বেড়ানো: কোরাল দ্বীপের হীরা-পান্না

সারি সারি রঙিন সাম্পান, মেরিন ড্রাইভ থেকে তোলা। ছবি: ডা. রোনে সুজন ক্লোদ সরকার
সারি সারি রঙিন সাম্পান, মেরিন ড্রাইভ থেকে তোলা। ছবি: ডা. রোনে সুজন ক্লোদ সরকার

ছোট্ট কিন্তু ছিমছাম ডোমেস্টিক প্লেনটায় চেপে সবে সিটবেল্ট হাতড়াচ্ছি, জাহাজের ক্যাপ্টেন উৎসাহের সঙ্গে অনর্থক বাকবাকুম করে যাচ্ছেন। তাঁর বিষয়বস্তুর ভেতর আছে সকালের মিষ্টি রোদ, চমৎকার আবহাওয়া আর পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে ইত্যাদি শুভযাত্রামূলক কথাবার্তা।

বৈমানিক না হয়ে উপস্থাপিকা হলেও তাঁকে বেশ মানিয়ে যেত। তবে অতি কথনের ফলে সেদিন (১৬ ডিসেম্বর) তিনি দুবার করে সবাইকে বিজয় দিবসের বদলে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। একবার বাংলায় আরেকবার ইংরেজিতে। ভীষণ একটা অস্বস্তি নিয়ে ব্যাপারটাকে ‘স্লিপ অব টাং’ ধরে নিলাম।

এক ফাঁকে বিমানবালা এসে আঙুলের ফাঁকে লাল-সবুজ কাগজের পতাকা গুঁজে দিয়ে গেলেন। শিশুতোষ আগ্রহে পতাকা ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বিজয় দিবস গুলিয়ে ফেলার গুরুপাপটা মাফ করে দেব কি না ভাবছি। স্বাধীন দেশে ভুল করার স্বাধীনতা লোকের থাকতেই পারে। এখন শুধু ভুল করে আমাদের ঢাকা-টু-কক্সবাজারের বদলে আরেকখানে উড়িয়ে নিয়ে না ফেললেই হলো।

এই ভ্রমণের মাথামুণ্ডু কিছুই জানি না। গন্তব্য আপাতত কক্সবাজার হলেও আসলে সেখান থেকে যাচ্ছি সেন্ট মার্টিন। ব্যস, এর বেশি কিছু জানানো হয়নি। এটা নাকি একটা সারপ্রাইজ ট্যুর। তাই চাপাচাপি করতে গেলে রহস্যের মুচকি হাসি ছাড়া আর কোনো উত্তর মেলেনি। খালি বলা হয়েছে, যেন চক্করবক্কর জামা না পরে সাধারণ জিনস-ফতুয়া আর আরামদায়ক চপ্পল পরে আসি। আর হালকা একটা কাঁধের ঝোলায় খানকতক কাপড় পুরে আনি।

যাত্রাবিরতিতে ছানাপোনার মাঝে রোনে সুজন ক্লোদ সরকার। ছবি: ডা. আফরিন জাহান
যাত্রাবিরতিতে ছানাপোনার মাঝে রোনে সুজন ক্লোদ সরকার। ছবি: ডা. আফরিন জাহান

কথা পুরোপুরি রাখা সম্ভব হয়নি। ব্যাগে কী সব হাবিজাবি পুরে জগদ্দল পাথর বানিয়ে এনেছি। দেখতে লাগছে উইয়ের ঢিপির মতন। সেটাকে ওভারহেড বাংকারে আঁটাতে না পেরে আসনের নিচে আশ্রয় দিতে হয়েছে। পা ছড়িয়ে বসার আরামটুকু এখন সম্পূর্ণ বেদখলে।

পুরো ভ্রমণের নীলনকশা এঁকেছেন আমার ভাই রোনে আর ঝুমু আপু মিলে। আপু ডাকলেও সম্পর্কে ভাবি হন। তাঁর ছটফটে স্বভাবের সঙ্গে ভাবি ডাকটা ভারিক্কি লাগে দেখে সেদিকে যাই না। তবে ‘আপনি’ বলার সহবতটুকু মেনে চলি। ওদিকে সাত বছরের বড় ভাইয়ের বেলায় আদবকেতার ব্যাপারগুলো কেন যেন ঠিক মনে আসে না।

যা হোক, পেশায় মারাত্মক ব্যস্ত এই দুজন ডাক্তার মানুষ কীভাবে যেন তাঁদের রুটিন থেকে দিন কতক ছুটি ম্যানেজ করে আমাদের ভজিয়ে–ভাজিয়ে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবছর প্রবাস থেকে দেশে ফিরে সেই এক ঢাকাতেই ঘুরপাক খেতে থাকা আমরা এমন নিরুদ্দেশ হওয়ার সুযোগ লুফে নিতে তাই দুবার ভাবিনি। তা ছাড়া এ যে ছুটির ভেতর ছুটি!

৪০ মিনিটের মাথায় কক্সবাজারের মাটি ছুঁয়ে ফেললাম। আমাদের সাতজনের দলটা বিমান থেকে প্রায় লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম। সাতজন বলতে দুই ছানাপোনাসমেত ভাইয়া-আপুরা চারজন আর এদিকে ছোট এক ছানা, তার বড় এক বাবা আর মাঝারি আমি—এই আমরা তিনজন। ছানাদের কারও বয়স সাত, কারও বারো, কারওবা পাঁচও হয়নি। তবে সেদিন আমরাও শিং কেটে বাছুর বনে গেছি। কারণ, প্লেন থেকে নেমেই ডাবল ডিজিটের গম্ভীর বয়সগুলোকে বঙ্গোপসাগরের পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে এক ধাক্কায় সিঙ্গেল ডিজিটের আট-নয় বনে গেছি। হারিয়ে যাওয়ার আজ নেই মানা।

নাফ নদীর ঘাট। ছবি: লেখিকা
নাফ নদীর ঘাট। ছবি: লেখিকা

এখানে সাগর থেকে উড়ে আসা নোনা স্বাদের বাতাসটা অদ্ভুত রকমের তাজা। জোরে একটা দম নিয়ে আত্মহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম সবাই, ‘হিপ হিপ, হুররে...!’ ঘাড় ঘুরিয়ে লোকজন অবাক তাকাল। তোয়াক্কাই করলাম না। বরং শীতের সকালের কুসুম কুসুম রোদ গায়ে মেখে তিড়িংবিড়িং ফড়িং নেচে অপেক্ষায় থাকা মাইক্রোবাস বরাবর রওনা দিলাম। বাচ্চাকাচ্চারা আগে আগে ছুটছে। উঁচিয়ে ধরা কাগজের পতাকাগুলো মাতাল হয়ে উড়ছে খোলা হাওয়ায়।

দুই.মেরিন ড্রাইভ। কক্সবাজার সৈকতের সমান্তরালে বয়ে চলা পথ। ডানে সারি সারি রংবেরঙের সাম্পান অলস দাঁড়িয়ে। ডাক পড়লেই আলস্য ঝেড়ে সাগরে পাল তুলে দেবে। আর বাঁয়ে পাহাড়; যেন ঘুমিয়ে থাকা সবুজ ড্রাগন। এই বুঝি ফোঁস করে জেগে উঠল। পাহাড়ের আঁচলে কখনো পানের বরজ, কখনোবা ধানখেতের আলে জাবর কাটায় ব্যস্ত একটা–দুটো গরু।

সৈকতে নারকেলের রাজ্য। ছবি: আহমেদ রুমি
সৈকতে নারকেলের রাজ্য। ছবি: আহমেদ রুমি

সেই শৈশবে, পাঁচ বছর বয়সে একবার কক্সবাজার এসেছি। তবু স্মৃতিতে সমুদ্রের গর্জন আর লাল কাঁকড়া ঠিকই রয়ে গেছে। তার সঙ্গে এখন যোগ হলো পথের দুই ধারের অপরূপ ছবিগুলো। কাচঢাকা গাড়ির ভেতরে বসে আমরা যতটুক পারছি হাঁ করে দেখছি। বাচ্চারাও ট্যাঁ-ফো থামিয়ে দিয়েছে। তাদের চোখে-মুখে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের বিস্ময়।

ছাপরা দোকানে ঝুলিয়ে রাখা কচি ডাব দেখে তেষ্টা পেয়ে গেল। যাত্রাবিরতি নেওয়া দরকার। ড্রাইভার মোতালেব বিশাল মাইক্রোবাসটা কসরত করে এক পাশে থামাল। জনপ্রতি একটা করে ডাব নিয়ে নড়বড়ে চেয়ারে আর বেঞ্চিতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসেছি সবাই আয়েশি ভঙ্গিতে। পানি খেয়ে শেষ করার পরে ডাব দুই ভাগ করে দেওয়া হলো। সঙ্গে ডাবের এক কোনা কেটে চামচ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাঁস খাওয়ার জন্য।

আমি ডাব-নারকেলের বিশেষ একটা ভক্ত নই। কিন্তু ভাইয়া আর ঝুমু আপু দুজন দুদিক থেকে চাপাচাপি জুড়েছেন। বিপদ বুঝে এক কাপ চা হাতে নিরাপদ দূরত্বে পিছলে গেলাম। কিন্তু ছাড়া পেল না তাফসু মিয়া। তার দুই পাশ থেকে রেন আর রন জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরা ভাইয়া-আপুর যোগ্য উত্তরসূরি। কারণ, সাড়ে চার বছরের তাফসু মিয়ার হাতে তার মাথার সাইজের একটা ডাব দেখা যাচ্ছে। তাকে এক টুকরো শাঁস মুখে তুলে দেওয়া হচ্ছে। বেচারা পিয়ার প্রেশারে পড়ে জিনিসটা গিলে ফেলে ঠোঁটের কোণে বোকাটে হাসি ঝুলিয়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে।

কোত্থেকে লম্বা কানের কালো একটা ছাগল জুটে গেছে। ছুড়ে দেওয়া ডাব থেকে চেটেপুটে শাঁস খেয়ে তৃপ্তির একটা ব্যা ব্যা ঢেঁকুর তুলে সে গা এলিয়ে বসেই পড়ল পায়ের কাছে। তাকে হতাশ করে চায়ের কাপে শেষ চুমুক মেরে উঠে দাঁড়ালাম। বেণি দুলিয়ে রেন এসে ঘাড়ে ওপর এসে তাড়া দিতে লাগল, ‘রিম, তাড়াতাড়ি। চলো, গাড়িতে উঠি।’

পান্নারঙা বঙ্গোপসাগর। ছবি: ডা. রোনে সুজন ক্লোদ সরকার
পান্নারঙা বঙ্গোপসাগর। ছবি: ডা. রোনে সুজন ক্লোদ সরকার

রেনের চেহারা হুবহু আমার মতো। একেবারে যমজ বলে ভুল হওয়ার মতো অবিকল। যদিও আমি তার ফুফু এবং বয়সে তিন গুণ। কিন্তু ওসব ফুফুটুফুর ধার আমরা দুজনের কেউই ধারি না। সুতরাং, ডাকাডাকিগুলো ডাকনামেই চলে। একই স্বাধীনতা সাত বছরের বেজায় দুষ্টু ছেলে রনকেও দেওয়া আছে। সেও খানিক দূর থেকে নাম ধরে চেঁচিয়ে চলছে, ‘এ্যাই রি-ই-ই-ই-ম...’।

তিন.
নাফ নদীর ঘাটে আগে থেকে ঠিক করা স্পিডবোট দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রার আয়োজনে কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। মনে মনে তারিফ করতেই হলো। লাইফজ্যাকেটগুলো চাপানোর পর তীব্র কটকটে কমলা রঙে চারপাশে রীতিমতো আগুন লেগে গেল। আমাদের স্পিডবোট পঙ্খিরাজের বেগে ছুটে চলল ঘোলাটে নদীর ঢেউ চিরে।

হঠাৎ আবিষ্কার করলাম সাগরে এসে পড়েছি। জলের রং বদলে গেছে। এই রং না নীল, না সবুজ। বরং একটা পাথরের সঙ্গে খুব মিল। ঝকঝকে ফিরোজা আকাশটা দেখে চট করে মনে পড়ে গেল। এই সাগরের পানি আসলে পান্না রঙের। রোদের ছোঁয়ায় ঢেউয়ের চূড়াগুলো পান্নার মতো ঝিকমিক করছে। মাথার ওপর ফিরোজা আকাশ, পায়ের নিচে পান্না সাগর আর সারা গায়ে কাঁচা সোনা রোদ—মণি–মানিক্যের বেশুমার ছড়াছড়ির ভেতর আমরা, গৎবাঁধা শহুরে মানুষগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে আছি।

খানিক বাদে ছোট্ট একটা দ্বীপ ভেসে উঠল সাগর ফুঁড়ে। স্পিডবোট গতি কমিয়ে শূন্যে নিয়ে আসল। নৌকা আর চলবে না। স্বচ্ছ জলের নিচে কোরালের উঁকিঝুঁকি দেখে বুঝে নিলাম। হাঁটুপানিতে নেমে পড়তে হবে জিনস গুটিয়ে। বাচ্চাগুলোকে কোলে করে পার করে দেওয়া হলো। টালুমালু খেতে খেতে জল ডিঙিয়ে পাড়ে এসে নরম বালুতে পা ডুবিয়ে দাঁড়ালাম। সারি সারি নারকেলগাছের পাতাগুলো মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে আবার বাতাসে এঁকেবেঁকে নির্বিকার বইতে লাগল।

সেন্ট মার্টিনে লেখিকারা। ছবি: আহমেদ রুমি
সেন্ট মার্টিনে লেখিকারা। ছবি: আহমেদ রুমি

পাড়ে দাঁড়ানো জনাকয়েক লোক এসে একে একে ভাইয়াকে জাপটে ধরছে। সেও সহাস্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়ছে। ‘আরে চাচা, কেমন আছেন? কী খবর সুমন, ইয়াসীর কই?’ এখানে ভাইয়া ছানাপোনা নিয়ে আগেও এসেছিলেন। নাম মনে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা আর উষ্ণ স্বভাবের কারণে তিনি যেখানে যান, লোকজন তাঁকে নিজেদের একজন বানিয়ে নেয়। এখানেও তাই।

দূর থেকে দেড়–ফুটি আরেকজন দুর্বার গতিতে ছুটে আসছে। তার গায়ে গোলাপি শার্ট। পরনে ঢলঢলে হাফপ্যান্ট, যেটা যেকোনো দুর্বল মুহূর্তে খুলে পড়তে পারে। তীরের কাছে এসেই সে আমাদের রনকে পেয়ে ঈদের কোলাকুলি করে নিল প্রায়। রনও আনন্দে গলা ফাটিয়ে হুংকার ছাড়ল, ‘ইয়াসী-ঈ-ঈ-র...!’ এই তাহলে ইয়াসীর। আগেরবারে বেড়াতে এসে তার সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব বনে গিয়েছিল রনের।

ইয়াসীরকে ঘিরে বাচ্চারা হইহই করছে খুশিতে। সেও স্থানীয় কক্সবাজারীয় আর সেন্ট মার্টিনীয় উচ্চারণের মিশেলে হিংপিং করে কী কী যেন বলছে। ভালো করে শুনেও কিছু বুঝতে পারলাম না। হাল ছেড়ে বাকিদের সঙ্গে পা মিলিয়ে কোরাল দ্বীপের মিহি বালু মাড়িয়ে এগোতে থাকলাম। (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।