পূর্ণিমায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এই মাত্র মাগরিবের আজান দিল। বুড়িগঙ্গার ধার ঘেঁষে ছোট চায়ের দোকানটার সামনে রিকশা থামাল রিফাত। কাঁধের ব্যাগ সামলে নিচে নেমে ভাড়া মিটিয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে বসল সে।

এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। চায়ের সঙ্গে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু দোকানে তেমন কিছু নেই। বনরুটি, হলুদ কেক আর সাগরকলা আছে। এসব খাবার খাওয়ার মতো দুর্দিন তার পড়েনি।

সঙ্গের ব্যাগটাকে কাছছাড়া করছে না সে। কোলে নিয়েই চা খাচ্ছে। চায়ের দোকানি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।

রিফাতের হাসি পেয়ে গেল। বন্ধুসুলভ গলায় বলল, কী দেখেন, মামা?

ধরা পড়ে লাজুক হাসি দিল চায়ের দোকানি মুসা মিয়া। কিছু না, ভাই।

দোকানে তেমন ভিড় নেই। বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে রিফাত। চাঁদ ওঠেনি এখনো। ব্যাগ খুলে জিনিসপত্র বের করা শুরু করল সে। মুসা মিয়া হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ওহ, ক্যামরাওয়ালা। ডিএসলার না কী জানি কয় এগুলোকে। মুসার মোবাইলেও ক্যামেরা আছে। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছে। ডিএসলার দিয়েও যা, তার মোবাইলেও তা। তবু ডিএসলারের ছবি কেমন ওঠে কে জানে! ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করা যায়।

: ভাইজান?

: বলেন।

: এই ক্যামরা দিয়ে ফটু উঠাইলে কী অয়?

: তেমন কিছু না, একটু ভালো হয়।

: মোবাইলে তুললেও তো হয়।

: তা হয়।

: ভাই যদি কিছু মনে না লন, একটা ছবি দেখতাম।

রিফাত হেসে ফেলল। মুসাকে ভালো লাগছে তার। চায়ের দোকানিরা এমনিতেও মাই ডিয়ার টাইপ লোক হয়। চায়ের দোকান হচ্ছে আদর্শ কমিউনিজমের উদাহরণ। সাধ্যের মধ্যে প্রাপ্য বস্তু। ক্রেতার ভেদাভেদ কম। ছবির জন্য এমনিতেও লেন্স অ্যাডজাস্ট করতে হবে। রিফাত চুলা আর কেটলির দিকে ক্যামেরা তাক করল। আবার ফোকাস সরিয়ে মুসাকে বলল, মামা, কয়েকটা কাচের কাপে লিকার ঢালেন। তারপর কেটলি চুলায় দেন।

মুসা নির্দেশ পালন করল।

রিফাত কয়েকটা স্ন্যাপ নিল। এরপর মুসাকে দেখাল।

মুসা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ছবিতে কেটলির ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। তার কাচের কাপগুলোতে লিকারের রং এত সুন্দর ফুটে উঠেছে, মুসা ক্ষীণ গলায় বলল, ভাইসাব, এই ক্যামরার দাম কত?

: কেন, ছবি বেশি ভালো লেগেছে?

: আমার এক মেয়ে আছে। পাঁচ মাস বয়স আর ছেলে দুই বছরের। তারার ছবি তুলতাম।

: আছে, অনেক রকমের। ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার।

মুসা মুখ কালো করে ফেলে। মায়া লাগে রিফাতের। সে গলা নামিয়ে বলে চোরাবাজারে পাঁচ-দশ হাজারেও পাওয়া যায়। খোঁজখবর করতে হয়, আমি জানাব আপনাকে।

মুসা খুশি হয়। আচ্ছা, ভাইজান।

মুসার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্যামেরা হাতে হাঁটা শুরু করে রিফাত। সামনে একটা চড়ার মতো আছে। সেখানেই ছবি তুলবে। আজ পূর্ণিমা। নদীর পানিতে চাঁদের রিফ্লেকশন ধরতে চেষ্টা করবে সে।

চাঁদ এখন মাঝ আকাশে। গয়নায় জড়ানো অহংকারী রাজকন্যার মতো মাথার ওপর চাঁদ হাসছে। ঝকঝক করছে চারপাশ। লেন্স ঠিক করে ফোকাস করল সে। লেন্স ঘোরাচ্ছে। ক্লিক করার আগমুহূর্তে এক নারী এসে ফ্রেমে ঢুকে গেল।

বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেল রিফাতের। এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে মনমতো ছবি তোলার সুযোগ পাওয়াও মুশকিল। যেখানেই যাও, গিজগিজ করছে মানুষ। রিফাত অপেক্ষা করতে লাগল, মহিলা হয়তো চলে যাবে।

এ কী, মহিলা দেখা যাচ্ছে মহানন্দে নদীর পাড়ে হাঁটাহাঁটি করছে। হাত বাড়িয়ে কী যেন ধরতে চাইছে, পাগল নাকি?

আবার লেন্স জুম করল রিফাত। অদ্ভুত দৃশ্য। তারই কাছাকাছি বয়সের একটা হিজাব পরা মেয়ে। চাদের আলো ধরতে চাইছে। ঠোঁট নড়ছে। গান গাইছে মনে হয়। রিফাতের ভারী আফসোস হলো, মেয়েটা শাড়ি পরে চুল খুলে এলে চমৎকার একটা সাবজেক্ট হতো।

ধুর, ফটোগ্রাফারের আবার বাছবিচার কিসের। সে ছবি তুলতে লাগল। তবে ফ্ল্যাশ টের পেয়ে মেয়েটা দাঁড়িয়ে গেল। ভীত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। তারপর হঠাৎ দ্রুত হাঁটা শুরু করল।

ওই মুহূর্তে মেয়েটা কনস্টেবল শিকদার আর জিলানির সামনে পড়ে গেল।

: এই মহিলা, দাঁড়ান।

: কী চাই?

: আমরা কিছু চাই না। আপনি এই রাতে এখানে কী চান?

: পূর্ণিমা দেখতে এসেছি।

জিলানি হতভম্ব হয়ে গেল। পুলিশজীবনে এমন অদ্ভুত কথা সে কখনো শোনেনি। একটা সোমত্ত মেয়ে দেশের এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে রাত নয়টায় চাঁদ দেখতে নদীর পাড়ে আসতে পারে। নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো দুই নম্বরি আছে। শিকদার এর মধ্যে ধমকে উঠল, ফাইজলামি করেন? কী করতে আসছেন, ঠিক করে বলেন। নয়তো মহিলা পুলিশ ডেকে লকাপে নিয়ে যাব।

: কেন, এমন কোনো আইন আছে, রাতে চাঁদ দেখতে আসা যাবে না?

: এইখানে কি ভাড়া খাটতে আসছ তুমি? এদিকে তো খদ্দেরও পাওয়া যাবে না।

: মুখ সামলে কথা বলুন। বেয়াদব, স্টুপিড কোথাকার। আরেকবার একটা বাজে কথা বললে সুমন ভাইকে কল দেব।

: তুই চুপ। তোদের চিনা আছে, করিস ছিনালি, আবার হিজাব লাগাইছস। ঠিক করে বল, তুই কার আন্ডারে কাজ করস? জামাল নাকি মোক্তার?

নাজিয়ার মেজাজ আকাশে উঠে গেল। ঠান্ডা গলায় বলল, আরেকটা বাজে কথা বললে এক ঘুষিতে দাঁত ফেলে দেব। চোর–ডাকাত ধরার নামে নেই, আছে শুধু পাবলিকদের হ্যারাস করার তালে। সে খট করে মোবাইল বের করে এসআই সুমনের নম্বর ডায়াল করল। সুমন তার ফেসবুক ফ্রেন্ড।

সব শুনে সুমনও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। হ্যাঁ, সে মেয়েদের আত্মরক্ষা, স্বাধীনতা নিয়ে ফেসবুকে লেখে। নম্বরও দিয়েছে কয়জনকে। সেই ভরসায় কেউ একা একা পূর্ণিমা দেখতে চলে যাবে, এ তার কল্পনার বাইরে ছিল।

সে নাজিয়ার ফোনেই শিকদার আর জিলানির সঙ্গে কথা বলল। তারা নাজিয়ার কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক দেশের পরিস্থিতি জানিয়ে, মেইন রোডে এসে রিকশায় তুলে দিল। নাজিয়া দেশের নারীদের নাগরিক অধিকার নিয়ে গজর গজর করতে লাগল। দুই পুলিশ পাগলের প্রলাপ বলে ধৈর্য ধরে চুপ রইল।

রিফাত অবশ্য এসব কিছু বুঝতে পারেনি। চাঁদের আলোয় সে নাজিয়ার চেহারা বুঝতে পারেনি। তাই কৌতূহলে দূর থেকে তাদের অনুসরণ করেছিল। রিকশায় নাজিয়াকে একঝলক দেখল সে। একটু হতাশই হলো। কোনো আধুনিক, পরিপাটি সুদর্শনা নয়। নিতান্তই সাদামাটা একজন মেয়ে। শুধু চিবুকের কাছে একটা বড় তিল। মেয়েটাকে হাসলে কেমন দেখায় কে জানে। এখন বড্ড রেগে আছে।

রিফাতের আজ আর ছবি তুলতে ইচ্ছে করছে না। ক্যামেরা গুটিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলল সে। রিকশা নিয়ে গুলিস্তান রওনা হলো। গন্তব্য জিগাতলা। বাসায় আম্মা বকবে, দেরি করলে। ছিনতাইকারী ক্যামেরা নিয়ে যাবে। যাওয়ার সময় দুই পোচ দিয়ে যাবে। এই জন্য রাতে ছবি তুলতে দিতে চান না।

পরের কিছুদিন আর কিছুতে মন বসে না রিফাতের। চিবুকে তিলওয়ালা সেই সাদামাটা বাস্তব জ্ঞানহীন মেয়েটার কথা খুব মনে হতে থাকে রিফাতের। ইচ্ছে হয়, কোনো এক পূর্ণিমার রাতে নদীর ধারে দুজন মিলে ছোটাছুটি করে মুঠি মুঠি চাঁদের আলো ধরে।

নাজিয়াও চাঁদ দেখলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে হিমালয়, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে চায়নি। জনাকীর্ণ ঢাকা শহরের নদীর ধারে সামান্য পূর্ণিমা দেখতে চেয়েছিল। যেই শোনে সেই অবাক হয়। নাজিয়া কী অদ্ভুত। এই শহরে পূর্ণিমা দেখার ইচ্ছে আর সকলেরই মরে গেছে।

প্রায় তিন মাস পর রিফাত তার অফিসের কাজে সদরঘাট এসেছিল। হঠাৎ একটা মেয়েকে ছুটে আসতে দেখল তার পাশের দোকানে, মেয়েটি এসেই একটি বয়স্ক লোককে ধমকাতে শুরু করল। বলল এই মিয়া, ছাড়েন বাচ্চাটাকে, এখনই ছাড়েন।

বয়স্ক লোকটির নাম মতলব মিয়া। সে উল্টো মেজাজ দেখিয়ে বলল কেন ছাড়ব, এটা আমার নাতিন।

মেয়েটি আরও রেগে গেল বলল, আপনি যে একটা chilid abuser বিষয়টা জানেন? এ বাচ্চাটাকে এ রকম বিশ্রীভাবে আদর করছেন কেন?

মতলব মিয়া child abused কী জানে না। তবে বুঝতে পারল তাকে ইংরেজিতে গালি দেওয়া হয়েছে। সে খুবই রেগে গেল। ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল আপনি আমারে ইংলিশে গালি দিলেন? বেয়াদব মেয়ে, বাপ-মা আদবকায়দা শিখায় নাই?

: চুপ হারামি। বাচ্চাদের নির্যাতন করে আবার আমাকে আদবকায়দা শেখাতে আসছে।

এই সময় বাচ্চাটা ভয়ে ভয়ে সরে দাঁড়ায়। বলে, নানা আপনের এরুম হাতাহাতি আমার ভাল্লাগে না।

মতলব মিয়া বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকায়—আর একটা কথা কইলে তোর মাসহ লাত্থি দিয়া ঘরতে বাইর কইরা দিমু। সারা দিন থাকব গারমেন্টে, এই আপদ থুইয়া যাইব আমার ঘাড়ে।

নাজিয়া মোবাইল বের করে ছবি তুলে ফেলে। এই ছবি আমি থানায় জমা দিয়ে আসব। রেডি থাইকেন পুলিশের জন্য।

মতলব দৌড়ে এসে মোবাইল ছিনিয়ে নিতে চায়। নাজিয়া চেঁচিয়ে ওঠে ছিনতাইকারী, ফোন নিয়ে গেল। এই বলে এক দৌড়ে একটা রিকশায় উঠে বলে, মামা টান দেন।

রাস্তার ওপারে বাসের অপেক্ষায় থাকা রিফাত মাথা নাড়ে। এই পাগলির সঙ্গে জীবন কাটাতে গেলে এসব ঝামেলায় প্রতিদিন পড়তে হবে। কিন্তু জীবন হবে অসাধারণ। একে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।

ডা. আমেনা বেগম ছোটন: চিকিৎসক