বেড়ানো: হিরোশিমার মিয়াজিমা দ্বীপে একদিন
জাপানের প্রথম সারির দর্শনীয় পর্যটন স্থানগুলোর নাম বললে দেশটির পশ্চিমে অবস্থিত হিরোশিমার মিয়াজিমার দ্বীপটির নাম প্রথম তিনে আসবে। মিয়াজিমা দ্বীপ জাপানিদের কাছে বিখ্যাত তীর্থ স্থান। এই দ্বীপের রয়েছে প্রাচীন কৌতূহলোদ্দীপক ইতিহাস। আর আছে অপূর্ব মেধাসম্পন্ন স্থাপনা। প্রাচীন গির্জা ও ঘন জঙ্গলের জন্যও এটি বিখ্যাত।
এ ছাড়া অনেক পুরোনো বিশাল বিশাল পাথরের মূর্তি ও ধর্মীয় পাহাড় আছে এখানে। এই দ্বীপটিকে তীর্থযাত্রী ও অন্য মানুষেরা বিশ্বস্ততার প্রতীক এবং এখানে এলে তাঁরা নিজেদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবান মনে করেন।
ইৎসুকুশিমা মঠ
মিয়াজিমার আরেক নাম ইৎসুকিশিমা। জাপানি ভাষায় ইৎসুকিশিমা শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ঈশ্বরদের জন্য উৎসর্গকৃত দ্বীপ। সেতো নামক সমুদ্রটির পানিতে ইৎসুকিশিমা নামে এখানে বেশ প্রাচীন এই মঠ রয়েছে। মিয়াজিমাতে এসে প্রথমেই আমাদের চোখে পড়ে এই মঠটি। বছরের প্রথম দিনে অনেক ভিড় থাকায় বিকেলের দিকে আমরা এই মঠ ঘুরে দেখি।
মঠটি প্রায় বারো শতকের দিকে সম্পূর্ণ ভাসমান অবস্থায় নির্মিত হয়। এর আয়তন প্রায় ২৭১ বর্গমিটার। ইৎসুকুশিমা মঠে প্রবেশের মুখে কমলা রঙের ভাসমান দরজাটিও এখানে একটি দর্শনীয় ও পূজনীয় বিষয়। দরজাটির নাম তরি। জাপানি বিশেষ কৌশলে বানানো এই দরজাটি কোনো রকম অন্য কিছুর সাহায্য ছাড়া নিজেই পানির ওপর ভাসমানভাবে দণ্ডায়মান থাকে।
শিন্তো নামক প্রাচীন ধর্মের অনুসারীদের এটি পুণ্য স্থান। কথিত আছে, বারো শতকে সিকি নো কুরামোতো নামে এক ব্যক্তি এটি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কিয়োমোরি তাইরা নামে এক সামরিক শাসক এই মঠ পুনর্নির্মাণ ও সুসজ্জিত করেন। এই মঠে উপাসনার আসল জায়গাটি তিনজন দেবীকে উৎসর্গ করা। এখানে উপাসনা বা পূজা করার অনেক জায়গা রয়েছে। একটি ছাদবিহীন স্থানও রয়েছে। পুরো জায়গাটি ঘুরে একটা শান্তি শান্তি ভাব অনুভব করলাম আমি।
এখানে কোনো জীবের জন্ম বা মৃত্যুর অনুমতি দেওয়া হয় না। আর কারও মৃত্যু হলে সমাহিত করা হয় না। অসুস্থ মানুষ বা গর্ভবতী নারীদের প্রসবের আগে স্থলভাগে নিয়ে সুব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
বিভিন্ন আকারের করিডর দ্বারা যুক্ত ছাপ্পান্নটি কুটির ঘরের মতো বাসা ও তিনিটি আলাদা আলাদা ঘরসহ এই মঠটি সেতো সাগর থেকে এক পাশে ভাসমান অবস্থায় অবস্থিত।
প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটকসহ অনেক তীর্থযাত্রী আসেন এই স্থানটি দর্শন করতে। এটির কৌশলগত নির্মাণের কারণে হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে এই মঠের ভেতর অবস্থান বা হাঁটাচলা করতে পারেন। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মঠে প্রবেশের ভাসমান তরি দরজাটির বর্তমানে সংস্কারকাজ চলছে।
মঠের প্রবেশমুখে পানির ছোট চার কোনা চৌবাচ্চা থেকে কাঠের তৈরি বিশেষ চামচে করে পানি খাওয়াকে এখানে পুণ্য হিসেবে ধরা হয়। আমরাও সেভাবে পানি পান করেছি।
মিয়াজিমাতে আমাদের আশপাশে অনেক হরিণ চোখে পড়ে। খুব বন্ধুবৎসল এরা। শিন্তো ধর্মমতে এই হরিণগুলো ঈশ্বরের আরেক রূপ এবং এরা শান্তির প্রতীকও বটে। এটা এদের অভয়ারণ্যও বলা চলে।
পাঁচতলা প্যাগোডা
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জন্য নির্মিত টকটকে সিঁদুররঙা পাঁচতলা এই প্যাগোডাটি চৌদ্দ শতকে নির্মিত হয়। এই প্যাগোডাটির অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলীর জন্য কাছে, দূরে, গাছের নিচ থেকে, প্রায় সবদিক থেকেই এটিকে দেখতে অসাধারণ সুন্দর লাগে।
পাথরের পাহাড়
মিয়াজিমার মিসেন পর্বতটি হলো ওখানকার আরেকটি সবচেয়ে উঁচু, পুরোনো ও পূজনীয় একটি পর্বত। এটি অনেক বিশাল বিশাল পাথরের পাহাড়। পাথরগুলো আগ্নেয়গিরির লাভা উদ্গিরণের পর দিনের পর দিন জমে জমে আগ্নেয় পাথরে পরিণত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে এই পাহাড়টি ধর্মীয় লোকজনদের সমাগমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিতে রূপান্তরিত।
কথিত আছে এই পাহাড়ের ভেতর থেকে মাঝেমধ্যে রাতবিরাতে কাঠের ঠক ঠক আওয়াজ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা বলেন, এই আওয়াজ একজন অপদেবতা করে থাকে। এই আওয়াজ করার সময় সবাইকে ঘরের ভেতরে অবস্থান করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কেননা, বেরোলেই সেই অপদেবতা দ্বারা অভিশাপ পাওয়ার দুর্ভাগা হতে হয়।
মিসেন পর্বতের চূড়াটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৫৫ ফুট ওপরে। এখান থেকে সেতো সমুদ্রের এক পাশের প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। অসাধারণ সৌন্দর্য এর।
রোপওয়ে
মিয়াজিমার রোপওয়ে বা কেবল কার ভ্রমণ একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা আমাদের। এটা আমার প্রথম কেবল কারে ওঠার অভিজ্ঞতা। আমরা সেখানে মোমিজিদানি লাইনটি রোপওয়েতে ভ্রমণ করেছি। প্রাচীনকালের ঘন জঙ্গলের ওপর দিয়ে রোপওয়েতে যাওয়ার সময় প্রায় পুরো জঙ্গলটির উপরিভাগ যেমন দেখা যায় তেমনি সেতো সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অবলোকন করা যায়। প্রায় দশ মিনিট লাগে আমাদের এই উঁচু ভ্রমণ শেষ করতে।
পাহাড়ে চূড়া থেকে সমুদ্র দেখা শেষ করে আমরা ডাইসন গির্জা থেকে নিচে আসল ভূমিতে ফেরা শুরু করি। সেখানে একটি ফলকে ম্যাপের নির্দেশিকা গুগল ট্রান্সেটরের মাধ্যমে পড়ে সঠিক পথ খুঁজে নিই। মোমিজিদানি লাইনের অপর প্রান্তে রোপওয়ে থেকে নেমে আমরা হেঁটে নিচে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম।
তাহলে প্রচীন এই জঙ্গলটিও আমাদের দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারিনি ঠিক কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে নিচে নামতে। যা হোক, আমার দুই বাচ্চাসহ আমরা ডাইসন গির্জা থেকে ঢালুর দিকে নামানো পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ বৃষ্টির মতো সঙ্গে জুটে গেল পাঁচ সদস্যের এক জাপানি পরিবার। চমৎকার, চিরচেনা কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমে একসঙ্গে পাথরের তৈরি খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম আমরা।
প্রায় ২ দশমিক ৬ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ আমরা পাড়ি দিলাম প্রায় দুই ঘণ্টায়। বাচ্চাদের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল ভীষণ। কিন্তু ওরা দারুণ শক্তি, সাহস আর মনোবল দেখাল এই পথ নামতে। সঙ্গে জাপানি পরিবারের সবাই এত আন্তরিক ছিল যে বারবার খেয়াল রাখছিল নামার সময় আমরা যেন পিছলে পড়ে না যাই। সিঁড়িগুলো মাত্রাতিরিক্ত খাড়া, আঁকাবাঁকা আর পিচ্ছিল। অনেক সতর্কভাবে পা ফেলে নামতে হয়। না হলে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
ঘন জঙ্গলটির ভেতর দিয়ে আসার সময় রাস্তার দুই পাশে বিশাল আকৃতির অনেক পাথর, ঝরনা ও হরিণ দেখতে পেলাম। কিছু কিছু ফলকের কথা আমরা ইংলিশে জেনে নিলাম জাপানি পরিবারটি থেকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো আমাদের। তারা ইংলিশ জানে ও বোঝে। তারা জানাল, এখানকার গাছগুলো প্রায় সবই ঔষধি। এটাও জানাল, এখান থেকে গাছ বা চারা নিয়ে গিয়ে লাগানো নিষেধ আছে। এটা করা মহাপাপ।
এখানে পাহাড় ও পাহাড়ে আরোহণের পথ এতটাই খাড়া আর আঁকাবাঁকা যে প্রতিবছর পর্বতারোহী হারিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। এ জন্য নির্দেশিকা দেওয়া আছে সঙ্গে কম্পাস ও সঠিক মানচিত্র সঙ্গে রাখার।
প্রায় দুই ঘণ্টা খাড়া পাথরের সিঁড়ি মাড়িয়ে নিচে নামার পর সমুদ্রের পাড়ে বসে স্থানীয় খাবার খেতে খেতে মনে হচ্ছিল এত প্রশান্তিময় পাহাড় তো আমাদের দেশেও আছে। খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে আমরাও করতে পারি এমন রোপওয়ে অথবা নিরাপদে, নিশ্চিন্তে, ভয়ভীতিহীনভাবে পাহাড়ে ওঠানামার সুব্যবস্থা। মিয়াজিমিতে পাহাড়ে ওঠার নিয়মের ভেতর একটা নিয়ম হলো কেউ ময়লা আশপাশে যেন না ফেলে। বরং সেটা ব্যাগে ভরে বাসায় এনে ফেলতে বলা হয়েছে।
দেখতে দেখতে ঘুরতে ঘুরতে মিয়াজিমাতে কেটে গেল প্রায় সাতটি ঘণ্টা। ফেরিতে ফেরার সময় সমুদ্র থেকে রাতের মিয়াজিমি দ্বীপটিকে দেখে কেবলই মনে হচ্ছিল মিয়াজিমা দ্বীপটি সত্যি একটা ঘোর লাগা মায়া।