হারিয়ে যাচ্ছে কঙ্গোলিস

হারিয়ে যাচ্ছে কঙ্গোলিস। ছবি: সংগৃহীত
হারিয়ে যাচ্ছে কঙ্গোলিস। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতিকন্যা কঙ্গো অরণ্য বা কঙ্গোলিস মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো নদীর বেসিনের নিম্নভূমি রেইন ফরেস্ট। আদিম মানুষের পূর্বপুরুষ হিসেবে যে বাঁদরগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা হয়, একুশ শতকে তাদের অস্তিত্ব কেবল এই অরণ্যেই টিকে আছে।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী কঙ্গো ও আরও অনেকগুলো উপনদী ছুঁয়ে কঙ্গোলিস বিস্তৃত হয়েছে মধ্য আফ্রিকার ছয়টি রাজ্য সীমানায়। এগুলো হলো ক্যামেরুন, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গো, ইকুয়াটোরিয়াল গিনিয়া ও গ্যাবন।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অরণ্যের সিংহভাগ অঞ্চল রয়েছে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে। শুরুতে রেইন ফরেস্টের আয়তন ছিল ১ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার স্কয়ার কিলোমিটার (যখন থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মেজরমেন্টের কাজ শুরু হয়)। বর্তমানে বনভূমির ৮০ ভাগ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন।

জাম্বিয়ার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মাইক মুয়েণ্ডা ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি একটি নিবন্ধে কঙ্গোলিস সম্পর্কে লিখেছিলেন—‘The World's second largest rainforest, in Central Africa's Congo Basin, is disappearing at alarming rates due to severe deforestation. The underlying reasons are to be found in widespread poverty in the region', (14 Jan, 2019 <lifegate.com>) .

কঙ্গো বেসিন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। বিভিন্ন খনিজসম্পদের (ইউরেনিয়াম, কোবাল্ট, সোনা, ডায়মন্ড, তেল) পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে রয়েছে বৃক্ষরাজি, জলবিদ্যুৎ আর উর্বর ভূমি। কিন্তু তা সত্ত্বেও দরিদ্রতম দেশের তালিকা থেকে এখানকার দেশগুলো মুক্ত হতে পারেনি।

প্রথমেই আলোচনা করা যাক, ক্ষুদ্র জনসংখ্যার দেশ গ্যাবনকে নিয়ে। গ্যাবন কেবল মধ্য আফ্রিকায় নয়, আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে ধনী দেশ। তেলসম্পদে ধনী। জনসংখ্যা ২০ লাখ ১৭ হাজার (২০১৯-এর গণনা অনুসারে)। তারপরও দেশটির ৩৩ শতাংশের বেশি মানুষের বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দলীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত বিচারব্যবস্থা, ব্যাপক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং আমলাতন্ত্রের ভয়ংকর প্রভাবে দেশের সম্পদ মাত্রই গুটি কয়েক মানুষের হাতে বন্দী।

জীবন–জীবিকার জন্য দরিদ্র মানুষগুলোর অধিকাংশই নির্ভরশীল অরণ্য থেকে খাদ্য (বন্য প্রাণীর মাংস) ও জ্বালানি সংগ্রহের ওপর। গ্যাবনের ২২ মিলিয়ন হেক্টর রেইন ফরেস্ট সে কারণেই হুমকির সম্মুখীন। পরিবর্তিত জলবায়ুর ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর উদ্বিগ্নতা তাই চরমে। গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে আনতে এবং জীববৈচিত্র্য ও বনাঞ্চল সংরক্ষণের জন্য নরওয়ে সরকার গ্যাবনকে এ বছর ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে। অরণ্য রক্ষায় এবারই প্রথম আফ্রিকার কোনো দেশকে অর্থ সাহায্য দেওয়া হলো।

বিশ্বের দশটি দরিদ্রতম দেশের তালিকায় সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের অবস্থান সবার নিচে। জিডিপির হার সর্বনিম্ন। বছরে মাথাপিছু আয় ৭৫০ ইউএস ডলার। ৯০ শতাংশ মানুষেরই খাদ্য, উপযুক্ত বাসস্থান ও স্যানিটেশন নেই।

এদিকে বিশ্বব্যাপী অতি দ্রুত তেল, গ্যাস, কাঠ, বন্য প্রাণীসহ বিভিন্ন খনিজসম্পদের চাহিদা বাড়তে থাকায় কঙ্গো বেসিন অঞ্চলে গত দুই যুগ ধরে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কাঠ ও খনিজসম্পদ ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য। জীবিকার জন্য দরিদ্র মানুষগুলোকে এই ধরনের শিল্পগুলোই গাছ কেটে অরণ্য ধ্বংসের কাজে অতিমাত্রায় উৎসাহী করে তুলছে।

দরিদ্র কৃষক কিংবা গ্রামবাসীরা আগুন লাগিয়ে অথবা গাছ কেটে জঙ্গল সাফ করছে, এমন দৃশ্য এখানকার নিয়মিত স্বাভাবিক ঘটনা। ‘The biggest drivers of deforestation in the Congo Rainforest over the past 20 years have been small scale subsistence agriculture, clearing for charcoal and fuelwood, urban expansion and mining. Industrial logging has been the biggest driver of forest degradation, '(April 1, 2019 by Rhett A. Butler, Rainforests. mongabay.com)’.

কঙ্গো বেসিনের অরণ্য নিঃশেষের পরিণতি কেবল আফ্রিকা মহাদেশের জন্য নয়, পুরো পৃথিবীর আবহাওয়া পরিমণ্ডলকে প্রভাবিত করবে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। ‘At current rates of deforestation, rainforests will vanish altogether in a century. Stopping climate change will remain an elusive goal unless poor nations are helped to preserve them,' (23 rd January 2017, The Guardian)

কঙ্গো বেসিন ও আফ্রিকার অন্য দেশগুলোয় যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, সুস্বাস্থ্য আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই লক্ষ্যে ২০০৩ থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা সাহায্য–সহযোগিতা নানাভাবে বাড়িয়েছে। কিন্তু সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, অসহিষ্ণুতা, বিদ্রোহ ও স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে সংঘাত–সংঘর্ষের কারণে এখানকার রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কোনো স্থায়ী উন্নয়নই হয়নি। তাই দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোর মুক্তিলাভ সম্ভব হয়নি আজও। সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ও অবৈধ কারবারিরা এই পরিস্থিতিকেই ব্যবহার করছে শতভাগ।

তাই আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজসম্পদ, কাঠ, পশুর চামড়া, হাড়, লিভার, মাংস কিংবা আইভরির চাহিদা বাড়ায় গাছ ও বন্য প্রাণীর অবৈধ ব্যবসাও এখানে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বন্য প্রাণী হত্যা করে স্থানীয় বাজারে মাংস বেচে রোজগার করা বহু পরিবারেরই সংসার নির্বাহের একমাত্র পথ।

শুধু ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতেই প্রতিবছর খাওয়া হয় মিলিয়ন টন বন্য পশুর মাংস। পরিণতিতে যত বেশি পরিমাণে অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে, রেইনফরেস্টের প্রাণী প্রজাতিরাও ততই বিলুপ্ত হচ্ছে দ্রুত। ‘Logging roads are expanding dramatically in the Congo Basin, leading to catastrophic collapses in animal populations living in the World's second largest Rainforest,' (24 June, 2016, by James Cook University in Australia)

তবে সেন্ট্রাল আফ্রিকার ছয় রাজ্যের মধ্যে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক কঙ্গোর অবস্থা সবচেয়ে জটিল আর চ্যালেঞ্জপূর্ণ। সাব-সাহারান অঞ্চলে এই দেশটি আয়তনে সবার বড়। পৃথিবীর মোট রেইন ফরেস্টের ১২ দশমিক ৫ শতাংশই রয়েছে এই দেশে। দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদেও ঐশ্বর্যময়। টিন, সোনা, হিরা, কপার, কোবাল্ট, কোল্টন ও তেলসহ প্রচুর প্রাণিসম্পদ রয়েছে ডেমোক্রেটিক কঙ্গোয়।

কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা (রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার উদ্দেশ্যে বারবার মিলিটারি ক্যুর কারণে), দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, স্থানীয় কমিউনিটির বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সংঘর্ষ, দারিদ্র্য, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের (আফ্রিকান রিপাবলিক, অ্যাঙ্গোলা, জাম্বিয়া, দক্ষিণ সুদান ও বুরন্ডি) লাখ লাখ শরণার্থীর আগমনে এখানে চরম সংকট বিরাজিত।

এখানকার মানবাধিকারের অবস্থা নব্বইয়ের দশক থেকেই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এরপর মোট জনসংখ্যার সঙ্গে প্রতিবছর নতুন করে যোগ হচ্ছে ২০ লাখ মানুষের খাদ্য, বাসস্থান ও জ্বালানির চাহিদা। প্রতিবছর ১০ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর বন পরিষ্কার করে তৈরি হচ্ছে কৃষিজমি, বাসস্থান আর জ্বালানির সংস্থান। রেইন ফরেস্ট উজাড় হওয়ার পেছনে তাই ৮৪ ভাগ দায়ী এখানকার দীর্ঘকালীন দারিদ্র্য।

দুঃখের বিষয়, এ দেশে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ স্বস্তি নয়, বয়ে এনেছে অভিশাপ। হত্যাকাণ্ড, সংঘাত, সংঘর্ষ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্পদের ভাগ-বাঁটোয়ারার সুব্যবস্থাপনা না থাকার কারণেই।

ক্যামেরুনের ৪৬ ভাগ জায়গাই অরণ্যে আবৃত। শিম্পাঞ্জি, হাতি, জেব্রা, গরিলা, নেকড়ে, গাধা, জাঙ্কি, চিতা, মংগ্রেলসহ ৫৫০ রকমের বন্য প্রাণীর বসবাস রয়েছে এই জঙ্গলে। অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক দিয়ে বিশ্বের ২১৬টি রাষ্ট্রের মধ্যে ক্যামেরুন ৯৮তম। ৫৫ ভাগ অঞ্চল অনুন্নত। মানব উন্নয়নের সূচকে দেশটি ১৫০ নম্বর অবস্থানে দাঁড়িয়ে। ৪৮ শতাংশ মানুষের বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে।

১৯৯০ থেকে দেশটিতে অরণ্য উচ্ছেদের কর্মকাণ্ড শুরু হলেও এর অনুপাত ব্যাপক হারে বেড়েছে বিগত কয়েক বছর ধরে। কুড়ি বছর ধরে স্থানীয় কমিউনিটির চেষ্টায় অরণ্য রক্ষার চেষ্টা চললেও উচ্ছেদের তুলনায় সুরক্ষার প্রচেষ্টা নিতান্তই নগণ্য। তবে ডেমোক্র্যাট কঙ্গোর মতো এখানে ছোট ছোট আকারে নয়, রাবার ও পামওয়েল চাষের জন্য বিশাল বিশাল কৃষিজমি তৈরি করা হচ্ছে রেইন ফরেস্ট পরিচ্ছন্ন করে। পাশাপাশি চলছে খনিজসম্পদ সংগ্রহের কাজও।

সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের, Department of Geographical Science থেকে প্রকাশিত জার্নালের এক তথ্য রেইন ফরেস্টের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জন্ম দিয়েছে আরও বড় উদ্বেগের। কঙ্গোলিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে গিয়ে বক্তব্যের শিরোনামে এতে বলা হয়েছে-‘The Congo Basin forest is Vanishing by 2100,’ (Nov 9,2018 <umdrightnow.umd.edu>).

অরণ্য নিশ্চিহ্নকরণে কেবল যে গ্লোবাল কার্বন সাইকেল পরিবর্তিত হয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা নয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে জলাধারগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। সবুজ অরণ্য শেষ হওয়ায় মরু হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। চিরদিনের মতো হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বন ধ্বংসের ফলে, ড্রিল করে অতিরিক্ত খনিজসম্পদ সংগ্রহের কারণে (ক্রুড ওয়েলের লিকেজ থেকে, প্রোডাকশন প্রসেসের সময় গ্যাস ও অন্য কেমিক্যাল ছড়িয়ে পড়ায়) এখানকার ইকোসিস্টেম ভয়ংকর হুমকির মুখোমুখি আজ। দূষিত হচ্ছে সাগর-মহাসাগর, লেক ও নদী।

পরিবর্তিত জলবায়ুতে অনাবৃষ্টি বাড়ছে। বাড়ছে বজ্রপাতের সংখ্যা। অবৈধ ব্যবসার কারণে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দুই ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কঙ্গো বেসিনের রাষ্ট্রগুলোয়, বিশেষত ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর মুদ্রাস্ফীতি গত চার বছর ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দারিদ্র্য আরও বেড়েছে। বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ। অন্যদিকে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার কারণে সরকারের রাজস্ব আয়ও ব্যাহত হচ্ছে।

একুশ শতকের পরিবর্তিত জলবায়ুর ভয়াবহ পরিণতি রুখতে, সাগর, নদী, অরণ্যের জীববৈচিত্র্য রক্ষায়, ভবিষ্যৎ মানুষের সবুজ পৃথিবীর জন্য রেইন ফরেস্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক, ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি, রেইন ফরেস্ট অ্যালায়েন্স, কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ডের মতো আরও কিছু সংস্থা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরা একদিকে স্থানীয় কমিউনিটি ও দেশীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সহযোগিতা চালাচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে যাতে অরণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা যায়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, হাজারো পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও একুশ শতকে কঙ্গো বেসিনে অরণ্য নিশ্চিহ্নকরণের বাস্তবচিত্র এখনো থেমে নেই।