শেষ ইচ্ছা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল।

ফোন ধরে হ্যালো বলতেই কানে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠ। এগারো বছর পর আজ ফোনে তাঁর কণ্ঠ।

আমার এক সাবেক কলিগ। নাম শাইখ। আমরা একসঙ্গে দুই বছর চাকরি করেছি। এ সময় আমাদের দুজনের জীবনের প্রায় সব গল্পই শেয়ার করা হয়ে গেছে। তারপর একদিন হঠাৎ করে কী এক জরুরি প্রয়োজনে তিনি দেশে যান। যাওয়ার সময় তাঁর হাতে মায়ের জন্য পাঁচ শ অস্ট্রেলিয়ান ডলার দিই। এক শ ডলারের পাঁচটি নোট।

মা চেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ডলার দেখতে। এক শ ডলারের চেয়ে বড় কোনো নোট অস্ট্রেলিয়ায় নেই। তাই এক শ ডলারের নোটই পাঠিয়েছি। কারণ, মা যদি বলে বসেন, ‘কী রে, তোর কাছে কি দশ-বিশ টেহা নোট দেখতে চাইছি?’ তখন কী জবাব দেব। না, কিছুতেই মাকে রাগানো যাবে না।

একটা সাদা খামে করে পাঁচ শ ডলার শাইখ সাহেবের হাতে দিতেই তিনি বেশ খুশি মনে বললেন, ‘ভাই, আমি যাওয়ার পথেই খালাম্মাকে ভিজিট করে যাব। তাঁকে দেখিয়ে গুনে গুনে তাঁর হতে দেব। দেখব, অস্ট্রেলিয়ান ডলার দেখে খালাম্মার কী প্রতিক্রিয়া হয়।’

না, শাইখ সাহেব আমাদের বাড়িতে যাননি। টাকাটা মায়ের হাতে পাঠানোর ব্যবস্থাও করেননি। এক সপ্তাহ। দুই সপ্তাহ। মাস। বছর। কোনোভাবেই তাঁর আর পাত্তা পাওয়া গেল না।

অপরিচিত নম্বর থেকে সেই শাইখেরই ফোন।

: ভাই, আমি সেন্টজর্জ হাসপাতালে আছি। কাইন্ডলি একটু সময়ের জন্য হলেও আসুন। তবে বেশি দেরি করবেন না।

: জি ভাই, আজ বিকেলেই আসছি।

গিয়ে দেখি শাইখ সাহেব হাসপাতালের বেডের সঙ্গে মিশে আছেন।

আমাকে দেখেই তিনি বললেন, আপনার মা কি বেঁচে আছেন?

: না ভাই, মা নেই।

: খালাম্মাকে অস্ট্রেলিয়ান ডলার দেখাতে পেরেছিলেন কি?

এ কথা বলেই তিনি টেবিলের ওপর একটা খাম রেখে বললেন, এখানে পাঁচ শ ডলার আছে। নিয়ে যাবেন প্লিজ।

এ বিষয়টার ওপর আমি এতই বিরক্ত যে খামটার দিকে আর তাকানোর প্রয়োজনও মনে করিনি। মায়ের জন্য পাঠানো টাকাটা। মা–ই যখন নেই, এই টাকা নিয়ে আর কী হবে।

বিনা কারণে কষ্ট পাওয়া আমার স্বভাব নয়। তাই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম, আপনার শরীরের এই অবস্থা, অথচ একটু জানতেও পারলাম না। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে কত চেষ্টা করেছি, কাজ হয়নি। কমিউনিটির কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি।

: খোঁজ দেবে কী করে। কারও সঙ্গেই যোগাযোগ নেই যে।

: ভাবি-সন্তানেরা ভালো তো সব?

: না ভাই, সন্তান তো নেই। আর আপনার ভাবি চলে গেছে। শান্তা ওর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। বেশ ভালোই আছে।

: আপনাকে ফেলে চলে গেল?

: আরে ভাই, ওই দিন কী আর আছে? ফোর্থ স্টেজে কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আমার বুকের ভেতরটা একেবারে পচে গেছে। শান্তার মতো একটা ইয়াং মেয়ে আমার মতো পচার সঙ্গে ঝুলে থাকবে কিসের আশায়?

এ ধরনের অতি কঠিন বাস্তবতায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মানুষের মাঝে যদি মানবিক আবেগগুলো না থাকে, তবে আমার কাছে এ বেঁচে থাকা অর্থহীন।

তাই আবারও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে হেসে বললাম, শাইখ ভাই, একবার খুব দরদ দিয়ে নীরার গল্প করেছিলেন। আপনার ভাবির সুস্বাদু রান্না খেয়ে আমার অবস্থা এমন হয়েছে যে বাইরের খাবার খেতেই পারি না। অথচ আপনার গল্পটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলাম বলে আমাকে জোর করে বাঙালি রেস্টুরেন্টে নিয়ে ডিনার করিয়ে ছেড়েছেন। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আছে কি?

ফ্যাকাশে মুখটায় এতক্ষণে হাসির আভাস দেখা দেয়।

শাইখ বলেন, জি ভাই, যোগাযোগ আছে। আগামী শনিবার সে সিডনি আসছে। সকাল সাতটায় ল্যান্ড করবে। ক্যানসার ধরা পড়ার পর যোগাযোগ করেছিলাম। মরার আগে একটু কথা বলার খুব ইচ্ছে করছিল। নীরার সঙ্গে এইটুকু যোগাযোগেই শান্তার সন্দেহ কঠিন রূপ ধারণ করে। খুঁড়তে শুরু করে এ সম্পর্কের তলদেশ। আমাকে সে ছেড়ে যেতই। কারণ, বিয়ের পর থেকে এত বছর সে খুব চেষ্টা করেছে আমাকে অধিকার করতে। পারেনি। পারবেই-বা কী করে। অভিনয় জানি না যে। তাই নীরার সঙ্গে যোগাযোগের এই ইস্যুটা ধরে সে খুব সহজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পেরেছে।

: বলেন কী শাইখ ভাই! এটা কী কোনো কথা? এখন যে ছেলেকে তিনি বিয়ে করেছেন, তার জীবনেও যে এর চেয়ে বড় কোনো ঘটনা নেই উনি কী করে জানবেন? মানুষ কি অতীত জীবনটা বন্ধক রেখে বিয়ে করে?

শাইখ সাহেব এবার শব্দ করে হেসে বললেন, ভাই রে, কাউকে ধরার সুযোগ পেলে কে আর ছাড়ে। হাসান ভাই, আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগছে। অন্তিম সময়ে এইটুকু ভালো লাগাও কম কিসে। দেখি নীরা যদি আসে। মনে হয় আরও একটু ভালো লাগা নিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানাতে পারব। আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। ডাক্তার বলেছেন চার দিন। দেখুন, কী আশ্চর্য! ওর জন্য অপেক্ষা করতেও ভালো লাগছে। ঠিক যেন ওই ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পেছনে ছোট্ট পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার মতো।

তাঁর বলার ভঙ্গি দেখে খুব হাসি পেল আমার। বললাম, নীরাকে নিয়ে আপনার ওই গল্প আমার খুব ভালো করেই মনে আছে।

শাইখ সাহেব এবার নীরব। ব্যাপার কী! এই নীরবতার কারণ বুঝলাম না। খেয়াল করে দেখি, তাঁর চোখ দুটো ভেজা। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। না, আমি এ কান্নার কারণ জানতে চাচ্ছি না। জানি, সমস্ত ভালোবাসা ছাপিয়ে মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকে জীবনের প্রতি ভালোবাসা। ওই পরিস্থিতি এলেই কেবল মানুষ টের পায়। পড়াশোনার প্রতি বরাবরই ছিলেন যত্নবান। সুখী-সুন্দর একটা জীবনের জন্য উনি খুব চেষ্টা করেছেন।

: হাসান ভাই।

: জি, বলেন।

: আপনাকে আজ এমন একটা কথা বলব, যা শুনে অবাক হবেন।

: অবাক হব?

: জি। মৃত্যুর পর আমার দেহটা আপনার বাসার কাছে ওই মেট্রাভিল ক্রিমেটোরিয়ামে দাহ করা হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সেটাই বলে দিয়েছি।

আরে এ লোক বলে কী! আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বললাম, শাইখ ভাই, সবকিছু নিয়ে রসিকতা ভালো না। এই মাটির রূপরসগন্ধে দেহটা তৈরি। মৃত্যুর পর এই দেহ আবার মাটিতে মিশে যাবে। এর চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে।

এবার তাঁর চোখজুড়ে নেমে এল এক চাপা কষ্টের ছায়া।

: ভাই রে, নীরাকে হারানোর পর থেকে মনটা কেবল পুড়েই যাচ্ছে। এদিকে ক্যানসারে পুড়িয়েছে ভেতরটা। কেমো দিতে দিতে একেবারে শেষ। সবশেষে এই শরীরটাও পুড়ে যাক। দেখি কেমন লাগে। মানুষের তৈরি করা নিয়ম রীতির খাঁচায় বন্দী থেকে কষ্টই পেলাম শুধু। এবার মুক্ত পাখির মতো আকাশে উড়তে চাই। বলেছি, শবদাহ শেষে ছাইগুলো সাবলাইম পয়েন্ট, ব্লু-মাউন্টেনের ইকো পয়েন্ট অথবা কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে যেন আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়। আমার শেষ অনুরোধ ওরা রাখবে কি না, জানি না, তবে ভাবতে ভালো লাগছে।

যত দূর জেনেছি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে নীরা আর শাইখের মন দেওয়া-নেওয়া। বিষয়টা অভিভাবক পর্যন্ত গড়িয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হবে, এমনই একদিন নীরা ইংল্যান্ডের পাসপোর্টধারী এক ছেলেকে বিয়ে করে ফেলে। তারপর শাইখ কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলে এক মাসের মধ্যে পারিবারিক পছন্দে তাঁর বিয়ে হয়। শুরু হয় রোবটের মতো জীবন। জন্মায় দেশের প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা। এ থেকেই তাঁর অস্ট্রেলিয়ার আসা। ইংল্যান্ডে তাঁর বেশ কয়েকজন আত্মীয় আছেন। তাঁদের অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করেছেন। এমনকি ইউরোপের কোনো দেশে যেতেও তিনি সম্মত হননি। কারণ, ইউরোপ শব্দটা শোনামাত্রই তাঁর নীরার কথা মনে পড়ে। তাই তিনি বেছে নিয়েছেন ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে দক্ষিণ গোলার্ধের এই দেশকে।

: আচ্ছা হাসান ভাই।

: বলেন।

: মানুষ মরার পরে কোনো জীবন কি সত্যিই আছে?

: ভাই, মাফ করবেন। এসব আলোচনা এখন ভালো লাগছে না।

শাইখ সাহেবের কাছে বিদায় নিয়ে হাসপাতালের অ্যাডমিনে আমার নম্বর দিই। যেকোনো ইমারজেন্সিতে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করি। বাসায় এসে কমিউনিটির বড় ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টা বললাম। ক্রিমেশনের কথা শুনে তারাও হতভম্ব। কবরের প্লট কিনে দাফন করা অনেক খরচের ব্যাপার। কমিউনিটিতে যে সাড়া পেলাম তা আশানুরূপ নয় তখনো। চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।

দুদিন পরের ঘটনা। সেদিন শুক্রবার। অফিস শেষে বাসায় ফিরছি। সেন্টজর্জ হাসপাতাল থেকে ফোন এল। ফোনটা রেখে শরীরটা আমার থরথর করে কাঁপতে থাকে। রাস্তার পাশে গাড়িটা পার্ক করে বন্ধু অনীককে ফোন দিলাম। ড্রাইভ করার মতো অবস্থা আমার নেই। অনীক হাসপাতাল অ্যাডমিনে কথা বলছে আর আমি এসে বসলাম শাইখ সাহেবের পাশে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রুমের ভেতর আবছা অন্ধকার। লাইট অন করতে ইচ্ছে করছে না। মনে হয়, আমাদের অবচেতন মনে অন্ধকারের প্রতি ভালোবাসা আছে। শাইখের শরীরটা সাদা কাপড়ে মোড়ানো। আবেগ নিয়ন্ত্রণের কিছু মেডিটেশন আমি করেছি। এ মুহূর্তে মনের ভেতর ওই মেডিটেশনের কোনো প্রভাব দেখছি না। মাঝেমধ্যে চিৎকার করে কান্নাতেও সুখ আছে। ইচ্ছে করছে তাঁর নিথর মুখখানা দেখতে। তবে সাহস পাচ্ছি না। এ দেশের মানুষ সাধারণত মানুষের জীবনকে সেলিব্রেট করে, মৃতদেহকে নয়। তাদের এই আইডিয়াটা আমার ভালো লেগেছে।

শনিবার সিডনি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের অ্যারাইভালে একটা বোর্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর অনীক। ঠিক সাতটায় প্লেনটা ল্যান্ড করার কথা, সেটি যথাসময়েই ল্যান্ড করেছে। বোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা: ‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী নীরা, আমরা আপনার অপেক্ষায় আছি’।
–––

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া: ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>