কোরিয়ার গুয়াংজুতে এক টুকরো বাংলাদেশ

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য। ছবি: এস এ জামান
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য। ছবি: এস এ জামান

দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করা মানুষগুলো যেখানেই থাকুন না কেন তাঁর নিজ পরিচয় কখনোই ভুলে যান না। দূরে যেতে পারেন না তাঁর মূল শিকড় থেকে। শত কাজের মাঝেও যেকোনো দেশীয় উৎসব, বিশেষ দিনগুলোকে তাঁরা হৃদয় নিংড়ানো আবেগ আর ভালোবাসা দিয়েই উদ্‌যাপন করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজুতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের আয়োজনে উদ্‌যাপিত হয়েছে বাঙালির বিজয় দিনখ্যাত বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস।

গত রোববার (২২ ডিসেম্বর) গুয়াংজুর চোন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চোসান ইউনিভার্সিটি ও গুয়াংজু ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির (জিআইএসটি) বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এবং গুয়াংজুতে বসবাসরত পেশাজীবী বাংলাদেশিরা নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপন করেন এবারের মহান বিজয় দিবস।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য। ছবি: এস এ জামান
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য। ছবি: এস এ জামান

বাহারি খাবার ও ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত বাঙালিদের পদচারণে মুখরিত অনুষ্ঠানস্থলে সত্যি যেন পাওয়া গেল এক টুকরো বাংলাদেশ।

বেলা ১১টায় সোউমিক আইদানের সঞ্চালনায় বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে শুরু হয় অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব। ড. শামসুদ্দিন আহমেদের স্বাগত বক্তব্যর পরই আগত অতিথিসহ সবার উদ্দেশে বড় স্ক্রিনে উপস্থাপন করা হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র। যেখানে ফুটে ওঠে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর অন্যায় নিপীড়ন এবং সবশেষে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয়।

আগত কোরীয় অতিথিরা তাঁদের বক্তব্যে নিজ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও তার ইতিহাস বর্ণনা করেন ও বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।

এ পর্বে মুক্তিযুদ্ধকালে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অব্যক্ত কথাগুলো নিয়ে তাঁদের পাঠানো চিঠিগুলো থেকে কয়েকটা চিঠি পড়ে শোনান আহমেদ শামসুদ্দিন। এ সময় অনুষ্ঠানস্থলে নেমে আসে পিনপতন আবেগঘন নীরব পরিবেশ। এ ছাড়া ড. মো. বসির আহমেদ ও মারুফ খানের বক্তব্যে ফুটে ওঠে স্বাধীনতা-পরবর্তী আমাদের করণীয় কাজগুলোর কথা, যার স্বপ্ন দেখে এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন দেশের তখনকার বীর সন্তানেরা।

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: এস এ জামান
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: এস এ জামান

চোন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রিসার্চ অ্যান্ড গ্লোবাল হাব সেন্টারের মিলনায়তনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথিসহ কোরিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশিরা উপস্থিত ছিলেন।

বিশেষ অতিথি হিসেবে গুয়াংজু ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ও চোন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক শিন গিওংগু, কোরিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন গুয়াংজুর সভাপতি কিম ইয়ে শুক, টপ অর্থোপেডিক হসপিটালের চিকিৎসক ডা. ইয়ু বহ পাক, চোন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় অনুষদের অধ্যাপক কো ইল সুনকো উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে অতিথিদের জন্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নানা পদের খাবার নিয়ে আয়োজন করা হয় মধ্যাহ্নভোজের।

এর পরই তারিফ আহমেদের উপস্থাপনায় শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্বে সোউমিক আইদান ও তারিফ আহমেদের পরিচালনায় পরিবেশিত হয় একটি বিশেষ মঞ্চনাটিকা। এর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের কালরাত, মহান মুক্তিযুদ্ধর কিছু খণ্ডিত অংশ এবং পরিশেষে আমাদের বিজয়ের সেই ১৬ ডিসেম্বর।

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: এস এ জামান
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: এস এ জামান

এতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে মাসুম আহমেদ, রাজাকার চরিত্রে সম্রাট আহমেদ ও তারিফ আহমেদ, পাকিস্তানি সেনার চরিত্রে এস এ জামান, ফারুক আহমেদ ও তমাল খান এবং মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে হাসানুল বান্না, মাসুম আহমেদ ও হাসান তারেক অভিনয় করেন। নাটিকাটি সবার মন জয় করে। এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই হৃদয় কাঁপানো ভয়াল নয় মাস।

অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে ছিল গোলাম রাব্বানী ও তমাল খানের দেশাত্মবোধক সংগীত, যা সবাইকে আবেগতাড়িত করে তোলে।

সেই সঙ্গে আরও ছিল স্বাধীনতা নিয়ে কুইজ, যেখানে অংশগ্রহণ করেন শামসুদ্দিন আহমেদ, আহমেদ শামসুদ্দিন, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. বসির আহমেদ, ড. মো. গোলাম হাফিজ ও সম্রাট আহমেদ। স্বাধীনতার গান নিয়েও ছিল মজার মজার সব কুইজ। একাধিক সঠিক উত্তর দিয়ে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন নাসিম রেজা।

বিজয়ের এই ৪৮ বছর পূর্তিতে প্রবাসে থেকে বিজয় দিবস উদযাপন করাটা ছিল ভীষণ উপভোগ্য। যদিও এত বছর পরে নিষ্পেষিত অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধা ও কালের বিবর্তনে রাজাকারের মুক্তিযোদ্ধায় রূপান্তরিত হওয়ার কারণে আমাদের স্বাধীনতা আজ হুমকির সম্মুখীন। এই সব আগাছা সমূলে নির্মূল করে দেশকে আরও সামনের দিকে অগ্রসর করতে সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় নিয়েই শেষ হয় এবারের বিজয় দিবসের দিনভর অনুষ্ঠানের।

অনুষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন মো. গোলাম হাফিজ, শামসুদ্দিন আহমেদ, সম্রাট আহমেদসহ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। মঞ্চসজ্জায় ছিলেন আসিয়া আহমেদ।
---

মো. হাসানুল বান্না: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ফটোনিক ন্যানো ম্যাটেরিয়ালস ল্যাবরেটরি, দক্ষিণ কোরিয়া।