মোটা মেয়ের প্রেম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শুনেছি আমি জন্মের পর থেকেই মোটা। স্বাভাবিকের কারণে বেশ বড়সড় হওয়ার কারণে আমার জন্মের সময় মা প্রায় মরতে বসেছিলেন। আমার মা–ও খুব মোটা ছিলেন। অনেক চিকিৎসার পর বিয়ের প্রায় ১২ বছর পর আমার জন্ম। এ কারণেই বোধ হয় আমার আদরের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। সারা দিন খাওয়ার ওপরই থাকতাম।

ছোটকালে নাদুসনুদুস ও গোলগাপ্পা হওয়ার কারণে যে কাপড়ই পরানো হতো, আমাকে পুতুলের মতো সুন্দর লাগত। ঈদ বা কোনো উৎসবে বাচ্চাদের কাপড়ের মডেল হওয়ার জন্য মা–বাবার কাছে প্রায়ই অনুরোধ আসত।

আমার মায়ের খুব ইচ্ছে থাকলেও দাদির ঘোর আপত্তি ছিল। তাঁর ধারণা, এতে আমার ওপর মানুষের নজর লেগে যাবে।

তবু চুপিচুপি মা আমাকে একবার জেলা পর্যায়ে সুস্থ-সুন্দর বাচ্চাদের কী যেন এক প্রতিযোগিতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেবার আমি চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম। গোলাপি প্রিন্সেস ফ্রক পরা সেই ছবিটা এখনো খুব যত্ন করে ফ্রেমে বাঁধানো আছে দাদির ঘরে।

এরপর আমি আরেকটু বড় হলাম। সব ধরনের খাবারের ওপর আমার আগ্রহ খুব ছোটকাল থেকেই ছিল। সব থেকে ভালো লাগত ভাত খেতে। আমাদের বাসায় নাশতায় রুটি হতো আর কাজের লোকের জন্য ভাত। ওরা রুটি খেতে চাইত না। আমি নাশতা খেয়ে ওদের সঙ্গে বসে ভাত খেতাম। খাবার প্রতি তীব্র ঝোঁকের কারণেই আমার ওজন বাড়তে লাগল খুব দ্রুতই।

এরপর আমি টিনএজ হলাম। স্কুলে সবাই আমাকে মোটু, মুটকি, মুটকু, ভুটকি, ভেসপা, চালের বস্তা, আটার বস্তা নামে ডাকত। সত্যি বলতে কী, আমার তেমন মন খারাপ হতো না। ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল হওয়ার জন্য টিচাররা অনেক পছন্দ করতেন। বই পড়তে আমার ভালো লাগত। আর ভালো লাগত খেতে। এই ভালো লাগার কারণে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সবকিছুই পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। ভার্সিটিতে যাওয়ার আগেই দৈর্ঘ্য বাড়া বন্ধ হলেও প্রস্থ বাড়ছিল জ্যামিতিক হারে। আমি হলাম লম্বা আর সেই সঙ্গে মারাত্মক চওড়া।

সে সময় আমার স্কুল-কলেজের বান্ধবীরা পটাপট প্রেমে পড়ছিল। আমি ছিলাম সিনেমা-নাটকের পার্শ্বচরিত্রের মতো। নায়িকার মোটা বান্ধবী। নায়িকার অনুরোধে তার ডেটিংয়ে সঙ্গে যেতাম। আমার মতো মোটা বান্ধবী গেলে কেউ নাকি আউল-ফাউল কিছু করার সাহস পাবে না। আর ভদ্র-ভালো মেয়ে হিসেবে যেহেতু আমার একটা সুনাম আছে, কাজেই আমার সঙ্গে কোথাও যাচ্ছে জানলে আংকেল-আন্টিরা কেউ কোনো সন্দেহ করতেন না। বান্ধবীদের ডেটিংয়ে গিয়ে দূরে বসে বই পড়তাম আর স্বপ্ন দেখতাম ইস, আমিও যদি প্রেম করতে পারতাম!

আমারও প্রেম করার সাধ হতো। বয়সটাই এমন ছিল, যারে দেখি লাগে ভালো। কিন্তু আমার ভালো লাগলে তো হবে না, আমাকেও তো ওদের কারও না কারও ভালো লাগতে হবে। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী বান্ধবীরা যে আমাকে ফিটিং দেওয়ার চেষ্টা করেনি, তা বললে ভুল হবে। কিন্তু আমাকে কেউ পছন্দ করেনি। এমনকি অনেক মোটা ছেলেও আমাকে পছন্দ করেনি। তাদেরও পছন্দ স্লিম মেয়ে।

এরপর ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম অন্য দুনিয়া। আমি এত মোটা যে অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে ভার্সিটির প্রায় সবাই চেনে। আমার নামের আগে-পিছে আরও কিছু নাম যোগ হলো। হাতি, হস্তী, এলিফ্যান্ট, জায়ান্ট, জাইগান্টিক আরও কত–কী। আগেও শুনেছি, কিন্তু কেন যেন এগুলো শুনে আমার এখন মন খারাপ লাগে। নিজেকে আরও গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করে।

ফার্স্ট ইয়ারের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্টের পর সবাই আবার আমাকে নতুন করে চিনল। এত বেশি গ্রেড পয়েন্ট নাকি এর আগে কেউ এই ডিপার্টমেন্টে পায়নি। আর এই ভালো রেজাল্টের কারণেই আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেল।

আমার মতো মোটা মেয়ের জীবনেও প্রেম এল!

সেকেন্ড ইয়ারে গিয়ে রিফাতের সঙ্গে আমার পরিচয়। ওই প্রথম আগ বাড়িয়ে আমার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। ও এত হ্যান্ডসাম, স্মার্ট আর এত মেয়ের ক্র্যাশ যে আমার সঙ্গে বসে গ্রুপ ওয়ার্ক করবে শুনে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। দিনে দিনে আমাদের সম্পর্কটা বেশ সহজ হয়ে উঠছিল। হাসি-ঠাট্টা, আড্ডা, সিনেমা দেখা, একসঙ্গে পয়লা বৈশাখ পালন, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, কেমন যেন স্বপ্নের মতো কাটছিল দিনগুলো। এভাবেই একসময় অনার্স ফাইনাল শেষ হলো। বরাবরের মতোই সর্বোচ্চ গ্রেডের রেকর্ড আমার। আর রিফাত আমার পরেই।

মাস্টার্সে ভর্তির কিছুদিন পরেই ডিপার্টমেন্টে লেকচারার পোস্টের সার্কুলার হলো। রিফাতের ইচ্ছে লেকচারার হিসেবে ডিপার্টমেন্টে জয়েন করবে। আমি অ্যাপ্লাই করলে ওর চান্স কম। তাই সে আমাকে রিকোয়েস্ট করল, আমি যেন অ্যাপ্লাই না করি।

আমি অ্যাপ্লাই করিনি। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, রিফাত আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করে না। আমার সঙ্গে ঘোরাফেরা করলে ওর নাকি টিচার হতে প্রবলেম হবে। আমিও ওর চাকরির কথা ভেবে চুপচাপ ছিলাম।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি তো আর শুধু রেজাল্টের জোরেই হয় না। মামা-চাচা লাগে। রিফাতের মামা-চাচা নেই। তাই ও শ্বশুর জোগাড়ে মন দিল। বাতাসে খবর ওড়ে রিফাত আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক পাওয়ারফুল টিচারের ভাগনিকে বিয়ে করে টিচার হবে। আমি বাংলা সিনেমার নায়িকার মতো চুপচাপ আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম রিফাতের মুখোমুখি হব।

একদিন টিএসসিতে ওকে বেশ কিছু সিনিয়র-জুনিয়রের সঙ্গে বসে থাকতে দেখে ডাকলাম। অনেকবার ডাকার পরও সে না শোনার ভান করল। আমি ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। আমাকে এগিয়ে আসতে দেখেই রিফাতের মেজাজ চড়ে গেল। চিৎকার করে সবার সামনে বলল, ‘তুই কি ভেবেছিস, তোর মতো হাতির সঙ্গে আমি প্রেম করছি? নিজের চেহারা কখনো আয়নায় দেখেছিস? আর দেখবি কীভাবে, স্বাভাবিক আয়নায় তো তোর ওই স্ট্রাকচার দেখা যাবে না। কয়েকটা আয়না জোড়া দিতে হবে। তোর সঙ্গে ঘুরতাম কারণ পড়াশোনায় তোর হেল্প আমার লাগত। তুই বড় লোকের মেয়ে ছিলি, তাই তোর টাকায় খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, ঘোরাঘুরি করতাম। এর মানে এই না যে তোর সঙ্গে প্রেম করব। তোর মতো মোটাকে একটা চুমুও খাইনি, হাতও ধরিনি। কেন জানিস? কারণ মোটা মেয়ের জন্য আমার সে রকম কোনো ফিলিংস আসে না। আমি স্লিম ফিগারের মেয়ে পছন্দ করি। আমাকে নিয়ে যদি কোনো স্বপ্ন দেখে থাকিস, সেটা তোর প্রবলেম, আমার না। তোর যদি বিন্দুমাত্র লজ্জা থাকে তাহলে আমার সামনে আর আসবি না। জলহস্তী কোথাকার!’

সেদিনের পর থেকে আমি আর ভার্সিটিতে যাইনি। আমার সারা জীবনের আনন্দ যোগ করেও ওর দেওয়া কষ্ট ভুলতে পারছিলাম না। বিষণ্নতায় ভুগছিলাম। আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলাম। পারিনি। মা–বাবা-চাচা-ফুপি-খালা-মামা আর দাদি সবাই এত আদর করে আমাকে! এই মোটা মেয়েটাকে কতজনই কত কটু কথা বলেছে। কিন্তু আমার পরিবারে আমাকে নিয়ে কত আদিখ্যেতা! আমার শারীরিক গঠন তাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। তারা এই আমাকেই শুধু ভালোবাসে। সব মা–বাবার কাছে তার সন্তান পৃথিবীতে সব থেকে সুন্দর।

ওই ঘটনার আর কিছুদিন পরে বাবার উৎসাহেই অস্ট্রেলিয়াতে এমএস লিডিং পিএইচডি স্কলারশিপের অ্যাপ্লিকেশনটা সাবমিট করেছিলাম। আমার রিসার্চ প্রপোজালের সঙ্গে সুপারভাইজারের ইন্টারেস্ট মিলে গেল। আইইএলটিএস, ভালো রেজাল্ট সবকিছু মিলে মেলবোর্নে আসতে তেমন বেগ পেতে হয়নি।

রিফাতের কাছে ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হওয়ার মতো অবস্থা হলেও, শুকানোর মতো অবস্থা আমার ছিল না। কিন্তু কেন যেন অস্ট্রেলিয়াতে এসে জীবনে প্রথমবারের মতো আমারও ইচ্ছে করল স্লিম হতে। খুব ধীরে হলেও আমি চেষ্টা শুরু করলাম। আপাতদৃষ্টিতে যাকে বলে মিশন ইম্পসিবল।

পিএইচডি শেষ করে, বেশ ভালো একটা জব অফার পেলাম সিডনিতে। পারমানেন্ট রেসিডেন্স পেতে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। মা–বাবা-দাদি কয়েকবার আমার এখানে এসে বেড়িয়ে গেছেন। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই দেশে যাওয়া এড়িয়ে গেছি।

হঠাৎই খবর পেলাম দাদি খুব অসুস্থ। দেশে না গিয়ে উপায় নেই।

চার সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশে গেলাম। দাদি এখন অনেকটাই সুস্থ। বন্ধুরা আমার আসার খবর পেয়ে রিইউনিয়নের আয়োজন করেছে। বন্ধুদের কাছেই কথা প্রসঙ্গে জানলাম, ভার্সিটিতে রিফাতের চাকরিটা হয়নি। পাওয়ারফুল স্যারের ভাগনির থেকেও আরেক পাওয়ারফুল মন্ত্রীর মেয়েকে বিয়ে করে টিচার হয়েছেন আমাদের এক সিনিয়র ভাই। রিফাত এখন একটা ব্যাংকে চাকরি করছে। প্রেম করে বিয়ে করেছে জেরিন নামে আমাদের এক ব্যাচমেটকে। শুনে কেন যেন একটুও অবাক হইনি। সুন্দর ফিগারের জন্য জেরিন ভার্সিটিতে অনেক পপুলার ছিল। আর রিফাতও তো এমন মেয়েই চাইছিল।

আমাদের ছোটখাটো রিইউনিয়ন যখন প্রায় শেষের পথে, হঠাৎই দেখি রিফাত আর তার সঙ্গে জেরিন। আমাদের বন্ধুদের মাঝে কেউ একজন ওদের আমার আসার কথা জানিয়েছিল। রিফাতের বড়সড় ভুঁড়ি আর চকচকে টাক দেখে যতটা না অবাক হয়েছি, তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছি জেরিনকে দেখে।

৫২ কেজি ওজনের হালকা ছিপছিপে আজকের এই আমি দুই চোখে বিস্ময় নিয়ে অবাক হয়ে দেখছি জেরিনকে। এ যেন ১০৫ কেজি ওজনের সেই আগের আমি দাঁড়িয়ে আছি রিফাতের পাশে। হালকা–পাতলা ছোটখাটো গড়নের সেই জেরিন কীভাবে এত মোটা হয়ে গেল!

মনে মনে ভাবলাম, সুন্দর একটা পরিবার পাশে না পেলে তোমার সেদিনের অপমানে হয়তো বোকার মতো আমিও চলে যেতাম না–ফেরার দেশে। শুধু মোটা হওয়ার কারণে চার বছরের সম্পর্ক তুমি চার মিনিটেই শেষ করেছিলে! বিয়ের পর হালকা-পাতলা গড়নের বউ মোটা হয়ে যেতে পারে, তাই বলে কি তুমি তাকে আর ভালোবাসবে না? মোটা মেয়ের সঙ্গে তোমার প্রেম হওয়ার ছিল ও হয়েছেও। টিএসসিতে সবার সামনে তোমার দেওয়া জলহস্তী নামের মোটা মেয়েটির প্রেম যেন জেরিনের মাঝেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে। প্রকৃতিই তার প্রতিশোধ নিয়েছে।