একাত্তরের হিটলার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অনেক কিছু নিয়ে তো লিখলেন অপু বাবু। এবার কিছু কার্যকরী বিষয় নিয়ে লিখুন।

প্রকাশকের কথা শুনে লেখক অপু বাবু থ খেয়ে গেলেন। কী বলতে চান প্রকাশক সাহেব। তাহলে এত দিন যা লিখলাম তা কি কার্যকরী নয়, সব অর্থহীন?

প্রকাশকের চোখের দিকে মস্ত বড় প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো তাকিয়ে আছেন অপু বাবু।

: অমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন। আমি অবান্তর কিছু বলছি?

: না, মানে ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী নিয়ে আমাকে লিখতে বলছেন?

: বলছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখুন।

: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তো অনেক লিখেছি। আমার লেখার বিষয়ই তো মুক্তিযুদ্ধ।

: জানি, জানি। আমিই আপনার সব বই প্রকাশ করেছি। আমি জানব না?

: তা হলে আর কোনো বিষয় নিয়ে লেখা বাদ আছে?

একটু ঢোক গিলে, কিছুটা হেঁয়ালি করে প্রকাশক বললেন, আছে অপু বাবু, আছে। এখনো অনেক বিষয় বাকি আছে। একজন লেখক যদি সারা জীবন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখেন, তাহলে হয়তো লাখ ভাগের এক ভাগই লিখতে পারবেন। বাকিটা অলিখিতই থেকে যাবে। কেউ তো আর হাজার বছর বাঁচেন না। এই ধরুন, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। একজন শহীদের একটি করে কাহিনি হলেও ত্রিশ লাখ কাহিনি আছে। দুই লাখ মা-বোন তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। ন্যূনতম একটি করে কাহিনি হলেও আরও দুই লাখ কাহিনি আছে। কোনো লোকের পক্ষে কি বারো লাখ কাহিনি লেখা সম্ভব?

প্রকাশকের কথায় হতভম্ব অপু বাবু। এমন করে তিনি তো কখনো ভাবেননি। প্রকাশককে তিনি বলেন, না, তা তো সম্ভব নয়। আমাকে কোন বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে বলছেন?

: গ্রামে চলে যান কিছুদিনের জন্য। বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করুন। তাঁদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনা তৈরি করুন। সেসব ঘটনা এতই মর্মন্তুদ যে, দেখবেন গল্পকেও হার মানিয়ে গেছে। কেউ খুব সহজে মুখ খুলতে চাইবেন না। বুদ্ধি দিয়ে, শ্রদ্ধাবোধ দিয়ে, যথাযথ সম্মান দিয়ে, মর্যাদার সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। এই নিন আপনার আগের বইয়ের রয়্যালটির চেক।

খামের ভেতর মোড়ানো চেকটি বুক পকেটে ঢুকিয়ে গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেলেন অপু বাবু। আগে তো তিনি কখনো এসব বিষয় নিয়ে এমন করে ভাবেননি। তাঁর নিজ জেলায় খোঁজখবর নিলেই অসংখ্য বীরাঙ্গনার সন্ধান পাওয়া যাবে। মুহূর্তের মধ্যে এক পলকে কী যেন ভেবে নিলেন অপু বাবু। বোধ হয় ভাবছেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরও আগেই শুরু করা দরকার ছিল।

: আমি তাহলে উঠি, দাদা।

বলেই প্রকাশকের সঙ্গে করমর্দন করে বেরিয়ে পড়লেন অপু বাবু। বাংলাবাজার থেকে কাঁঠালবাগান নিজের বাসায় আসার পথে বীরাঙ্গনাদের কথা ভাবতে ভাবতে মাথার মধ্যে একটি ছক কষে নিলেন তিনি। বাসায় থাকা এ-সংক্রান্ত কয়েকটি বইয়ের কথাও স্মরণ করলেন। এত দিন পত্রপত্রিকায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনা যা পড়েছেন, সেগুলোও স্মরণ করতে চেষ্টা করলেন এক মুহূর্তে।

খুব বেশি বড় বা জটিল অভিযান নয়। লেখার রসদ জোগাড় করতে মানুষ তো দেশ থেকে দেশান্তর, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশেও পাড়ি দেয়। আর এ তো ঢাকা থেকে নিজের গ্রামের বাড়ি যাওয়া। নিজের জেলায় দু-চারজন বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার নেওয়া। বিষয়টি খুব বেশি জটিল হবে বলে মনে হয় না লেখকের।

দুই.

জীবনের ভরদুপুরে সন্ধ্যা নেমে আসে আলো রানীর জীবনে। প্রকট অন্ধকারময় সন্ধ্যা। আকাশে কোনো মেঘ ছিল না সেদিন। তবু যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় তাঁর ওপর। স্বামীর রক্তে মুছে যায় তাঁর সিঁথির সিঁদুর। বর্বর পাকিস্তানি সেনার গুলিতে স্বামীর দেহ যখন নিথর, তখন তারা উন্মাতাল হয় আলো রানীর শরীর নিয়ে। স্বামীকে হত্যা করে লালসা মিটিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি, পাকিস্তানি পশুর দল আলো রানীকে পুড়িয়ে মারারও চেষ্টা করে। ভাগ্যক্রমেই বেঁচে যান আলো রানী। দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু আলো রানীর জীবনে আর ফুটল না আলো। অন্ধকারই রয়ে গেল তাঁর জীবন। নিঃসন্তান আলো রানী নিজের জীবনকে আর কারও সঙ্গে জড়াননি। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের ঘটনাকে তিনি নিয়তির লেখন বলেই মেনে নিয়েছেন। এ-বাড়ি ও-বাড়িতে কাজ করে চলছে তাঁর জীবন এখন কোনো রকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কেউ তাঁর খোঁজ নেয়নি।

দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে আলো রানীর জন্ম। মা-বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে আলো রানী সবার বড়। পাশাপাশি গ্রামে একজন কৃষিজীবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর আগে। কোনো সন্তান হয়নি আলো রানীর। হবেই-বা কী করে? অন্ধকারই তো দূর হলো না তাঁর জীবন থেকে।

অপু বাবু আগে থেকেই লোক মারফত যোগাযোগ করেন আলো রানীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন তিনি। নির্ধারিত দিন বাবার বাড়ি থেকে ঘটনাস্থলে আসেন তিনি। যেখানটায় একাত্তরে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।

প্রথমে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন আলো রানী। সেসব কথা বলে আর কী লাভ? জীবন থেকে যা হারিয়ে গেছে, তা কি আর ফিরে আসবে কোনো দিন। অপু বাবুর পীড়াপীড়িতে রাজি হন শেষ পর্যন্ত। নানা বিষয় আলাপচারিতার পর ঘটনা বলা শুরু করেন আলো রানী।

একটি আমগাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো আলো রানী চারদিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। জেলার সদর উপজেলার হিন্দু-অধ্যুষিত একটি গ্রামে ধনাঢ্য এক ব্যক্তির বাড়িতে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। আলো রানী বলেন, গ্রামে পাঞ্জাবি মিলিটারিরা আসছে, এ কথা শুনে হিন্দু গ্রামবাসী যে যার মতো পালানোর চেষ্টা করেন। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের দোসররা হিন্দুদের আশ্বস্ত করে বলে, তোমরা পালাবে কেন? আমরা থাকতে তোমাদের কোনো ক্ষতি হতে দেব না। তারা তোমাদের দু-একটি প্রশ্ন করতে পারে। তারপরই তারা চলে যাবে। গ্রামের মোড়ল খবির মোল্লার ওপর সবার বিশ্বাস ছিল। খবির মোল্লা ও তার সহযোগীরা সব হিন্দু পরিবারে গিয়ে অভয় দেয়, তোমরা কেউ পালাবে না। আমরা তোমাদের সব ধরনের নিরাপত্তা দেব। সহজ-সরল লোকজন কথার ফাঁদে পড়ে যার যার বাড়িতে অবস্থান করেন।

এরপর? এর কী হলো? প্রশ্ন করেন অপু বাবু।

এরপরই পাঞ্জাবিরা গ্রাম ঘিরে ফেলে। কেউ কোনো দিকে পালানোর সুযোগ পায়নি। পাঞ্জাবি, খবির মোল্লা ও তার লোকজন বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে ধরে এনে ধনী এক গৃহস্থের বাড়িতে জড়ো করে। সেই দলে আমি, আমার স্বামী, অন্য একজন মহিলাসহ আরও অনেকে ছিলেন।

গা শিহরিত হয় লেখক অপু বাবুর। এরপর আলো রানী না জানি কোন ভয়ংকর কথা বলে।

: তারপর? তারপর কী হলো, মাসি?

তারপর? তারপর সেদিন সবাইকে সারিবদ্ধভাবে গৃহস্থের বাড়ির পাশের মাঠে দাঁড় করায়। আমাকেও অন্য একজন বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে ধরে নিয়ে গৃহস্থের ঘরে প্রবেশ করে ছয় পাকিস্তানি সেনা। ওদিকে সারিবদ্ধভাবে যাঁদের দাঁড় করানো হয়েছিল, তাঁদের প্রত্যেককে একে একে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিন ওখানে আমার স্বামীসহ ২৬ জনকে হত্যা করা হয়। তাঁরা সবাই ছিলেন হিন্দু। আমাকেসহ ওই মহিলাকে তিনজন করে ভাগ করে নেয় পাকিস্তানি সেনারা। এরপর তারা পাশবিকতায় মেতে ওঠে।

শিহরিত হন লেখক অপু বাবু। লজ্জাবনত চোখে তাকান তিনি আলো রানীর দিকে। তাঁদের সম্ভ্রমহানির বিনিময়েই অর্জিত হলো আমাদের স্বাধীনতা। শুষ্ক গলায় অপু বললেন, তারপর?

আমাদের দুজনের আর্তচিৎকারে যখন আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আসছিল, তখন হায়েনারা মেতে উঠেছিল বিকৃত উল্লাসে। পাশবিকতা চালিয়ে রক্তাক্ত করে নিস্তেজ দেহের আমাদের দুজনকে ঘরের মধ্যে রেখেই বাইরে থেকে কড়া লাগিয়ে দেয় দরজায়। বৃদ্ধ গেরস্ত ও তাঁর স্ত্রীও ছিলেন অন্য রুমে। এরপর খবির মোল্লা ও তার সহযোগীরা ঘরের সব মালপত্র লুণ্ঠন করে। বাইরে আমি খবির মোল্লার কণ্ঠ শুনতে পাই। চিৎকার দিয়ে তার সাহায্য প্রার্থনা করি। খবির মোল্লা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এরপর তারা বাইরে থেকে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়।

নিজেকে যেন আর স্থির রাখতে পারেন না অপু বাবু। এ গল্প সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। মনে পড়ে তাঁর প্রকাশকের কথা। ত্রিশ লাখ শহীদের ত্রিশ লাখ কাহিনি। দুই লাখ মা-বোনের দুই লাখ কাহিনি।

অপু বাবু প্রশ্ন করেন, তারপর কীভাবে বেঁচে গেলেন?

: বেঁচে গেলাম কই, বাবা? মরে গেলেই তো ভালো ছিল। যে অপমান সহ্য করে বেঁচে আছি, মৃত্যু তো তার চেয়ে ভালোই ছিল।

এবার অনেকটা ভারাক্রান্ত লাগছে আলো রানীকে।

অপু বাবু আলো রানীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘটনার এ পর্যায়ে এসে তিনি যেন খেই হারিয়ে ফেলেছেন। আর কোনো প্রশ্ন করার ফুরসত পাচ্ছেন না। ঘরের মধ্যে চারজন জীবন্ত লোককে রেখে বাইরে থেকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া? এ কেমন বর্বরতা?

: তারপর? তারপর কীভাবে বেঁচে গেলেন?

: তারপর, একজন আর একজনকে ধরাধরি করে কোনো রকম উঠে দাঁড়াই। কোনো রকমে বাইরে বের হয়ে আসি। এরপর পালাতে থাকি যে যাঁর মতো করে। ঘরে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা পুড়ে ছাই হয়ে যান। তাঁরা বাইরে বের হয়ে আসতে পারেননি। আমি ঘর থেকে বের হয়ে হাওরের মাঝ দিয়ে দৌড়াতে থাকি। আমার বাবার বাড়ির পাশের একটি নদীর পাড়ে এসে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। সেখানে গ্রামের এক লোক আমাকে দেখতে পান। তিনি উদ্ধার করে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেন। মাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। মা আমাকে এটা-সেটা বলে সান্ত্বনা দিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে লাশগুলো ওই গেরস্তবাড়িতেই পড়ে থাকে। দুই দিন পর গ্রামের লোকেরা গর্ত করে পুঁতে রাখেন লাশগুলো। তবে দুই দিন পড়ে থাকলেও পুনরায় অত্যাচার ও প্রাণ হারানোর ভয়ে আমার স্বামীর লাশটা দেখতে পারিনি।

এতটুকু বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন আলো রানী। ৪৯ বছর পর একাত্তর যেন আবার ফিরে এসেছে তাঁর কান্নার মধ্য দিয়ে।

দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু আলো রানীরা স্বাধীন হলেন না। স্বাধীনতা তাঁদের কাছে রয়ে গেল অধরা। যাঁরা আত্মোৎসর্গ করলেন, তাঁরা তো আর পরপারে বসে কিছু দেখতে পান না, স্বাধীন দেশে কী হচ্ছে। কিন্তু যাঁরা প্রাণে বেঁচে গেলেন, সম্ভ্রম দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনে দিলেন, তাঁরা টের পাচ্ছেন বেঁচে থাকার জ্বালা কাকে বলে। এই সমাজ সেই ধিক্কৃত সমাজ, যে সমাজ নির্যাতিতাকেই ভর্ৎসনা করে, অবজ্ঞা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন দেখছিলেন আলো রানী। কিন্তু না, আলো রানী স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ পাননি। সমাজের লোকজন তাঁর দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে থাকে। দুর্বিষহ ঘটনার মুহূর্তগুলোকে ভুলে থাকতে চাইতেন তিনি। কিন্তু সগোত্রীয়রাই সেই নির্মম ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি করে তাঁকে বিষিয়ে তুলত। আগুন ছাড়াই দগ্ধ হতেন তিনি। যেন দেহ বিকিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি স্বপ্রণোদিত হয়েই পাঞ্জাবিদের কাছে গিয়েছেন। চোখের জলকে সম্বল করে বেঁচে থাকেন আলো রানী। চোখের জল তো আর সাগর নয় যে ফুরাবে না। একসময় চোখের জলও ফুরিয়ে যায়। গা সওয়া হয় সবকিছু আলো রানীর।

ডিসেম্বর মাস। শীত তেমন ঝাঁকিয়ে বসেনি এখনো। দুপুর না গড়াতেই বিকেল বিকেল মনে হচ্ছে। সূর্য এখন পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত না গিয়ে মনে হয় দক্ষিণ দিকে উদিত হয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় নিতে পারলেই বাঁচে।

: আবার সংসার করলেন না কেন, মাসি?

প্রশ্নটা করে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছেন লেখক অপু। মনে হয় প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি তাঁর।

জবাব দিলেন আলো রানী। একবার যখন ভেঙে গেছে তা আর জোড়া লাগিয়ে লাভ কী? স্বামীভাগ্য আমার নেই, বাবা। তা ছাড়া যে মানুষটাকে আমার সামনে থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারল পাঞ্জাবিরা। যাঁর রক্তে মুছে গেছে আমার সিঁথির সিঁদুর। কী করে আমার সেই সিঁথিতে সিঁদুর পরি, বাবা?

বীরাঙ্গনা আলো রানীর এবারের কথাটাকে বেশ ভারী মনে হলো অপু বাবুর কাছে। হিন্দু নারীর পতি ভক্তির একটা দৃষ্টান্ত প্রকাশ পেল আলো রানীর কথায়।

: এখন আপনার সংসার কীভাবে চলছে? না, মানে...।

প্রশ্ন করলেন অপু বাবু।

: আমার তো কোনো সংসার নাই রে, বাবা। মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে জন্মভিটায় থাকি। ভাই যতটুকু পারে সহযোগিতা করে। এ-বাড়ি ও-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে কোনো রকমে বেঁচে আছি। শরীর আর চলে না। অমাবস্যা-পূর্ণিমাতে শরীরের ব্যথা বেড়ে যায়। ডাক্তার দেখাতে পারি না টাকার অভাবে। আরও নানা মেয়েলি রোগ দেখা দিছে। তোমার সব কথা কি শেষ হয়েছে, বাবা?

অপু বাবু জানেন না তাঁর সব প্রশ্ন শেষ হয়েছে কি না। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা শোভা পায় আর বীরাঙ্গনারা পরের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ কেমন স্বাধীনতা?

: আমি কি যেতে পারি, বাবা?

করুণ চোখে আলো রানী অপু বাবুর দিকে তাকালেন।

: যাবেন?

ধরা গলায় জবাব দিলেন অপু বাবু। কী বলে আলো রানীকে সান্ত্বনা দেবেন, তার কোনো জুতসই উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। কীভাবে তাঁকে সম্মান জানাবেন, সেটাও বুঝতে পারছেন না। আরও কিছু প্রশ্ন তাঁর করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু আলো রানী আর যেন দাঁড়াতে চান না।

আমার শেষ প্রশ্ন, মাসি, একাত্তর নিয়ে আপনার কোনো খেদ আছে?

একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালেন আলো রানী। ঢোক গিলে বললেন, আমার চোখের সামনে পাঞ্জাবিরা আমার স্বামীকে গুলি করে মারল। একই সময়ে তিনজন পাষণ্ড আমার ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাল। এরপর ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল পুড়িয়ে মারার জন্য। জীবনটাই আমার ব্যর্থ হয়ে গেল। বেঁচে আছি নানা প্রকার অপমান সহ্য করে। এরপর কোনো খেদ রেখে কী লাভ? দেশটা যে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হলো, সেটাই তো বড় পাওনা, বাবা। না, আমার কোনো খেদ নাই। সেদিন তো সবার সঙ্গে মারাও যেতে পারতাম। সেটাই বরং ভালো ছিল।

স্যাক্রিফাইস, স্যাক্রিফাইস একমাত্র বীরাঙ্গনারাই পারে এত বড় স্যাক্রিফাইস করতে। প্রকাশকের সেই কথাটি আবার মনে পড়ল অপু বাবুর। গল্পকেও হার মানাতে পারে, এমন সব ঘটনা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধে। ত্রিশ লাখ শহীদের ত্রিশ লাখ ঘটনা, দুই লাখ বীরাঙ্গনার দুই লাখ ঘটনা।

এবার বিদায়ের পালা। অপু বাবু পকেট থেকে বের করে কিছু টাকা দিলেন আলো রানীর হাতে। টাকাগুলো হাতে নিয়ে আলো রানী একবার তাকিয়ে বাঁ হাতে মুঠো করে রাখলেন। তারপর অপু বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেঁচে থাকো, বাবা।

বিদায় বলে গন্তব্যে রওনা হলেন অপু বাবু। বাস ছুটে চলেছে জেলা সদরের দিকে। বারবার তাঁর মনের মণিকোঠায় তোলপাড় করছে আলো রানীর কথাগুলো। ভাবলেন, আমাদের স্বাধীনতার মূল্যটা একটু বেশিই পড়ে গেল না?

(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বীরাঙ্গনা কথা, অপূর্ব শর্মা)

তপন দেবনাথ: লস অ্যাঞ্জেলেস, যুক্তরাষ্ট্র।