শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা

পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা
পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তার মধ্যে শীতকাল আর মেলা তো প্রায় একে অপরের পরিপূরক। এই শীতে আমরা চলে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলা দেখতে।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে প্রথম পৌষ মেলার আয়োজন করেছিলেন ১২৯২ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ। গ্রেগরিয়ান ১৮৯১ সাল সেটা। সেই থেকে এ মেলা প্রতিবছর হয়ে আসছে।

পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা
পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা

সাম্প্রতিক সময়ে পৌষ মেলা হয়ে থাকে চার থেকে পাঁচ দিন ধরে। এ বছর ৭ পৌষ (২৩ ডিসেম্বর) ভোরের বৈতালিক ‘আগুনের পরশমণি’ গাইতে গাইতে উদয়নবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে পৌষ উৎসব আরম্ভ হয়। বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বিনোদন মঞ্চ শুভারম্ভ করেন। শুরু হয় বাউলগান। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এই বাউলদের গান চলে সারা রাত।

পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা
পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা

কলকাতা থেকে ট্রেনেই রওনা দিলাম বোলপুরের উদ্দেশে। ট্রেনের টিকিট আগে থেকেই কাটা ছিল। কবিগুরু এক্সপ্রেস। কলকাতা থেকে ট্রেনে বোলপুর পৌঁছতে সময় লাগল সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা। স্টেশন থেকে টোটোতে চড়ে হোটেলে যেতে লাগবে আরও আধা ঘণ্টার মতো। এখানে যাতায়াতের প্রধান ভরসা কিন্তু এই টোটো নামক যানটি।

মেলায় দোকানপাট বসতে শুরু করেছে। কী নেই মেলায়। শান্তিনিকেতনি ব্যাগ, কাঠের তৈরি বিভিন্ন জিনিস, পোড়া মাটির তৈরি ঘর সাজানোর জিনিস, পাটের ব্যাগ-জুতো, ডোকরার অলংকার, ঘর সাজানোর জিনিস, সুতির পাঞ্জাবি, শাড়ি ইত্যাদি।

পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা
পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা

দামও এমন কিছু বেশি না। পটচিত্রের কাজ করা বিভিন্ন জিনিস যে আসলে এত কম দামেও পাওয়া যায়, ভাবলেও অবাক লাগে। মেলার মধ্যে গ্রামীণ আর শহুরে জিনিসের মিশ্রণ সর্বত্রই চোখে পড়ে।

এখানে রয়েছে কংকালি মন্দির। এই মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা দেখে তো চোখ জুড়িয়ে যায়। দুদিকে যত দূর চোখ যায় শুধু খালি মাঠ। মাঝেমধ্যে সরষেখেত। আর গ্রামের মধ্যে ঢুকলে মাটির বাড়ি, খড়ের গাদা। একটা পুকুরে তো দেখলাম লাল শালুক ফুটে আছে।

পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা
পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা

মন্দির থেকে ফেরার পথে গেলাম খোয়াইয়ের সোনা ঝুড়ি হাট দেখতে। সাধারণত প্রতি শনিবার এখানে হাট বসে। কিন্তু মেলার কদিন প্রতিদিনই বসে। হাট ঘুরে জিনিসপত্র কিনে আবার গেলাম মেলায়। রণপা নৃত্য, লাঠিখেলা, রায়বেসে, ছৌনাচ দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ছিল বর্ধমানের লোকনৃত্য পরিবেশন। এরপর ছিল যাত্রা। সেটা না দেখে ওখানেই রণেভঙ্গ দিয়ে ফিরে এলাম।

পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা
পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা

পরদিন দেরি করে উঠে হোটেলেই খাবার খেয়ে আবার গেলাম হাটে। কারণ এত কম দামে সুতির পাঞ্জাবি, কথাস্টিচের কাজ করা শাড়ি-চাদর, এমনকি গামছা আর কোথাও নেই। দরদাম করার দক্ষতা থাকলে আপনার তো পোয়াবারো। হাটটা থাকে ঠিক বিকেল অবধি। কারণ, এখানে আলোর কোনো ব্যবস্থা নেই।

পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা
পৌষ মেলায় নানা পসরা। ছবি: লেখিকা

বিকেলে আবার মেলায় ফিরলাম। এক বন্ধু আগের দিনই খেয়াল করেছিলেন মেলায় কিছু জায়গায় নিজের পোর্ট্রেট আঁকানো যায়। তিনি সোজা গিয়ে বসে পড়লেন তাদের একজনের চেয়ারে। মাত্র কুড়ি মিনিটের মধ্যে আর্টিস্ট ছেলেটা যা সুন্দর একটা ছবি আঁকল, আমরা তো অবাক হয়ে গেলাম। পরে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে জানলাম সে বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থী। আর্ট নিয়ে পড়ছে এখানে। প্রায় প্রতিবছরই ওদের বন্ধুরা এটা করে। কেউবা নিজের আঁকা ছবি নিয়ে বসে। কেউ মাটির জিনিস বানিয়ে। এরপর আমরা দেখলাম লোকনৃত্য পরিবেশন।

২৫ ডিসেম্বর মোমবাতি দিয়ে সাজানো হয়েছিল পুরো জায়গাটা। আর ছিল বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠান। কিছুক্ষণ ওখানে বসে মন জুড়িয়ে গেল। কিন্তু আবার দুঃখ লাগল এটা ভেবে যে আর এক দিন পরই মেলা শেষ হয়ে যাবে। কাল আবার ফেরার ট্রেন। বোলপুরের মধ্যে একটা গ্রামীণ শান্তি আছে। সঙ্গে আছে শহুরে সুবিধাও। তাই কাজের চাপের মাঝে কদিন চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন।

পূর্ণিমা রাতে অজয় নদের জলে পা ডুবিয়ে বসতে চাইলে কাজের চাপের মাঝেও কদিন ঘুরে আসতে পারেন। কিন্তু পৌষ মেলায় আসতে গেলে আপনাকে প্ল্যান করতে হবে একটু আগে থেকেই। বিশেষ করে হোটেল বুকিং একটু আগেভাগেই করে রাখা ভালো।