কৃষ্ণসাগরপাড়ে এক টুকরো বাংলাদেশ

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিদেশি শিক্ষার্থীরা। ছবি: জাহিদুল হাসান
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিদেশি শিক্ষার্থীরা। ছবি: জাহিদুল হাসান

মাঝেমধ্যে স্কুলের সেই দেশ খুঁজে বের করা খেলার কথা খুব মনে পড়ে। ছোটবেলায় স্কুলের ডায়েরির একদম শেষের পাতায় কিংবা স্কুলের খাতার পেছনে পৃথিবীর মানচিত্র দেখে দেশ খুঁজে বের করার সময় বন্ধুদের বোকা বানানোর জন্য ইন্ডিয়াকে ভারত বলে খুঁজতে দিতাম অথবা ব্ল্যাক-সিকে কৃষ্ণসাগর বলে।

এতে অনেক সময় বন্ধুরা বোকা বনে গেলেও কখনো স্বপ্নেও ভেবে দেখিনি আমি আমার বাংলাদেশের পতাকা এখানে ওড়াতে পারব কিংবা তার প্রতিনিধিত্ব করতে পারব। আমি সত্যি সৌভাগ্যবান, এই কৃষ্ণসাগরের পাড়ে অবস্থিত তুরস্কের সামসুন শহর। যেখান থেকে মুস্তাফা কেমাল আতাতুর্ক তুরস্কের স্বাধীনতাযুদ্ধের যাত্রা শুরু করেন সেই শহরে বাংলাদেশ, বাংলাদেশি অথবা বাংলাকে তুলে ধরতে পেরেছি।

রাষ্ট্রদূত এম আল্লামা সিদ্দিকীর সঙ্গে লেখক ও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। ছবি: জাহিদুল হাসান
রাষ্ট্রদূত এম আল্লামা সিদ্দিকীর সঙ্গে লেখক ও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। ছবি: জাহিদুল হাসান

আমি বর্তমানে তুরস্কের অন্দোকুজ মায়েস ইউনিভার্সিটিতে পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায় অধ্যয়ন করছি। আমি যে শহরে আছি, সেই সামসুন শহরে প্রায় এক লাখ মানুষের বসবাস। আর এই এক লাখ মানুষের মাঝে মিশে আছি আমরা চারজন বাংলাদেশি। আমরা চারজনের সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে অধ্যয়ন করছি।

গত বছর যখন তুরস্ক সরকারের বৃত্তি পেয়ে এখানে আসি, এসে দেখি একমাত্র আমরাই এখানে লোকবলে কিংবা জনগোষ্ঠী আকারে সবচেয়ে কম মানুষ। একবার হাসি পেল কোথায় আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আর কোথায় চারজন।

নিজের দেশ, দেশের সংস্কৃতি ও দেশের মানুষগুলোকে পরিচয় করানো যে তীব্র ইচ্ছা ছিল সেখান থেকে শুরু করি প্ল্যান। প্রথমে ঘরোয়াভাবে চারজন আলোচনা। পরে একের পর এক ধাপ এগোনো।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুর্কি ভাষাকেন্দ্রের পরিচালক। ছবি: জাহিদুল হাসান
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুর্কি ভাষাকেন্দ্রের পরিচালক। ছবি: জাহিদুল হাসান

প্রত্যেক ধাপেই ছিল বাধা–বিপত্তি। কিন্তু দেশকে পরিচিত করাব এই প্ল্যানটা নিয়ে যখন দেশটির রাজধানী আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাসে গেলাম, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আল্লামা সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনা করে সবচেয়ে বেশি সাহস পেলাম। তিনি সাহস তো দিলেনই সঙ্গে বললেন, তিনি আমাদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও করবেন। যা আমাদের জন্য ছিল আরও বড় পাওয়া।

দূতাবাসের সবার অনুপ্রেরণা ও সাহায্যে আমরা আরও জোরেশোরে এগিয়ে যাই। সেখান থেকে ফিরে আমরা শুরু করে দিই আমাদের কাজ। সবই এগোচ্ছিল ঠিকমতো। কিন্তু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে কীভাবে? তা–ও আমরা মাত্র চারজন। কে নাচবে, কে গাইবে, কে খাবার পরিবেশন করবে? এত এত কাজ কীভাবে সামলাব।

সমাধানে এগিয়ে এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রী সংগঠনের বন্ধুরা। তাঁরা বললেন, ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। কীভাবে সাহায্য করতে পারি আমাদের বল।’

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অ্যাসোসিয়েশনের কো-অর্ডিনেটর। ছবি: জাহিদুল হাসান
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অ্যাসোসিয়েশনের কো-অর্ডিনেটর। ছবি: জাহিদুল হাসান

তখন আমার মাথায় খেলে গেল, সারা জীবন আমরা মানুষের ভাষা সংস্কৃতি শিখেছি। এবার আমাদের ভাষা, নাচ, গান ওদের একটু শেখাই। সেখান থেকে খুঁজে বের করি তিনজন তুর্কি বন্ধু এলিফ, বুসে ও বেস্তেকে। যাঁরা আমাদের বাংলা নাচ শিখে ফেললেন।

ইরানের ইওস্রা, ফিলিপাইনের সালেহা, জর্জিয়ার আয়দা, মিসরের গালাল ও হাজেম, ভারতের সামিদ, তুর্কমিনিস্তানের সাত্তার, আর্নাভুতের শাফিনাজ ও আঙ্কারা থেকে আমন্ত্রিত চিন্ময় মজুমদারের নেতৃত্বে ভাষাশহীদদের স্মরণে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি দলগতভাবে পরিবেশিত হয়।

এ ছাড়া একক সংগীতে চিন্ময় মজুমদার, কোরআন তিলাওয়াতে দুরুল হুদা ও অনুষ্ঠান সঞ্চালনের দায়িত্বে ইউসুফ ইরাজের ভূমিকা ছিল।

অনুষ্ঠানের শেষে ফ্যাশন শোর মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক ও বিভিন্ন পেশার মানুষদের পরিচয় করানো চেষ্টা করা হয়। যেখানে আমাদের দেশি পোশাকগুলো পরিধান করেছিলেন আমাদের বিদেশি বন্ধুরাই।

এভাবে শুরু হয় আমাদের বাংলাদেশকে পরিচিত করার পথচলা। এটা ছিল শুরু। সেই শুরু। সেই অনুষ্ঠানের পর থেকে এখন আর বাংলাদেশের কোনো অনুষ্ঠানে আমাদের বাংলাদেশি বন্ধুদের উপস্থিতির প্রয়োজন হয় না। কয়েকজন তো বাংলা গান, ভাষা কিছুটা শিখে ফেলেছেন।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব সবুজ আহমেদ। ছবি: জাহিদুল হাসান
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব সবুজ আহমেদ। ছবি: জাহিদুল হাসান

কারণ, এখানকার মানুষ ও আমাদের বিদেশি বন্ধুরা আমাদের বাংলাদেশকে এত বেশি পছন্দ ও ভালোবেসে ফেলেছেন যে যখনই শোনেন বাংলাদেশের কোনো অনুষ্ঠান হবে, বিদেশি বন্ধুরা এগিয়ে এসে তাঁরাই সব সাজিয়ে নেন।

এই তো যেমন গত ১৬ ডিসেম্বরে কৃষ্ণসাগর পাড়ে সেই বন্ধুদের নিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করি। যেখানে সামসুন শহরের সিটি মেয়র, মন্ত্রী ও আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতি অনুষ্ঠানকে আরও আলোকিত করেছিল।

সবশেষে বলতে চাই, এখানে আমরা মাত্র চারজন বাংলাদেশি হলেও ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে আমি ও আমাদের সামসুনের সবাই গর্বিত। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। সেই কথাটির প্রমাণ এই সফল আয়োজনের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পেরেছি। আশা করি আমাদের মতো এভাবে সবাই আমাদের দেশকে একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে।
---

মো. সাফায়াত হোসেন: স্নাতকোত্তর পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগ, অন্দোকুজ মায়েস ইউনিভার্সিটি, সামসুন, তুরস্ক।