কৃষ্ণকলি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পূর্বকথা: পাঠক বন্ধুদের অনেক ধন্যবাদ আমার সঙ্গে থাকার জন্য। দূর পরবাসে ‘শিরোনামহীন’ প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ কিছু পাঠকের প্রশ্ন ছিল কৃষ্ণাকে ঘিরে। অনেকেই অনুরোধ করেছিলেন, কৃষ্ণা চরিত্রটির জীবন নিয়ে আরও কিছুটা লিখতে। আপনাদের অনুরোধেই আজ কলম তুলে নিলাম। আপনারাই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। কৃষ্ণকলি গল্পে আপনারা কয়েক পর্বে কৃষ্ণার বেড়ে ওঠা দেখতে পাবেন। পরিচিত হবেন আরও কিছু চরিত্রের সঙ্গে। আশা করি ভালো লাগবে।

‘বলি ও কৃষ্ণা, কোথায় গেলিরে মা?’

সারা বাড়ি প্রায় মিনিট দশেক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মেয়ের দেখা না পেয়ে ক্লান্ত লাইলি বেগম। ‘ও কৃষ্ণা-আ-আ!’

তখনই লাইলি বেগমের চোখে পড়ল, বাড়ির আঙিনায় লাগানো পেয়ারাগাছের তলায় খুঁজে খুঁজে পাকা পেয়ারা কুড়িয়ে নিচ্ছে কৃষ্ণা।

মেয়ের দেখা পেয়ে হাঁক দিলেন তিনি।

‘তাবাসসুম জামান, এখনই ঘরে এসো!’

মায়ের হালকা বকুনিতেই কাঁদো কাঁদো কৃষ্ণা।

‘আমি তো দুষ্টুমি করছি না মা, বকো কেন?’

সাদা প্রিন্টের ফ্রক আর কানে ছোট্ট সোনার রিং। এইটুকুতেই পুতুলের মতো লাগছিল কৃষ্ণাকে। হাতের ঝুড়িতে কয়েকটা আধপাকা রসালো পেয়ারা। গাছের ডাল লেগে হালকা একটু ছড়ে গেছে কনুইয়ের কাছে। রক্তও ঝরছে একটু, তবু মেয়ের মুখে হাসি।

কৃষ্ণার হাতে মলম ঘষতে ঘষতে আরেক প্রস্থ বকলেন লাইলি।

‘এই দুপুর রোদে তোর পেয়ারা চাই কেন? বিকেলে বাগানে যেতে কী হয়েছিল?’

কিচ্ছু না বলে মায়ের হাতে একটা পেয়ারা গুঁজে লম্বা লম্বা পা ফেলে কৃষ্ণা দিল ছুট। তাকে ধরে কার সাধ্যি!

লাইলি বেগমের বিধবা বোন শেফালি আগে একা থাকতেন আমেরিকায়। তার ছেলেমেয়েরা যত দিন কাছে ছিল, শেফালি বেগম নিঃসঙ্গ ছিলেন না। তবে ঝোঁকের বশেই বোন-ভগ্নীপতির জন্য আবেদন করেছিলেন। স্থায়ীভাবে বসবাসের সেই আবেদন মঞ্জুর হওয়ায় আপার বাড়িতেই এসে উঠেছেন লাইলি-শামস।

বোন–অন্তঃপ্রাণ শেফালি ছোট বোনের রসিক স্বামীকেও স্নেহ করেন বেশ। আর তার সঙ্গে হাসিখুশি, বুদ্ধিদীপ্ত কৃষ্ণা তো শেফালির সার্বক্ষণিক সঙ্গী। আগে বিশাল বাড়িতে একা হাঁপিয়ে উঠতেন শেফালি। এখন কৃষ্ণার জন্যই সারা বাড়ি প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা। এমনকি বাড়ির পোষা কুকুর টফিও সারাক্ষণ কৃষ্ণার পায়ে-পায়ে ঘোরে।

অন্যদিকে, ডা. সিরাজ এখন বাংলাদেশের বেশ পরিচিত একজন শিশু বিশেষজ্ঞ। তবে হাজার কাজের ভিড়ে সপ্তাহে অন্তত একবার সিরাজ ভাইবারে কৃষ্ণার সঙ্গে আড্ডা জমান। এই দুই বন্ধুর কথা শুরু হলে শেষ হয় না সহজে। শিপ (সিরাজ) আজও কৃষ্ণার বেস্ট ফ্রেন্ড।

শরিফ আর সিরাজ, দুই বন্ধুর দুই পুত্র জন্মেছে একই দিনে। এই দুই দুষ্টুর শিরোমণিকে সামলাতে এদের মায়েরাও পারে না। ওদের একজনই সামলায়। তাও হাজার মাইল দূর থেকে। কৃষ্ণাপু!

শামসুজ্জামান নিজের কর্মদক্ষতার গুণেই চাকরি জুটিয়ে নিয়েছেন আমেরিকার একটা ব্যাংকে। লাইলি আবার অধ্যাপনায় ঝুঁকেছেন। তবে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে। কৃষ্ণাকে আর আপাকে ছেড়ে লাইলি বাইরে কাজে যেতে চাননি।

সেদিনের সেই ছোট্ট কৃষ্ণার বয়স এখন প্রায় বারো। সে বাড়ির কাছেই একটা স্কুলে গ্রেড সেভেনের ছাত্রী। কৃষ্ণার লেখাপড়ার সব ভার এখন আমেরিকান সরকারের; যেহেতু তারা এখন এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। তবে শর্ত একটাই, স্কুল আর বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি হওয়া চলবে না। আর অনুপস্থিতির হার যথাসম্ভব কম রাখতে হবে।

প্রতিদিন মায়ের বানানো টুনা সালাদ অথবা বিস্কুটের প্যাকেট, আর হরেক রকম বাদাম নিয়ে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, নীল টি–শার্ট আর প্যান্ট পরে, সাইকেল টুংটাং করতে করতে নিজেই স্কুলে যায় কৃষ্ণা। শার্টের ওপর পাতলা জ্যাকেট বা রং মেলানো স্কার্ফ পরতেও ভোলে না।

দুই বছর আগে থেকেই কৃষ্ণার বাবা-মা দুজন মিলেই মেয়েকে গল্পের ছলে বুঝিয়েছিলেন ছেলেমেয়ে উভয় ক্ষেত্রের বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক মানসিক পরিবর্তন নিয়ে। শামস-লাইলি কেউই চাননি নিজের আচমকা শারীরিক পরিবর্তন অথবা সহপাঠীর পরিবর্তিত কণ্ঠস্বর শুনে কৃষ্ণা ঘাবড়ে যাক। মা–বাবার বিচক্ষণতায় অল্প কিছুদিন আগে নিজের শরীরে আসা Menarche-কে (ইচ্ছাকৃত ইংরেজি দিলাম, যারা জানেন না, খুঁজে নেবেন) এক ফোঁটা ভয় না পেয়ে সামলে নিয়েছে মেয়ে।

মেয়েকে শামস প্রায়ই বলেন, ‘মা, মানুষের চোখের খাদ্য নয়, মনের খোরাক হও। তুমি বাজারে সাজিয়ে রাখা ভোগ্য পণ্য নও।’

কৃষ্ণা কৌতূহলী বাদামি চোখে তাকায় পাপার দিকে।

তারপর মাকে বলে, ‘মা, পাপা কী বলে? আমার বান্ধবীরা তো কত রকম পোশাক পরে। কত রকম খাবার খায়। ওদের বাবা-মায়েরা তো আবার ওই দোকানের লম্বা লম্বা বোতলও খায়। কই, আমার পাপা তো খায় না! আবার মা, আমাকে সব পোশাক পরতেও দেও না, কেন?

পরিবারে ধর্মকে প্রাধান্য দিলেও লাইলি সব সময় চান মেয়ে প্রগতিশীল হোক। ধর্মীয় গোঁড়ামির ধারক নয়।

কৃষ্ণা পাপার কাছেই শিখেছে, সবার ওপর মানুষ সত্য, তাহার ওপর নাই! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া কৃষ্ণা তাই বান্ধবীর দেওয়া পূজার প্রসাদ যেমন খুশিমনেই খায়, বন্ধুর মায়ের দেওয়া বড়দিনের উপহারকেও হাসিমুখেই গ্রহণ করে।

দোকানের ওই লম্বা বোতলে যা থাকে, তাতে থাকা ধর্মীয় নিষেধটি সেদিন বলেছিলেন শামস।

‘ধুর যা, তার চেয়ে আমার কমলা ঢের ভালো।’ কৃষ্ণা বলে।

মেয়ের কথায় মাও একমত ছিলেন।

লাইলি খেলার ছলে একদিন মেয়েকে একেবারে ছোট স্কার্ট আর হাই নেক টপ পরিয়ে আয়নার সামনে আনলেন। কালচে কমলা রংটা কৃষ্ণার ত্বকের সঙ্গে একদম বেমানান। আর অতিরিক্ত শরীর খামচে ধরেছিল পোশাকটা।

‘বল তো মা, এটা কি তুই?’ লাইলির সরল প্রশ্ন।

‘এহহে রে! মোটেও না! একদম বিশ্রী দেখাচ্ছে আমাকে।’ চিৎকার দিল কৃষ্ণা।

মেয়ের চোখে চুমু খেয়ে উথলে ওঠা জলটা মুছে দিলেন লাইলি। দরজার আড়ালে দাঁড়ানো স্বামীর চোখের মুগ্ধতা স্ত্রীর নজরে পড়ল ঠিকই। লাইলির মনে পড়ল, শামস নিজেও তার শাশুড়ি শাহিনার আদুরে পুত্র ছিলেন একসময়। তাই মা-মেয়ের এই আদুরে মুহূর্তগুলো বেশ উপভোগ করেন শামস। মেয়ের চোখ বাঁচিয়ে লাইলি উড়ন্ত চুমু ছুড়লেন স্বামীকে। প্রশ্রয়ের হাসি হেসে আড়ালে চলে গেলেন শামস।

কৃষ্ণাকে এবার নীল–সাদা ছাপা লম্বা স্কার্ট পরালেন লাইলি। সঙ্গে একরঙা সাদা শার্ট আর আকাশি ওড়না। একটু কাজল টেনে দিলেন চোখে। কানে–গলায় হালকা রুপার গয়না। মেয়েকে আবার আয়নার সামনে আনলেন লাইলি।

‘এবার বল মা, এটা কি তুই?’

এবার কৃষ্ণার ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসি। ‘হ্যাঁ মা, এইটাই আমি।’

ততক্ষণে ঘরে ঢুকেছেন শেফালি। খালামণিকে দেখে কৃষ্ণা একছুটে সোজা বুকে। শেফালি বোনকেও টেনে নিলেন কাছে। ভাগনিকে বললেন, তোর বয়সে তোর মাও এমন ছিল। তুই তোকে যা মানায়, যেভাবে তোর মনে হয় এটাই আমি, তেমনটাই চলিস। কারও নকল করার চেষ্টা করিস না।

এমন সময় শামস যেন কোথা থেকে উড়ে এলেন। ‘এই যে, প্রীতিলতা, ছোট প্রীতিলতা এবং প্রিয় ভগিনী, স্মাইল প্লিজ! একখান ফোটো তুলবার মন চায় যে!’

শুনে সবাই হেসেই খুন। ক্যামেরা সেট করে শামস নিজেও ঢুকে গেলেন ছবিতে।

সেদিন থেকে কৃষ্ণা যে শুধু পোশাক–সচেতন তা নয়; মায়ের কাছেই সে শিখেছে, বাহ্যিক রূপ নয়, গুণ দিয়ে মন জয় করা যায়। সে চেষ্টাই করে কৃষ্ণা। (চলবে)