হুঁকা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

স্কুল ছুটি হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। টিচারদের একটা মিটিং ছিল। এইমাত্র শেষ হয়েছে। হেড স্যার তার অফিসে বসে কী যেন লিখছেন। ঠিক তখনই মবিন স্কুল মাঠের পাশ দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল। তাকে দেখেই স্যার উচ্চ স্বরে ডাক দিলেন। মবিন সুবোধ বালকটির মতো কাছে এসে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

হেড স্যার বলেন, ‘কেমন আছস?’

‘জি স্যার ভালো। আপনি কেমন আছেন?’

‘হ, ভালো। হুঁকা খাসনি এখন?’

‘স্যার, আমি আইএসএসবি পাস করেছি। আর্মি কমিশন্ড র‌্যাঙ্কে জয়েন করে দুই বছরের ট্রেনিং শেষ করেছি। ট্রেনিংয়ে থার্ড হয়ে এম এ জি ওসমানী গোল্ড মেডেল পেয়েছি, স্যার।’

হেড স্যার কিছুক্ষণ অবাক চোখে মবিনের দিকে চেয়ে থাকেন বাকরুদ্ধ অবস্থায়। এরপর শক্ত মনের হেড স্যার মবিনকে জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর কোনো কথাই বলতে পারেন না।

মবিন তখন সবে হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব খুব বেশি নয়। পনেরো মিনিটের হাঁটাপথ। স্কুলে যাওয়ার আগে কাজের লোকদের নাশতার হাঁড়ি আর হুঁকাটা প্রস্তুত করে নিয়ে যাওয়া ছিল তার রুটিন কাজ। জমিতে মৌসুমি কাজ হলেও মাছের খামারে বারো মাস কাজ লেগেই থাকত।

মবিনের মা নাশতা তৈরি করে থালাবাটিগুলো গুছিয়ে একটা ব্যাগে রাখতেন। আর এই সুযোগে মবিন হুঁকা আটকাত। লাকড়ির চুলার জ্বলন্ত অঙ্গারে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখলে টিক্কাটা জ্বলে উঠত। হাতে নিতেই জ্বলন্ত টিক্কাটার সাদা ধোঁয়ায় মন মাতানো একটা ঘ্রাণ বের হতো। এক দিন, দুদিন এভাবে ঘ্রাণটা উপভোগ করে মবিন মনে মনে বলত, আহা! টিক্কার ধোঁয়ার ঘ্রাণটাই এত মজা, না জানি কেমন মজা হুঁকা খাওয়া। এভাবেই ধীরে ধীরে হুঁকার প্রতি তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। যাওয়ার পথে আনারসবাগানের শেষ প্রান্তে ঝোপে বসে কয়েক মিনিট হরদম চলত মবিনের হুঁকা খাওয়া।

দিনে দিনে মবিনের হুঁকা খাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়। ঝড়বৃষ্টি অথবা অন্য কোনো কারণে কাজ বন্ধ থাকলে ওই দিনটা মবিনের বড় কষ্ট হতো। খুব অস্থির লাগত সারাটা দিন। হুঁকা খাওয়ার সুযোগটা আসা মাত্রই আহা, প্রাণটা যেন বাঁচল। এভাবেই কাটছিল মবিনের দিনরাত্রি।

প্রতি শুক্রবার বিকেলে টিভিতে প্রচারিত সিনেমাটা মবিনের কিছুতেই মিস হতো না। ধার্মিক বাবার কড়া শাসনে বাড়িতে কোনো টিভি ছিল না। পাশের মহল্লার মনু মেম্বরের বাড়িতে গিয়ে চলত তার সিনেমা দেখা। বিজ্ঞাপন বিরতিতে সে এক দৌড়ে বাড়ি চলে আসত। মা-বাবাকে তার উপস্থিতি জানান দিত। কখনোবা অজু করে জোরেশোরে আকামত দিয়ে দ্রুত আসরের নামাজ শেষ করে আবার সিনেমা দেখতে দৌড় দিকে।

অন্যদিকে হুঁকা খাওয়া চলছেই। অতি সতর্ক মবিন হুঁকায় ধরা না পড়লেও সমস্যা বাধে অন্য খানে। যে বাড়িতে মবিন টিভি দেখতে যায়, ওই বাড়িতে তারই সমবয়সী বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে বেড়াতে আসে। মেম্বর সাহেবের বড় মেয়ে আসমার একমাত্র মেয়ে লিজা।

সিনেমা দেখার ফাঁকে ঘরের পেছনে মবিনকে দেখা যায় লিজাকে জড়িয়ে ধরে নিবিড় আলিঙ্গনে মিশে আছে। এ আবার কী করে সম্ভব হলো। যেন আরেক জীবন্ত সিনেমার শুটিং। মবিনের ভাগ্য খারাপ। লিজার ভাগ্য মনে হয় তার চেয়েও খারাপ। কী কারণে জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই আসমা প্রেম বিনোদনে মিশে যাওয়া যুগলকে দেখে ফেলে। এই এট্টুখানি দুটো ছেলেমেয়েকে এমনভাবে দেখে আসমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। শিকারি বাজের মতো এই অপরিণত প্রেমিক যুগলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লিজাকে ঠাসঠুস দুই-তিন থাপ্পড় মেরে ভেতরে নিয়ে যায়। এদিকে মবিন এক দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে সদর রাস্তায়। তখনই আসমা সোজা মবিনদের বাড়ি এসে তার মা-বাবার কাছে নালিশ করে যায়।

ওই দিন বাড়ির পরিস্থিতি বেশ থমথমে। বিষয়টি টের পেয়ে মবিন চলে যায় পাশের গ্রামে ফুফুর বাড়িতে। তবে শেষ রক্ষা আর হয়নি। পরদিন সকালে মবিনকে ফুফুর বাড়ি থেকে ধরে এনে বেশ মারধর করা হয়। প্রয়োজনীয় বিছানাপত্র, একটা ট্রাংকে কিছু জামাকাপড় দিয়ে স্কুলের অদূরেই কওমি মাদ্রাসায় মবিনকে ভর্তি করা হয়। মা-বাবা দুজনই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে এই ইবলিসরে ঠিক রাখতে হলে মাদ্রাসায় দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

শুরু হয় মবিনের অন্য রকম এক জীবন। মাদ্রাসার পাশ দিয়েই ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। তখন মাদ্রাসায় পুরোদমে ছবক চলতেই থাকে। হুজুর একটু আড়াল হলেই মবিন জানালা দিয়ে স্কুলটার দিকে চেয়ে থাকে। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে জানালার পাশে বসে থাকা মবিনকে দেখে ছেলেমেয়েরা নানান অঙ্গভঙ্গি করে। কখনো ভেংচি কাটে। একদিন তার সাবেক সহপাঠী দুই বান্ধবী দোলা আর নিপু স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মবিনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। তাদের দেখে মবিনের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কেমন যেন লজ্জা পায় সে। তবে এ দুই বান্ধবীর বেলায় ঠিক এ কথা খাটে না।

দোলা ইয়ার্কি করে বলে, ‘এই হুজুর, সেলামালিকুম। ভালো আছেননি।’

মবিন লজ্জায় মাথা নত করে রাখে।

হাঁপানি ধরা বুড়ির মতো দুটি কাশি দিয়ে নিপু বলে, ‘হুজুর, অ হুজুর। বিয়া পড়ানো শিখছেননি।’

কী এক অসহ্য কষ্টের ধোঁয়া মবিনের বুকে জমা হতে হতে একপর্যায়ে তা তীব্র ব্যথায় রূপান্তরিত হয়। তাও চলছিল কোনো রকম। সপ্তাহখানেক পরের কথা। সেদিন বিকেলে দেখা যায় লিজা মা-বাবার সঙ্গে মাদ্রাসার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। হয়তো বা নানাবাড়ির সুখের বেড়ানো তার শেষ হয়েছে। মবিনের অসহায় দুটি চোখ লিজার দিকে কেবল চেয়েই থাকে। লিজা হয়তো তাকে দেখেনি। কারণ, ওর চোখ ছিল বড় শান্ত।

লিজার এমন অচঞ্চল হেঁটে যাওয়া দেখে তার বুকের ব্যথাটা সহনীয় মাত্রা পার হয়ে যায়। দুফোঁটা অশ্রুতে কী এক ইঙ্গিত যেন ভেসে ওঠে তার চোখে। মবিন নিজেকে প্রশ্ন করে, মাদ্রাসাজীবন শেষে কী আছে? সফলতার কোন পথ পাড়ি দিয়ে এসে লিজার মতো এমন সুন্দরী, তুখোড় মেধাবী ছাত্রীর সামনে সগৌরবে দাঁড়ানো যায়? লিজা বলেছে বড় হয়ে সে ডাক্তার হতে চায়। সরকারি কলেজের শিক্ষক বাবার একমাত্র মেয়ে সে একদিন হয়তো ডাক্তার হয়েই যাবে। লিজা তাকে ভালোবাসে। তার সঙ্গে কথা বলতে লিজার বেশ আগ্রহ। তাই তো কোনো আপত্তি ছাড়াই সে তার বুকে বুক মেলাতে পেরেছিল। তবে এই অপরিণত ভালো লাগা শেষাবধি টিকবে কী? এমবিবিএস পাস করা লিজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে কি দাওরা পাস মবিন? এমন প্রাসঙ্গিক–অপ্রাসঙ্গিক নানান চিন্তায় তার মনের অস্থিরতা কেবল বাড়তেই থাকে।

আরও দুদিন পর শুক্রবার বিকেলে মবিন বাড়ি যাওয়ার জন্য দুই ঘণ্টার ছুটি পায়। তবে সে বাড়িতে যায়নি। সোজা হেড স্যারের বাসায় যায়। স্যারের পা জড়িয়ে ধরে ডুকরিয়ে কাঁদতে থাকে। মবিনকে স্কুল থেকে মাদ্রাসায় নিয়ে ভর্তির কারণ হেড স্যারের কাছেও গোপন ছিল না। তাই কথা না বাড়িয়ে স্যার বললেন, ‘সবে ক্লাস সেভেনে পড়স। এ বয়সেই মেয়ে জড়ায়ে ধরলে তোকে মাদ্রাসায় দেব না তো দেব কারে। এই গাধা! এখনই মেয়ে চিনে গেছস?’

মবিন চোখ মুছে বলে, ‘স্যার, আমি কি আর এত সব বুঝি? সিনেমায় দেখছি। তাই আমারও ইট্টুখানি ইয়া করার ইচ্ছা অইছিল যে দেখি কেমন লাগে।’

হেড স্যার চক্ষু রক্তবর্ণ করে বলেন, ‘কী, এত বড় সাহস তোর! মেয়ে আসছে নানাবাড়ি বেড়াতে। আর তুই ওই মেয়েরে জড়ায়ে ধরে ইয়া করস?’

মবিন অনুনয় করে বলে, ‘স্যার, এবারের মতো মাফ কইরা দেন। আমি আপনাকে কথা দিতাছি, এই জীবনে আর কোনো মেয়েকে জড়ায়ে ধরব না। আপনি, আব্বা-আম্মাকে বুঝায়ে আমারে স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করে দেন। আমি খুব ভালো করে লেখাপড়া করব, স্যার। কথা দিলাম।’

হঠাৎ করেই স্যারের সব রাগ পানি হয়ে যায়। মাথা নিচু করে হাসতে হাসতে বলেন, ‘খুব ভালো করে লেখাপড়া করবি। জীবনে আর কোনো মেয়েকে জড়িয়ে ধরবি না।’

‘না স্যার, ধরব না।’

‘আচ্ছা যা, দেখি কী করা যায়।’

হেড স্যারের আপ্রাণ চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত মবিনকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। মবিন তার আগের জীবন ফিরে পেয়ে আনন্দের আর সীমা নেই। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া, ঠিকমতো পড়াশোনা—একেবারে নিখুঁত জীবনে সভ্য এক মবিন। কোথাও ত্রুটি ধরার উপায় নেই।

হেড স্যারের কাছে বিষয়টা একটু রহস্যজনক মনে হলেও কিছুদিন পর একদিন তিনি মবিনকে অফিসে ডাকিয়ে আনেন। তাকে প্রশ্ন করেন, ‘পড়ালেখা কেমন যাচ্ছে? তোকে মাদ্রাসা থেকে স্কুলে এনেছি। আমার মানসম্মান রক্ষা করিস। ক্লাস এইটে ফার্স্ট হওয়া চাই।’

এমনই কিছু কথা শেষে স্যার আরও বললেন, ‘আচ্ছা রে, তুই যে মাদ্রাসা ছেড়ে স্কুলে আসার জন্য আমার পা জড়িয়ে ধরে এমন মরাকান্না শুরু করলি, বিষয়টা কী? হুজুর কি তোকে খুব মারধর করত?’

‘না স্যার, মারধর করত না।’

‘তবে?’

‘কী আর বলব, স্যার। এত বড় একটা মাদ্রাসা। নেই একটা হুঁকা।’

‘কী, কী বললি! মাদ্রাসায় নেই হুঁকা।’

হেড স্যারের সামনে ভয়ে জড়সড় মবিন। কী বলতে কী বলে ফেলে। হঠাৎ নিজেকে ফিরে পেয়ে সে অফিস কক্ষ থেকে দ্রুত বের হয়ে দেয় এক দৌড়।


ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>