পড়ন্ত বেলায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কাজটা কি ঠিক হলো, সুলেখা?

সমুদ্রের সফেদ ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে সুলেখার নূপুর-পরা পায়ের ওপর। সেদিকেই একপলকে তাকিয়ে আছে সুলেখা। এমন অপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্য কতকাল প্রতীক্ষা করেছে সে! সমুদ্রের বিশালতার কাছে বিলীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল সেই কবে থেকে। সমুদ্র তার নীলাভ বক্ষে কতবার যে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। কিন্তু সাড়া দেওয়া হয়ে ওঠেনি সুলেখার। জীবনের হিসাবের খাতার জটিল অঙ্কের হিসাব মেলাতেই কেটে গেছে অনেকটা সময়।

অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে সুনীল আবার বলল, আমরা ভুল করিনি তো? সবাই কী ভাববে, ভেবে দেখেছ, সুলেখা?

সুলেখা দুই চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিশ্বাস নিল। যেন কতকাল বুকের ভেতর ভারী একটা পাথর চাপা পড়ে ছিল। আজ সমুদ্রের কাছে এসে সেই পাথর অপসারণ হলো।

সুলেখা আলতো করে সুনীলের কাঁধে হাত রেখে বলল, যা করেছি বেশ করেছি। কে কী ভাববে, সেটা নিয়ে আর কোনো অযাচিত ভাবনা নয়, সুনীল। যে পৃথিবী দুটি আত্মাকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায়, সে পৃথিবীতে আমরা নাইবা থাকলাম। পুরোটা জীবন যার সঙ্গে সুখে–দুঃখে পার করেছ, পারবে পড়ন্ত বেলায় তাকে ছাড়া থাকতে? আমি তো পারব না। ভোরের আলোয় যার মুখ দেখে দুই চোখ খুলেছি, আবার যার মায়াভরা দুটো চোখের পানে চেয়ে রাতে দুই চোখ বন্ধ করেছি, কী করে তাকে ছাড়া আলাদা জগতে থাকব? তোমার কোলে মাথা রেখে আমি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। বৃদ্ধ বয়সেও আবেগ থাকে, অনুভূতি থাকে, থাকে ভালোবাসা নামক প্রগাঢ় বন্ধন। যেটা এ যুগের ছেলেমেয়েরা বুঝতে চায় না।

ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে পুরোনো সেই জীবনযুদ্ধের ছবি যেন ভেসে উঠল সুনীলের চোখে।

সুলেখাদের বাড়িতে লজিং মাস্টার ছিল সুনীল। সুলেখা আর তার ছোট বোন শ্রীলেখাকে পড়াত। সুলেখা ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে ছিল। কথার মায়াজালে খুব সহজেই সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারত। সময়ের স্রোতে কীভাবে যেন লজিং মাস্টারের সঙ্গে প্রণয়ের সুতোয় বাঁধা পড়ল সুলেখা। দুটি হৃদয়ের এক বৃন্তে আবদ্ধ হওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নিল না সুলেখার পরিবার। বিলেতফেরত কোনো এক সুপাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলল সুলেখার বাবা। কিন্তু হতদরিদ্র সুনীলের একবুক ভালোবাসার সাগরে নিমজ্জিত হওয়ার প্রয়াসে কোনো এক কাকডাকা ভোরে সুনীলের হাত ধরে বেড়িয়ে পড়ল অজানা গন্তব্যে।

জলের ঝাপটা চোখে পড়তেই সুনীল পুরোনো স্মৃতির অ্যালবাম থেকে বাস্তবে ফিরে এল। সুলেখা সমুদ্রের সঙ্গে মিতালি করে এগিয়ে গেছে আরও কয়েক ধাপ। বিদায়ী সূর্যের রক্তিম আভা যেন সুলেখার চোখে–মুখে। কী পরম আনন্দে সূর্যাস্ত দেখছে।

৩৫ বছরের সংসারজীবনে স্বামীর কাছে সুলেখা কোনো দিন কিছু চায়নি। শুধু সমুদ্রের নীল ছুঁতে চেয়েছিল! সুনীলের হাত ধরে মন ভেজাতে চেয়েছিল সমুদ্রজলে। মধ্যবিত্ত সংসারে স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর সাধ বলে কিছু থাকতে নেই। সুলেখার সমুদ্র দেখার প্রবল তেষ্টা মেটাতে পারেনি বলে সুনীল কত যে ক্ষতবিক্ষত হতো, সেটা কেবল সুনীলই জানে। সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েটি শুধু ভালোবাসার টানে সুনীলের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল। পুরোটা জীবন নিজের সংসারের জন্য সংগ্রাম করেছে। সন্তানদের মানুষ করেছে। স্বাবলম্বী করেছে। কিন্তু বেলাশেষে কী প্রতিদানটাই তারা দিল!

এই শুনছ? এদিকে এসো। দেখো দেখো, বিশাল এই সমুদ্রটা কীভাবে সূর্যকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে? আমাদের কিন্তু পাশাপাশি হাত ধরে সূর্যাস্ত দেখার কথা ছিল।

সুলেখার ডাকে সাড়া না দিয়ে কি থাকা যায়? সুনীল মৃদু হেসে ঢেউকে সঙ্গী করে পা বাড়াল প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে পেছনে ফেলে আসা নির্বাক কষ্টগুলোর ছবি। জীবনের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছার পর যখন নিজ সন্তানেরা মা–বাবাকে নিয়ে ভাগাভাগি শুরু করল, তখন পুরো পৃথিবীই আঁধারে ঢাকা পড়েছিল। যে সুলেখার হাত ধরে সুনীল প্রতিজ্ঞা করেছিল আমৃত্যু তার পাশে থাকবে, কী করে পারত সন্তানদের কথায় হৃদয়ের খুব কাছের মানুষটা থেকে দূরে থাকতে? এক ছেলে বাবাকে রাখবে আরেক ছেলে মাকে রাখবে। কেউ দুজন মানুষকে একসঙ্গে মাথার ওপর একটি ছাদ দিতে রাজি নয়। অথচ এই দুজন মানুষ নিজেদের সবটুকু দিয়ে সন্তানদের আগলে রেখেছে। সুলেখা ভীষণ অভিমানী মেয়ে। সন্তানরা আজ স্বাবলম্বী। যে মানুষটির জন্য একদিন নিজের পরিবার ছেড়েছিল আজ সেই মানুষটির জন্য আবারও ঘর ছাড়ল। জীবনের বাকিটা পথ সুনীলের হাত ধরেই পার করবে। যারা ভালোবাসার মূল্য বোঝে না, তাদের সঙ্গে না থাকাই উত্তম। সুলেখার সিদ্ধান্তে প্রথমে কিছুটা সংকোচে পড়লেও পরে সুনীল ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রের মায়াবী জগতের কাছে। শেষ বয়সে হলেও যেন সুলেখাকে এক নজর সমুদ্র দেখাতে পারে, সে জন্য আগে থেকেই মনস্থির করে রেখেছিল। যতটুকু সম্বল অবশিষ্ট আছে, তাতে দুজন বুড়োবুড়ি পড়ন্ত বেলাটা দিব্যি পার করে দিতে পারবে। বৃদ্ধ বয়সে যেন সন্তানদের ওপর বোঝা হতে না হয়, সে জন্য সুনীল প্রতি মাসের আয় থেকে কিছু অর্থ সঞ্চয় করে রাখত। সব সময় মনে মনে ভয় পেত, সন্তানেরা যদি শেষ বয়সে মা–বাবাকে না দেখে। যেমনটা ভেবেছিল তার চেয়েও ভয়াবহ হলো যখন সন্তানেরা একসঙ্গে মা–বাবাকে রাখতে অনিচ্ছা প্রকাশ করল। যেখানে সুনীল–সুলেখা একসঙ্গে বৃদ্ধ হওয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, সেখানে কী করে এমন বিচ্ছেদ মেনে নেবে?

সুনীল ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। সুলেখার হাতে হাত রাখল। সুলেখার চোখে জল। বোধ হয় বুক ফেটে কান্না আসছে। সুনীল চায় আজ সুলেখা কাঁদুক। চিৎকার করে কাঁদুক। জীবনের সমস্ত কষ্টের নোনা জল আজ সমুদ্রে বিসর্জন দিক। বাকি পথটা যেন নিশ্চিন্তে সুনীলের হাত ধরে পার করতে পারে।

শাহীন আক্তার স্বাতী: কানাগাওয়া কেন, জাপান।