বেড়ানো: শেনানডোয়া ন্যাশনাল পার্ক

মেরিস রক টানেল স্কাইলাইন ড্রাইভ। ছবি: লেখিকা
মেরিস রক টানেল স্কাইলাইন ড্রাইভ। ছবি: লেখিকা

প্রথম এক ওভার লুকে নেমেই প্রেমে পড়া শেনানডোয়ার। নিচে ঝরনার হাসি রংধনু বনের ফাঁকে। ওপরে পর্বতের ঢেউরাশি গোধূলির বাঁকে।

প্রেমের যেখানে গীতি। ভাষার সেখানে ইতি।

তারপর, স্কাইলাইন ড্রাইভে তুচ্ছ জিনিসও ভালো লাগা। নানান উচ্চতা থেকে নানাভাবে দুনিয়া দেখা। কখনো পূর্ব থেকে, কখনোবা পশ্চিম। পুবে সন্ধ্যার গাম্ভীর্যে ফ্রোজেন প্রকৃতি। আর পশ্চিমে সন্ধ্যার শ্বাসরুদ্ধ সন্তরণ গোধূলির গাঙে।

ঠিক সূর্যাস্তের সময় ভাগ্যক্রমে পশ্চিমের এক ওভার লুকে নামা। একদল উৎসাহী মানুষের সঙ্গে তিন হাজার ফুট উচ্চতা থেকে সূর্যাস্ত দেখা।

নয়া যুগলের কথা বাদ! প্রৌঢ় ও গুঁড়োদের উচ্ছ্বাস স্বর্গীয়। ‘ইয়া! আম ট্রাইন্না ক্যাচ দ্য সান সেট হিয়ার’—এই বলে এক মুরব্বি শিশুর মতো দৌড়ান কিনারের দিকে। ফালুদা বনানী, গদগদে গোধূলি, আবালবৃদ্ধবনিতার বিস্ময় উদ্ভাস। এ অপার্থিব সৌন্দর্য কোনো ক্যামেরায় ওঠে না। আর ভাষাতেও ফোটে না।

হ্যাযেল মাউন্টেন ওভারলুক। ছবি: লেখিকা
হ্যাযেল মাউন্টেন ওভারলুক। ছবি: লেখিকা

আমাদের বাসা (মেরিল্যান্ড) থেকে তিন ঘণ্টার ড্রাইভ ভার্জিনিয়ার শেনানডোয়া ন্যাশনাল পার্ক। দুই লাখ একর বিস্তৃত শেনানডোয়ার অবস্থান ব্লু রিজ পর্বতের বুকে। ব্লু রিজ পর্বত এপেলেশিয়ান পর্বতমালার এক লকেট। আর শেনানডোয়া উপত্যকা সেই লকেটের মণিমুক্তা।

শেনানডোয়া ন্যাশনাল পার্কের অন্যতম আকর্ষণ স্কাইলাইন ড্রাইভ। ১০৫ মাইল এই পথ ব্লু রিজ পর্বতের গা বেয়ে উত্তর–দক্ষিণে লতিয়ে তিন হাজার ফুট ওপরে উঠে গেছে। যে পথের সঙ্গে এক্সেস আছে অনেক হাইকিং ট্রেইলস, ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড, লজিং হাউস ও শপিং মলের।

স্কাইলাইন ড্রাইভে আছে পূর্ব ও পশ্চিমমুখী ৭৫টা ওভার লুক। যেখান থেকে শেনানডোয়ার প্যানারোমিক দৃশ্য দেখে মানুষ। স্কাইলাইন ড্রাইভ বানানো শুরু হয় ১৯৩১ সালে। যখন অটোমোবাইল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

‘আম্মু, আমরা খেয়ে, নামাজ পড়ে মাঝরাতে আবার ওপরে উঠব তারা দেখতে, ঠিক আছে?’

নিচের দিকে ড্রাইভ করতে করতে প্রস্তাব রাখে নাসিফ।

‘সারা আকাশ সাদা হয়ে থাকে তারায়, মিল্কি ওয়ে দেখা যায়।’ আরও যোগ করে সে।

সূর্যাস্ত। ছবি: লেখিকা
সূর্যাস্ত। ছবি: লেখিকা

পথিমধ্যে লুরে কেভার্নস নামে এক মোটেল দেখি। এর ঠিক বিপরীতে লুরে কেভার্ন পর্বত গুহা। যেহেতু পরদিন লুরে গুহায় যাব, তাই এই মোটেলেই ঠিকানা গাড়লাম। বন–পাহাড়ে ঘেরা এই মোটেলে সাঁঝরাতেই মাঝরাতের নীরবতা। উঠানে হরিণের পদচারণ। অদূরে জঙ্গল ঘেঁষে কালো ভালুক নাকি ওটা?

লেপের তলায় ঢুকে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। নাসিফের আব্বুর শরীর খারাপ লাগে। তিনি ভাত খেতে চান। এই অজপাহাড়ে এত রাতে কোথায় সাদা ভাত পাওয়া যাবে?

আমি আর নাসিফ ওয়াল মার্টের উদ্দেশে রওনা হই সুশি কিনতে। বাইরে বেরিয়ে দেখি এক জমকালো কালো আকাশ তারায় খোদিত। আঁধারের এত রূপ! মনে পড়ে যায় দাদির বাড়ির উঠানের কথা, খেজুরের পাটি আবৃত, গল্প গীতে প্রীত। উঠানে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে, তারা গুনতে গুনতে ঘুমাতাম শিশুকালে।

লুরে কেভার্ন
৭০ সিঁড়ি গভীর ভূগর্ভে হালকা বিদ্যুৎ বাতির আবছায়ায় এক ছোট মেয়ে তার মালা চোষা থামিয়ে বলে, ‘আ হোপ দেয়ারস নো গ্রেমলিনস।’

গুহার এক সুড়ঙ্গপথে। ছবি: লেখিকা
গুহার এক সুড়ঙ্গপথে। ছবি: লেখিকা

পানির ফোঁটা পড়ার হালকা শব্দ সামনের আঁধারে। গায়েও এসে পড়ছে কিছু ফোঁটা। কংক্রিটের স্যাঁতসেঁতে পথে সাবধানে পা টিপে হাঁটছি। পাথরের কলামগুলো পার হতে হতে ভাবছি, কেন এসেছি এখানে? পানির ফোঁটার গুঁতা খেতে, এই পাথর-টাথর দেখতে? কেনইবা বছরে মিলিয়ন মানুষ আসে এখানে?

লুরে কেভার্ন শুয়ে আছে ব্লু রিজ পর্বতের গোড়ালি ঘেঁষে। ১৮৭৮ সালে আবিষ্কৃত এই গুহা পূর্ব আমেরিকার সর্ব বৃহৎ পর্বত গুহা। পাহাড়ের শিকড়বাকড় (stalactites and stalagmites) ঝুলে আছে গুহার ছাদে। দেয়ালে, চার পাশে। এই ফরমেশনগুলো এক ইঞ্চি বাড়তে ১২০ বছর লাগে। সবচেয়ে লম্বাটা ৪৭ ফুট। দেখতে icicle-এর মতো। কমলা, লাল, সাদা ও সবুজ নানান রঙের। লোহার কারণে লাল। ক্যালসিয়ামের কারণে সাদা। আর সবুজ হয়েছে কী কারণে? একটা পাথরের ওপর যেন ডিম পোচ করা।

‘লুক। আ ফ্রাইড এগ!’ এক পিচ্চি বলে। সে আরও বলে ‘প্লিস, ডু নট টাচ অর হ্যান্ডেল অ্যানি অব দ্য ফরমেশন।’

ড্রিম লেক, লুরে গুহা। ছবি: লেখিকা
ড্রিম লেক, লুরে গুহা। ছবি: লেখিকা

ট্যুর গাইড বলেন, ‘উই হ্যাভ অয়েলস অন আওয়ার হ্যান্ডস দ্যাট স্টান্ট দিয়ার গ্রোথ।’

আমরা হাঁটছি পালাক্রমে আপহিল থেকে ডাউন। কখনো সুড়ঙ্গ পেরিয়ে, কখনোবা ছোটব–ড় হলরুম মাড়িয়ে। কিছু পথ রেলিংঘেরা। রেলিং গলিয়ে নিচে তাকালে অন্য ট্যুর গ্রুপের চলাচল দেখা যায়।

‘ওহ, কুল। ইজ দিস গ্লাস?’ এক কিশোরী তার মাকে জিজ্ঞেস করে নিস্তরঙ্গ লেকের দিকে তাকিয়ে। লেকটি এত নিথর যে ছাদের ছায়া নিখুঁতভাবে পড়েছে এতে। সারি সারি তাজমহলের ছায়া যেন পড়েছে যমুনা নদীতে। রিফ্লেকশনের কারণে লম্বা, সরু লেকটাকে অনেক গভীর দেখাচ্ছে, যা বাস্তবে দুই ফুটের বেশি গভীর নয়।

ক্রিসমাস ট্রির সমান এক ফ্রোজেন ঝরনা, যা নাকি তিন কোটি বছরের পুরান। হাঁটতে হাঁটতে ১০তলা বিল্ডিঙের সমান উঁচু জায়ান্ট হলে এলাম। এখানে বিরাট এক বাদ্যযন্ত্র ‘The Great Stalacpipe Organ’ রাখা, যা থেকে হাম ভেসে বেড়ায় সারা গুহাময়।

ডিম পোচ। ছবি: লেখিকা
ডিম পোচ। ছবি: লেখিকা

প্রস্থান পথের মুখে এসে এক টিনএজার তার সহচরীকে বলে, ‘বেস্ট পার্ট ওয়াজ দ্য রিফলেকশন!’

সেই ছোট মেয়েটির দিকে ঝুঁকে তার বাবা জিজ্ঞেস করে, ‘ডিড ইউ হ্যাভ ফান?’

মেয়েটি গ্রেমলিনের কথা ভুলে, মুচকি হেসে ‘হ্যাঁ’সূচক মাথা দোলায়।