অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা

ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইকের ক্যাম্পাস। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত
ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইকের ক্যাম্পাস। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত

ছোট ঘটনা। কিন্তু বিশাল অনুভূতি। এটি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কারণ, এটি কারও কাছে ছোট, আবার কারও কাছে মহান। এটা সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। ঘটনা যত ছোট বা বড় হোক না কেন, আমার অনুভূতি যে বিশাল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সেদিন ছিল ডিসেম্বরের ৬ তারিখ (২০১৯) শুক্রবার। আমরা বন্ধুরা মাঝেমধ্যে দুপুরের খাবার খেতে ম্যাককনেল হলে যেতাম। যেটা বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় হল ক্যানটিন বা ডাইনিং বলে পরিচিত। সেদিনও গেলাম ফারদান নামে আরেক বন্ধুর সঙ্গে।

ফারদান আবার একটু গপ্পবাজ। দুজন একসঙ্গে থাকলে তো কথাই নেই। জুমার নামাজ আছে। তাই সবদিক বিবেচনা করে সবার আগেই আমরা গিয়ে হাজির। বাফেট খাবার। গপ্প শেষ হয় না।

ইতিমধ্যে মনের অজান্তে কখন যে প্রথম জুমার নামাজের সময় অতিক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পারিনি। সান্ত্বনা একটাই, দ্বিতীয় জুমার নামাজ আরও এক ঘণ্টা পর।

যা হোক, একটু পর হঠাৎ এক ভদ্রলোক স্যুট–কোট পরা অবস্থায় হাতে ঢাউস আকৃতির ব্যাগসহ আমাদের টেবিলের সামনে এসে হাজির। যেটা আমাদের দেশে ‍সাধারণত হকাররা করে থাকেন।

ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইকের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ভাইস চ্যান্সেলর ড. পল জ ম্যাজেরোলিই। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত
ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইকের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ভাইস চ্যান্সেলর ড. পল জ ম্যাজেরোলিই। ছবি: লেখকের মাধ্যমে প্রাপ্ত

আমাদের টেবিলটা অবশ্য একবারে সামনেই ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ‘হ্যালো’ বলেই নিজের পরিচয় না দিয়ে বললেন, তোমার পরের সপ্তাহে কি পরীক্ষা আছে? বলেই ব্যাগ থেকে একটা ছোট গিফট ব্যাগ আমার সামনে ধরলেন।

আমি একদম থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম, না আমার কোনো পরীক্ষা নেই।

তিনি আবার বললেন, তুমি কি এটা নিতে চাও?

আমি সানন্দে গ্রহণ করলাম। ভাবলাম, ক্রিসমাস উপলক্ষে তো এমন গিফট এখানে–সেখানে পাওয়া যায়।

আমার বন্ধু আগ্রহ নিয়েই বলল, আমার সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা আছে। সেও নিল।

উল্লেখ্য, পরের সপ্তাহে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা সপ্তাহ (কোনো ক্লাস নেই, শুধুই সেমিস্টার ফাইনাল এক্সাম) শুরু হবে।

আমরা গিফট আমাদের ব্যাগে রেখে দিয়ে খাওয়ায় মনোনিবেশ করলাম। দেখলাম ভদ্রলোক বিভিন্ন টেবিল ঘুরে ঘুরে গিফট বিতরণ করে চলে গেলেন।

লেখক
লেখক

রাতে বাসায় ফিরে গিফট ব্যাগ দেখলাম। দেখি ভেতরে চকলেট, চুইংগাম, পপকর্ন, কলমসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ভাইস চ্যান্সেলর ড. পল জ ম্যাজেরোলিইর উপদেশমূলক গুরুত্বপূর্ণ একটি নোট। ‘পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য পেটে বাতাসের চলাচল’ (ইংলিশ থেকে অনূদিত) শিরোনামসংবলিত তিন থেকে পাঁচ মিনিটের যোগব্যায়ামের নির্দেশনা।

এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। জানি এখানকার লোকজন ছোট ছোট বিষয়ের প্রতি কত খেয়াল। তারপরও একটি বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার মধ্যে। ‍যিনি গিফটটি দিলেন, তিনিই কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. পল জ ম্যাজেরোলিই। তিনি নিজেই কি এভাবে হকারের মতো করে গিফট দিতে পারেন। এত বড় একটি ব্যাগ। তাঁর সঙ্গে অন্য কেউ নেই তাঁকে সাহায্য করার জন্য।

রাতে আমার ওই বন্ধুর সঙ্গে কথা হলো। জানতে চাইলাম, তিনিই কি প্রেসিডেন্ট? সেও নিশ্চিত না, আমরা সামনাসামনি তাঁকে আগে দেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পেজে দেখেছি, কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা মেলাতে পারিনি।

সপ্তাহের প্রথম দিনেই (সোমবার) ল্যাবে গিয়ে প্রেসিডেন্ট অফিসে মেইল দিলাম। মেইলে আমার আগ্রহের বিষয়টি পরিষ্কার করে বললাম। একটু পর প্রেসিডেন্টের ছবিসহ উত্তর এল, ‘জি, উনিই প্রেসিডেন্ট ও ভাইস চ্যান্সেলর, ওনার হাত থেকেই আপনি গিফটটি পেয়েছেন!’

ধন্যে মাথা নত হয়ে গেল। এরা কত যত্নশীল আমাদের প্রতি। বিশ্ব তালিকায় এরা সামনে না থাকলে যে বড় অন্যায় হয়ে যায়।

নূর আলম: পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা।