জাপানে নতুন বছরের আগমনে উৎসব ও রীতি

হাতে বানানো মঙ্গলের বার্তাবাহক শিমেনাওয়া। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
হাতে বানানো মঙ্গলের বার্তাবাহক শিমেনাওয়া। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

জাপানে অবস্থানের সুবাদে নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে দেশটির একটি উৎসব ও একটি রীতি সম্পর্কে আমার বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়েছে। উৎসবের নাম হলো মেচিসুকি। আর রীতির নাম শিমেনাওয়া। এই উৎসব ও রীতি নিয়েই আমার আজকের লেখা।

মোচিসুকি

দেশটিতে নতুন বছর আগমন উপলক্ষে ভাত দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি এক ধরনের আঠালো ধাঁচের পিঠাকে জাপানি ভাষায় মোচি বলে। বেশ পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু পিঠা এটি। রীতিমতো উৎসব করে বানানো ও খাওয়ানো হয় এই পিঠা। সাধারণত নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে ভাতের তৈরি পিঠা বা কেকের উৎসবকে এখানে মোচিসুকি বলে।

সাধারণত বছরের শেষ সপ্তাহে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়।

শিমেনাওয়া হাতে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
শিমেনাওয়া হাতে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

মোচি তৈরির পদ্ধতি

ছোট আকারের মিষ্টি জাতীয় মোচিগোম নামের একজাতীয় আঠালো চাল দিয়ে মোচি পিঠা–রাইস কেক–ভাতের পিঠা তৈরি করা হয়। এই চাল সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। সকালে পুরো পানি ভালোমতো ছেঁকে নিয়ে সেটা গরম পানির ভাপ দিয়ে সেদ্ধ করতে হয়। সেদ্ধ করা গরম গরম চাল প্রয়োজনমতো পানি দিয়ে আঠালোভাবে খামি তৈরি করতে হয়।

মজবুত কাঠ বা পাথরের সাম গাহিন (বাংলাদেশে চালের গুঁড়ি করা হতো কাঠের যে পাত্রে, অনেকটা দেখতে সে জাতীয় পাত্র এটা। এখন অবশ্য অনেক জায়গায় এই বস্তুটি নেই বললেই চলে) অথবা বড় আকারের হামানদিস্তাতে কাঠের ডান্ডা বা বড় আকারের হাতুড়ি দিয়ে এই গরম পেস্ট বা খামিটি কয়েক দফা পেটানো হয়।

মোচি বানানোর আগে হামানদিস্তাতে কাঠের ডান্ডা বা বড় আকারের হাতুড়ি দিয়ে গরম পেস্ট বা খামিটি কয়েক দফা পেটানো হয়। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
মোচি বানানোর আগে হামানদিস্তাতে কাঠের ডান্ডা বা বড় আকারের হাতুড়ি দিয়ে গরম পেস্ট বা খামিটি কয়েক দফা পেটানো হয়। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

খামিটি যথার্থভাবে পেটানো হয়ে গেলে রুটি বেলা পিঁড়ির মতো বড় আকারের সমান জায়গায় এই খামিটি গরম থাকতেই ভুট্টার তৈরি ময়দা ছিটিয়ে হাত দিয়ে ডলে ছোট বিভিন্ন আকারের খামি বানাতে হয়। এভাবে তৈরি হয়ে যায় জাপানের বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী মজাদার খাবার মোচি।

প্রধানত তিন রকমভাবে মোচি বানিয়ে খায় জাপানিরা।

প্রথমত আঠালো মোচির খামি ছোট আকারে বানিয়ে কিনাকোতে গড়িয়ে নিয়ে তারপর খেতে হয়। কিনাকো হলো সয়াবিন ফলের তৈরি গুঁড়ো। অনেকটা হলুদ রঙের। এটার স্বাদ সামান্য মিষ্টি টাইপ। এটার নাম কিনাকো মোচি।

মোচি বানানোর আগে হামানদিস্তাতে কাঠের ডান্ডা বা বড় আকারের হাতুড়ি দিয়ে গরম পেস্ট বা খামিটি কয়েক দফা পেটানো হয়। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
মোচি বানানোর আগে হামানদিস্তাতে কাঠের ডান্ডা বা বড় আকারের হাতুড়ি দিয়ে গরম পেস্ট বা খামিটি কয়েক দফা পেটানো হয়। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

দ্বিতীয়ত রেডিস সস মোচি। একই উপায়ে শিম জাতীয় সবজির মিষ্টি স্বাদের লাল রঙের বিচির তৈরি পাতলা সস দিয়ে মোচি খাওয়া হয়। এটাকে জানাপিজ ভাষায় শুরাতাম যেনযাই মোচিও বলা হয়।

তৃতীয়ত রেড বিন পেস্ট আংকো মোচি। লাল রঙের আযুকি নামের মিষ্টি স্বাদের বিচির পেস্ট বানিয়ে অল্প পরিমাণে নিয়ে সেটা আঠালো ছোট আকারের মোচির ভেতরে পুরের মতো দিয়ে পুরো পেস্টটা ঢেকে দিতে হয়। তারপর খেতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় যেন পেস্টটা খুব শক্ত বা নরম হয়ে না যায়। তাহলে পুর হিসেবে মোচির ভেতরে আটকানো যাবে না। এটা জাপানে আংকো মোচি নামে পরিচিত।

পুরোনো ঐতিহ্য আর নিয়ন রীতিতেসমৃদ্ধ জাপানে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ভিন্ন রকম আয়োজনের মধ্যে পুরোনো আয়োজন এই ভাতের পিঠা উৎসবটি।

শিমেনাওয়া

জাপানে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বিভিন্ন উৎসব আয়োজনের পাশাপাশি কিছু পুরোনো রীতি পালন করাও হয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শিমেনাওয়া নামক একটি গোলাকার রিং বানানো ও টাঙানো। এই রিংটি তারা বাড়ির সদর দরজার বাইরে ওপরে দরজার ঠিক মাঝখানে টাঙিয়ে রাখে। জাপানিরা বিশ্বাস করে এই রিং বাসায় বাইরে টাঙালে সব অমঙ্গল, মন্দ কিছুই বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। পুরো বছরজুড়ে তাদের সময়গুলো মঙ্গল ও ভালো সংবাদে ভরে থাকবে। পুরো বছরজুড়ে সফলতা বিরাজ করবে।

মোচি। জাপানের বেশ পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু পিঠা এটি। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
মোচি। জাপানের বেশ পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু পিঠা এটি। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

শিমেনাওয়া বানানো হয় সম্পূর্ণ হাতে। ধান মাড়াইয়ের পর ধানের মরা শিষগুলো অর্থাৎ আমরা যেগুলোকে খড় বলি সেটা দিয়ে বানাতে হয়। প্রথমে এক মুঠ খড়ের শিষগুলো গোড়ার দিকে একটা ছোট দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিতে হয়। তারপর বাকি অংশটুকু তিন বা চার ভাগে ভাগ করে নিয়ে প্রতিটি ভাগ আলাদা আলাদাভাবে যত্নসহকারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খড়ের সামনের দিক পর্যন্ত নিতে হয়।

তারপর খড়ের আলাদা আলাদা প্যাঁচানো দড়িগুলো পরস্পরের সঙ্গে পুনরায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে আগার দিকে সামান্য ঝালর রেখে হাত দিয়েই একটা গোলাকার আকার দিয়ে গোড়া ও সামনের অংশ ছোট একটি দড়ি দিয়ে শক্ত করে গিঁট দিতে হয়। যেন খুলে না আসে।

দুই অংশের মাঝখানে গিঁটের জায়গায় শিদা নামক জাপানি পাতা যেটা দেখতে অনেকটা ইংরেজি ভি আকৃতির ও আমাদের কৃষ্ণচূড়া পাতার মতো। তার ওপর আরেকটি ইয়ুজুরিহা নামক জাপানিজ পাতা দিয়ে, মাঝখানে একটি ছোট, মাঝারি বা বড় আকারের কমলা লাগিয়ে দড়ি দিয়ে ভালোভাবে শক্ত করে বেঁধে দিতে হয়।

এভাবে তৈরি হয় জাপানের নতুন বছরের আরেক ঐতিহ্যবাহী হাতে বানানো মঙ্গলের বার্তাবাহক শিমেনাওয়া। নববর্ষের প্রাক্কালে জিনিসটি একে অন্যকে উপহার দেওয়া এখানে একটা সম্মানিত রীতি হিসেবেও জানা হয়।