একাত্তরের প্রলয়ংকরী এক নিশি

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমাদের বিজয় অর্জনের আজ ৪৮ বছর। এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে সগৌরবে আমরা অবস্থান করছি। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নতি সাধন করা আমাদের পক্ষে এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এর পাশাপাশি আছে আমাদের ইতিহাস বিস্মৃতির প্রবণতা।

শুধু নতুন প্রজন্ম নয়, আজ জাতির বড় একটা অংশ যেভাবে দেশের আসল ইতিহাসকে ভুলে যাচ্ছেন, তা দেখে মনে পড়ে যায়, ‘ব্ল্যাক ইন্ডিয়ান’ প্রামাণ্য চলচিত্রের Circle of Life, Series -এর একটি সংলাপ—‘To build the future you must know the past. But what if that past has been hidden, lost or denied?’

বাংলাদেশের সত্যাশ্রয়ী মানুষের কাছে উপরিউক্ত প্রশ্নটি করে আমি লিখতে যাচ্ছি ১৯৭১ সালের যুদ্ধকবলিত দিনগুলোতে আমার চোখে দেখা অনেক ঘটনাবলির হৃদয়বিদারক একটি ঘটনার কথা। যে বিষয়টি এত বছর পরও ভোরের তাজা খবরের মতো আমার কানে আজও ভেসে আসছে।

দিন–তারিখ আমার ঠিক মনে নেই। সম্ভবত আগস্ট মাসের শেষের দিক আর বাংলা ভাদ্র মাসের শুরুর দিকে হবে। আউলিয়াদের পুণ্যভূমি নামে খ্যাত সিলেট জেলা। এই সেই জেলার বিয়ানীবাজার থানার কসবা গ্রাম। তখন সারা দেশের মতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের এ দেশীয় সহযোগী আর রাজাকাররা আমাদের এলাকাতেও নির্বিচারে হত্যা-ধর্ষণ আর নির্যাতন চালাচ্ছে।

প্রতি রাতেই দালাল আর রাজাকারদের সহযোগিতায় যুবতীদের ধরে ধরে পাশবিক অত্যাচার করা হচ্ছে। অত্যাচারের পর ইচ্ছে হলে বেয়নেট দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করছে, কিংবা গুলি করে মেরে ফেলছে।

বীভৎস ভয়ংকর পরিস্থিতি চারদিকে বিরাজমান। এক রাতে সহযোগী ও রাজাকারদের মুখে খবর পেয়ে সাতজন পাকিস্তানি সেনা যুবতী মনিরাকে (ছদ্মনাম) ভোগের জন্য ধরে নিয়ে যেতে এল। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে নিভৃত শান্ত সুন্দর কসবা গ্রামের মানুষ যখন অর্ধঘুমন্ত। ঠিক এমন স্থানীয় জামায়াতের দুই কর্মী পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ে এসে লেলিয়ে দেয় মনিরার ওপর।

মনিরার আকাশ প্রকম্পিত আর্তনাদ আর সম্ভ্রম রক্ষার আকুল আকুতি ছিল ওদের কাছে অরণ্যের রোদন মাত্র। পাষণ্ডদের কাছে এসব বিষয় ছিল আনন্দের ও ভোগের। তারা পাঁজাকোলা মনিরাকে ধরে। এ সময় মনিরার বৃদ্ধ মা বাধা দিতে গেলে এক পাকিস্তানি সেনা বুট পরা পায়ে লাথি মেরে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে যায়।

পাকস্তানি সেনারা তাঁকে নিয়ে যায় মনিরাদের বাড়ির পাশে অবস্থিত একটি মক্তব ঘরের ভেতর। এই মক্তবে আমরা পাড়ার সব ছেলেমেয়ে ভোরবেলা কোরআন শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করতাম। ঘরের ভেতর অনেক কোরআন-শরিফ রাখা আছে। ওই মক্তবে কিছুদিন আগে মনিরাও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছে।

অতঃপর পাকিস্তানি সেনারা পালাক্রমে মনিরাকে ধর্ষণ করতে থাকে। ষোড়শী মনিরা একসময় জ্ঞান হারিয়ে আড়ষ্ট নিথর দেহে পড়ে থাকে পবিত্র মক্তব ঘরে। ঘটনা এখানে শেষ নয়। পরে তাকে টেনেহিঁচড়ে জলপাই রঙের জিপের ভেতর তোলা হয় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

ওই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিল পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন ইফতেখার হোসেন গন্দল। একাত্তরে তাকে বিয়ানীবাজারের আজরাইল নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তার নাম শুনলে নিরীহ মানুষজন মুরগির ছানার মতো নিরাপদ আশ্রয় খুঁজত। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করত মানুষের বাঁচা-মরা।

এই কুখ্যাত গন্দলের ভোগের জন্য মনিরাকে যখন বিয়ানীবাজার ডাক বাংলায় নিয়ে যাওয়া হয় পূর্বাশায় তখন ধীরে ধীরে রং মাখছে প্রভাত রবি। চারদিকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের সুমধুর সুর ভোরের শান্ত বাতাসে ভেসে আসছে। ঠিক তখনই অত্যাচার পীড়িত ভীত-সন্ত্রস্ত অসহায় মনিরার ওপর যৌনক্ষুধা নিবারণের জন্য ক্যাপটেন গন্দল উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মনিরার করুণ কান্নার সুর ভোরের বাতাস ভারী করে ডাকবাংলোর দেয়ালে দেয়ালে, গাছে-গাছে, বন-বনান্তরে এমনকি নীলাভ অন্তরিক্ষের বুক বিদীর্ণ করে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে কেঁদে কেঁদে ফিরে এসেছে।

রাতে পুবের বাড়ির মনিরাকে পাঞ্জাবিরা ধরে নিয়ে গেছে। আর তার ওপর কী কী হয়েছে তার অনেকটা সাতসকালে মক্তবে আসতে আসতে আমরা কিশোর-কিশোরীরা জেনে ফেলি। কৈশোরের কৌতূহলী মনে তখন প্রশ্নের প্রচণ্ড আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু সাহস হয় কার কাউকে জিজ্ঞাসা করার।

ইতিমধ্যে মক্তবের সামনে বড়রাও এসে ভিড় জমিয়েছেন। মক্তবের হুজুর আর বড়দের মধ্যে অনেকক্ষণ ফিসফিসানি কথাবার্তা চলল। আমাদের মক্তবের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলো না। সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

এদিকে আমার মতো চঞ্চল কৌতূহলী কিছু ছেলে বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে মক্তবঘরের ভেতরে চলে গেলাম। ভেতরে গিয়ে দেখলাম ছোট ছোট তিনখানা মুরতা বেতের তৈরি শীতলপাটি ঘরের মাঝখানে মাটিতে বিছানো। পাটির ওপরটা রক্তাক্ত।

তখন আমি নয় বছরের বালক ছিলাম। তবে বোধশক্তির প্রখরতা বাড়তিই ছিল বলতে হয়। তা না হলে এত ছোটকালের এ কাহিনি এখনো স্পষ্ট মনে থাকে কীভাবে। ভাবতে নিজের কাছেই বিস্ময় লাগে।

যা হোক, বড়দের সঙ্গে আলোচনা শেষে ছেলেদের কয়েকজনকে মক্তবের হুজুর নির্দেশ দিলেন, ওই রক্তাক্ত শীতলপাটিগুলো গ্রামের বুকচিরে বয়ে যাওয়া লোলা নদীর প্রবাহিত জলে ফেলে আসার জন্য। মেয়েদের মক্তবঘরের ভেতর লেপার (নিকানো) জন্য আদেশ দিলেন।

উল্লেখ্য, ওই সকালে কেবল পবিত্রতার কাজই চলতে থাকল এবং পড়াশোনার কাজ স্থগিত রইল।

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার মনিরা অবশ্য ওই দিন বিকেলে ভাগ্যক্রমে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছিল। কিন্তু বাংলার আরও হাজার হাজার ভাগ্যবিড়ম্বিত নারীর মতো সর্বস্ব হারিয়ে সেদিন সে বাড়ি ফিরেছিল। আমি নয় বছরের বালক এই ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার এক নির্মম অভিজ্ঞান সেদিন সেই সকালে অর্জন করেছিলাম। যা আমরণ আমার বুকে জ্বলবে শিখা অনির্বাণ হয়ে। আর চোখে থাকবে কঠিন হিমাদ্রির মতো স্থির হয়ে।

পাকিস্তানি হানাদার সেনা ও তাদের এ দেশীয় দালাল, আলবদর, রাজাকারদের কোনো দিনই আমরা ক্ষমা করব না। ক্ষমা করতে পারি না। সরকারের কাছে আমার একমাত্র প্রত্যাশা ও প্রাণের দাবি, গ্রেপ্তার সব দালাল, আলবদর ও রাজাকারের বিচার শেষ করে অনতিবিলম্বে যেন রায় কার্যকর করা হয়।