহানকে থামিয়ে দিয়ে জোহরা বলে, বউ!

চার দশক পর প্রথম যৌবনে অতি অপছন্দের এ আদরমাখা ডাকটির ভেতর আজ আর বাকি আছে কি কোনো সুধা? হয়তো আছে। নইলে এমন লাগবে কেন। এ ডাকে আজ জোহরার বুকের ভেতরটা মুচড়ে অসহ্য রকমের ব্যথা করে উঠল কেন?

সোবহানের মামাতো ভাইয়ের ছেলে মামুন একটা ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ। কোনো এক বিকেলে সে নাটোর সদরের মল্লিক ফার্মেসিতে বসে আছে। একজন প্রৌঢ় নারী এসে এক পাতা ডরমিক্যাম ৭.৫ ট্যাবলেট নিয়ে চলে যান। মামুন এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফার্মেসির মালিক কাদেরকে বলে, কী ব্যাপার কাদের ভাই, প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওই ট্যাবলেট দিলেন যে?

কাদের হেসে বলে, জি ভাই। প্রেসক্রিপশন আমার ড্রয়ারেই রাখা আছে। ওনার নাম জোহরা। আমার বহুদিনের এক কাস্টমার। বড় ভালো মানুষ। আমি ওনাকে নানি ডাকি।

: নাম জোহরা, না?

: জি। মানুষের বাড়িতে কাজটাজ করে। আচার-ব্যবহার খুব ভালো।

: বাড়ি কই জানেন?

: না, ঠিক জানি না। তবে কথাবার্তার ধরন কিছুটা আপনার সঙ্গে মেলে।

: ও আচ্ছা।

এমন দু-তিনটা খোঁজবার্তা যে সোবহানের কাছে আসেনি তা নয়। অনেকটা ইচ্ছে করেই যেন এড়িয়ে চলা। এত দূর যাওয়া। অনেক টাকার প্রয়োজন। জানাশোনাও নেই। খবরগুলোও তেমন স্পষ্ট নয়। সোবহান মনে মনে ভাবেন, জীবন তো শেষই। কয়টা দিনইবা বাঁচব। কী আর হবে।

ভাতিজা মামুনের এসব বর্ণনা শুনে সোবহান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। কী যেন ভেবে চোখের জল আড়াল করে বলেন, বাবা মামুন, আবার যদি নাটোর যাও। আমাকে নিয়ে যেয়ো।

: জি আচ্ছা।

এক মাস পর মামুন তার চাচা সোবহানকে সঙ্গে নিয়ে নাটোরে যায়। কাদের আর মামুন মিলে সোবহানকে জোহরার মুখোমুখি করে ওরা দুজন ফার্মেসিতে এসে বসে রইল।

সোবহান জোহরাকে বলে, হ্যাঁ, আমাকে বলতে দাও। একটা বিষয় আর আমার মাথায় আসে না, তুমি এমন কাজটা কী করে করলে!

বার দুই চোখ মুছে জোহরা বলে, আমি তোমার কাছে ক্ষমাহীন অন্যায় করেছি। বলো, কী কারণে, বিয়ে করার আগে আমার একটু খোঁজখবরও নিতে ইচ্ছে করেনি তোমার?

: করবে না কেন। এমন কথা কী করে বলো? ওই অস্থির দিনগুলোর কথা আজ তোমাকে বোঝাতে পারব না। তুমি যদি এ কাজটা না করতে...আমার এখন কী ইচ্ছে করছে জানো?

সোবহানের কথা শেষ না হতেই জোহরা বলে, ইচ্ছা করছে আমাকে খুন করতে, তাই তো? তোমার সামনে যখন পড়েই গেছি, তবে তুমি কেন এ কাজ করবে? আজ তুমি একজন স্বামী, তিনটি সন্তানের বাবা আর আটটি নাতি-নাতনির দাদা ও নানা। আমাকে মেরে থানা-পুলিশ-জেল...কী দরকার এসবের? তোমার জীবন থেকে তো আমি মরেই গেছি। তোমাকে দেখার ইচ্ছা ছিল, দেখছি। জীবনের শেষ কটা দিন এই শাস্তিটুকু নিয়েই কাটুক না। নতুন সংসার নিয়ে তুমি ভালো থাক। এ কামনাই করি।

একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে সোবহান বলে, এই যে শান্তির কথা বললে, আমার বেলায় তা আর হলো কই। সারাক্ষণ তোমার কথা মনে পড়ে। মাঝেমধ্যে খুবই রাগ করি। আবার কখন যে চোখ দুটো ভিজে যায় নিজেও জানি না। আমাকে ভুল বুঝো না বউ। মনের শখে বিয়ে করিনি। জীবনের দায়ে...। সদ্য মা-মরা সংসারে ছেলেকে সৎমায়ের মুখোমুখি না করে বাবা ঘরে আনেন তোমাকে। এমন একা হয়ে পড়ছিলাম যে মনের ওই জোরও ছিল না যে তোমাকে খুঁজব। এত সাহস নিয়ে যুদ্ধ করছি, অথচ ফিরে এসে দেখি আমার আর কেউ নেই। বাবার কর্মকাল, করুণ পরিণতি, তখন ঘর থেকে বের হতেই কেমন যেন লাগত।

প্রবল আগ্রহে জোহরা সোবহানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিনিটখানেক নীরবেই কাটে। তারপর চোখ মুছে জোহরা থেমে থেমে বলে যায়, তুমি চলে গেলে নিজেকে বড় অসহায় লাগছিল। মা-বাবার কথা খুব মনে পড়তে থাকে। একবার ভাবছি যে বাবার কাছেই চলে যাই। আবার মনে হলো কে জানে কোথায় আছে আমার বাবা-মা। এদিকে শ্বশুর মানে তোমার বাবা সবুর আলী খুব ব্যস্ত। একটু কথা বলার সুযোগ পাই না। সুযোগ পেলেও ভয়ে চুপসে যাই। বলতে পারি না।

তোমার বাবার দাপটে এলাকা থরথর করে কাঁপছে। দিন-রাতের কোনো তোয়াক্কা নেই। যখন-তখন মিলিটারির ক্যাম্পে যায়। তুমি চলে যাওয়ার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ জুলাই মাসের ১৭ তারিখ শনিবার বিকেলে তোমার বাবা এসে বলেন, বউমা, চার-পাঁচজন লোক আসবে রাতে। তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করো। তারপর ঘরের বড় মোরগটা রান্না করি, ডিম ভুনা, পোলাও—সব রেডি করে গোসল সেরে তাকে এসে বলি। কিছুক্ষণ পরই দেখি তোমার বাবা তিনজন আর্মিকে নিয়ে ঘরে ঢুকছেন। আমি আর কী করি। সুন্দর করে সব সাজিয়ে দিয়েছি। আর বাবা ওদের খাবার তদারকি করছেন। ওদের অনুরোধে বাবাও তাদের সঙ্গে খেতে বসেন।

খাবারের শেষ পর্যায়ে পানির জগটা খালি হয়ে গেলে বাবা আমাকে ডাক দেন। ওদের সামনে থেকে জগটা নিয়ে কলসি থেকে পানি ভরে আবার তাদের সামনে রেখে আসি। ভেতর থেকে শুনতে পাই একজন আর্মি বাবাকে বলছে, ইয়ে কোন হ্যায়? তোমহারা বেটি?

বাবা বললেন, নেহি, হামারা পড়শান।

আর্মি বলে, বহুত আচ্ছা লাড়কি হ্যায়।

তারপর বাবার সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কী কথা হয় শুনতে পাইনি। ইতিমধ্যে খাওয়াদাওয়া শেষ হয়। রাত তখন প্রায় ১০টা। বাবা ভেতরে এসে আমাকে কানে কানে বলেন, মা, ওরা হইল বাঘা জাতি। খানের ঘরে খানই হইব। তুই মা অমত করিস না।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনটা আর্মি ভেতরে এসে আমাকে জাপটিয়ে ধরে। পেছন থেকে আরেকজন চেপে ধরে আমার মুখ। চিৎকার দেব কী, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। ওরা আমাকে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। দেখি আমার মতো এমন আরও ছয়টি মেয়ে ওখানে। গায়ে কাপড় নেই। আহা রে। ওই ঘটনা আর বলতে পারব না...।

বলেই জোহরা ডুকরিয়ে কান্না শুরু করে।

সোবহানের চোখ দুটো কখন ভিজে গেছে হয়তো সে নিজেও জানে না। নীরবে চোখ মুছে বলে, হ্যাঁ, তুমি বলো। আমি শুনছি।

: একপর্যায়ে আমি গর্ভবতী হয়ে পড়ি। কিছুই খেতে পারি না। আর্মিরা ঘন ডাল আর রুটি দেয়। দেখলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। শুধু জীবনটা বাঁচাতে কষ্ট করে এক লোকমা মুখে দিতেই পেটে তোলপাড় করে শুরু হয় বমি। শরীর কেঁপে জ্বর আসে। সারা রাত শুধু কাঁদি। এই দেখে অত্যাচার কিছুটা কমে আসে। এমনই এক রাতে পায়ের শিকল খুলে দিয়ে আমাকে ক্যাম্প থেকে বের করে নিয়ে আসে মাঠের মাঝখানে। দুজন আর্মি আমাকে এলোপাতাড়ি লাথি মারতে থাকে। মাঠের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে আবার শুরু করে লাথি। একবার একজনের পা জড়িয়ে ধরি তো আরেকবার জড়িয়ে ধরি আরেকজনের। শেষ লাথিটা দেয় আমার মুখের ওপর। নাকটা থেঁতলে ওপরের ঠোঁট কেটে সামনের একটা দাঁত ভেঙে যায়।

কোনোভাবে টলতে টলতে কিছুক্ষণ হাঁটি। আবার কিছুক্ষণ বসি। কোথায় কোন দিকে হাঁটছি কিছুই জানি না। দূরে কোথায় যেন শিয়াল ডাকছে। অন্ধকার আর অন্ধকার। আকাশে দু-একটা তারা দেখা যায়। একটু একটু শীত করছে। এভাবেই হাঁটতে থাকি। হঠাৎ করেই টের পাই রক্তে আমার পা দুটো ভিজে যাচ্ছে। বুঝতে আর বাকি থাকে না আমার গর্ভপাত হয়ে গেছে।

ছোট্ট একটা গ্রামের পাশে আসতেই ভোর হয়ে আসে। বেশ বড় একটা বাড়িতে গিয়ে এক মহিলাকে মা ডেকে আশ্রয় চাই। জানি না কী ভেবে ওরা আমাকে আশ্রয় দেয়। তত দিনে ইন্ডিয়ান আর্মিরা বিমান হামলা শুরু করে দিয়েছে। এ সময় পাকিস্তানি হানাদারেরা দুর্বল হয়ে পড়ে। অত্যাচার কমে আসে। ওই গ্রামে একজন পল্লিচিকিৎসক ছিল। আমাকে কিছু ওষুধ দেয়। আস্তে আস্তে সুস্থ হই। ওইটা ছিল ঈশাননগর গ্রাম। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়েছে জেনে পরের দিন সন্ধ্যায় বড় আশা নিয়ে বাড়িতে যাই। আশপাশের মানুষ আমাকে দেখতে আসে। লোকজন নানান প্রশ্ন করে চলেছে। কোনো কথারই জবাব দিই না। তোমার বাবা বাড়িতে নেই। রাত একটার দিকে হঠাৎ দেখি খুব আস্তে আস্তে উনি দরজা খুলতে চেষ্টা করছেন। টের পেয়ে আমি দরজা খুলে দিই।

আমাকে দেখে তোমার বাবা হুংকার দিয়ে ওঠেন, যদি বাঁচতে চাস এ বাড়ির নাম চিরতরে ভুলে যা। আমার সোবহান দু-এক দিনের মধ্যে ফিরা আসব। ছেলেকে পাক-পবিত্র একটা মেয়ে বিয়া করাব। কাল সকালে যদি তোকে এ বাড়িতে দেখি, জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।

আমি কাঁপতে কাঁপতে তাঁর পা ধরে বললাম, বাবা, আপনার চোখের সামনেই তো সব। এখন এসব কী বলছেন। আমার কী দোষ?

তুই মিলিটারির রক্ষিতা। যা, পাকিস্তান চলে যা।

রাগে আমার শরীরটা রি রি করে কাঁপতে শুরু করে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আচ্ছা বাবা। আমি পাকিস্তানই যাচ্ছি। আপনারা সুখে থাকেন।

তোমার বাবা বলেন, আচ্ছা, মনে থাকে যেন।

তখন মনে মনে ভেবেছিলাম, ঘরের কোণে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে রাখা আমার অলংকারগুলো নিয়ে যাব।

সোবহান বলে, হ্যাঁ, যুদ্ধ শুরু হলে তুমি আর আমি দুজনে মিলেই গর্তে মাটিচাপা দিয়েছিলাম সেগুলো।

: হ্যাঁ, তাই। এ সময় তোমার বাবাকে দেখি সিন্দুকটা খুলে প্রায় দুই কেজি ওজনের একটা অলংকারের ব্যাগ বের করতে। ঝনঝন আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারি এগুলো কী। সঙ্গে কিছু কাপড় আর দশ-এগারো বান্ডিল টাকাসহ বাবা সব একত্র করে একটা বড় ব্যাগে রাখেন। তারপর আবার সিন্দুকটা খুলে ভেতর থেকে কী যেন বের করতে যাবেন, ঠিক তখনই সিন্দুকের ঢাকনাটার চিপায় ফেলে বঁটি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তাঁকে খুন করি। তারপর শুধু আমার অলংকারগুলো নিয়েই আমি পালিয়ে যাই। বাকিগুলো ওভাবেই পড়ে ছিল।

হ্যাঁ, সকালেই আমি বাড়িতে আসি। সব এমনই পেয়েছি। বাবার মৃত্যু ও সঙ্গে তোমার নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে লোকজন সন্দেহ করেছে যে ঘটনাটা তুমিই ঘটিয়েছ। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও বাবাকে খুঁজছিল।

চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে জোহরা বলে, ওই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আমি পাগল হয়ে যাই। কেন যে বেঁচে আছি জানি না। একটা প্রশ্নের জবাব আজও পাইনি। আমাকে ধরে ক্যাম্পে নেওয়ার চার দিন পর তোমার বাবাকে দেখি ক্যাম্পের বাইরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন বলছেন।

সোবহান গলা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, কী বলছেন?

জোহরা উদাস দৃষ্টিতে সোবহানের মুখের দিকে চেয়েই থাকে শুধু। অঝোর কান্নায় জোহরা আর কোনো কথাই বলতে পারে না।


ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>