ছোটদের বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা: অটিজম ও ছদ্মবেশ

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

তুমি কি জানো, অটিজম কী? তোমার পরিবারে বা স্কুলে কারও কারও অটিজম থাকতে পারে। এমনকি তোমার নিজেরও থাকতে পারে।

কোনো মানুষের যখন অন্য কারও সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে বা কোনো রকম যোগাযোগ করতে সমস্যা হয়, এত বেশি অস্বস্তি লাগে যে সে নিজেকে সব সময় গুটিয়ে রাখে। তাকে অটিজম বলে। তখন সেই মানুষের জীবনের অনেক স্বাভাবিক জিনিসও অন্য রকম লাগে।

যেমন কোনো মানুষের ট্রেনে উঠতে খারাপ লাগতে পারে। কারণ, ট্রেনের শব্দ হয়তো তার ভীষণ অসহ্য লাগে। কিন্তু দেখা গেল সেই মানুষটিই হয়তো পশুপাখির সঙ্গে খেলাধুলা করতে ভালোবাসে। যাদের অটিজম আছে, তাদের একেকজনের অটিজম একেক রকম হয়।

কিছু অটিস্টিক মানুষ নিজেদের ভীষণ আলাদা ভাবে। স্বাভাবিক আচরণ করার জন্য তারা এটাকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে।

যেমন, অন্য মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার জন্য সে সব সময় নিজেকে জোর করে। অথবা কারও সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে একটা প্রশ্নের লিস্ট তৈরি করে রাখে। যেন তার কথা না ফুরিয়ে যায়।

সব মানুষই মাঝেমধ্যে কিছুটা ছদ্মবেশ ধারণ করে। অর্থাৎ নিজের মনের ভাব লুকিয়ে রাখে। যেমন নতুন কারও সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তোমার খুব লজ্জা লাগছে। কিন্তু তুমি তার সামনে খুব সাহসী ভাব দেখালে। কিন্তু কিছু অটিস্টিক মানুষকে সারাক্ষণই এভাবে মনের ভাব লুকাতে হয়। এ জন্য তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়।

চলো অটিস্টিকদের ছদ্মবেশ নিয়ে জানি...।

অটিস্টিক মানুষদের ছদ্মবেশ আচরণের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরে জানতে পেরেছেন। কিন্তু ডাক্তার বা গবেষকেরা এখনো এ সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না। তাঁরা এটাও জানেন না যে, এই মনের ভাব লুকিয়ে রাখার আচরণটা তাদের সাহায্য করে নাকি আসলে পরে সমস্যার সৃষ্টি করে। গবেষকেরা অটিস্টিক মানুষকে এ সম্পর্কে আরও বেশি প্রশ্ন ও বিভিন্ন পরীক্ষা করে জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

অটিস্টিক মানুষেরা বলেছে যে, তারা মনের ভাব লুকিয়ে ভিন্ন ধরনের কাজ করে। কারণ, তারা বন্ধু বানাতে চায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্কুলে বা কাজে এটা করে। যাতে করে অন্যরা তাদের সঙ্গে কোনো ভিন্ন আচরণ না করে এবং তারা নিজেদের কাজের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে পারে।

কেউ কেউ নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা হলে এই ছদ্মবেশ নেয়। যেন তারা তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পায় এবং সহজেই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে। কেউ কেউ আবার ভালোভাবে জানাশোনা হওয়ার পর যখন বুঝতে পারে যে অন্য মানুষটা তাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করবে, তখন তারা ছদ্মবেশ ঝেড়ে তার জন্য যেটা স্বাভাবিক, অর্থাৎ অটিস্টিক ব্যবহার করতে পারে।

বিভিন্ন ধরনের ছদ্মবেশ

অটিস্টিক মানুষ বিভিন্নভাবে মনের ভাব গোপন করে ছদ্মবেশ নেয়। যেমন:

কম্পেন্সেশন 

যে কাজটি করতে তাদের কঠিন লাগে, তার অন্য কোনো উপায় বের করা। যেমন কেউ কেউ বন্ধুসুলভ হাসি দিতে পারে না। মুখভঙ্গি করতে পারে না। তারা আয়নার দিকে তাকিয়ে এই কাজটি করতে নিজেকে শেখায়।

মাস্কিং 

নিজের অস্বাভাবিক আচরণকে জোর করে লুকিয়ে রাখা। যেমন নিজের যে বিষয়ে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে, সেটা না বলা। কারণ সবাই তাতে বিরক্ত হয়।

অ্যাসিমিলেশন 

অন্যদের অনুকরণ করা। যেন কেউ বুঝতে না পারে সে ভিন্ন ধরনের। যেমন, এ ধরনের অটিস্টিক বাচ্চারা খেলার মাঠে অন্য বাচ্চাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে না। খেলে।

কেন এ বিষয়ে জানা প্রয়োজন 

এ বিষয়ে অটিস্টিক মানুষেরা বিভিন্ন ধরনের মতামত দিয়েছে। কিছু মানুষের জন্য এই ছদ্মবেশ উপকারী; কারণ এভাবে তারা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে। স্কুলে পড়ালেখা বা অফিসে চাকরি করতে পারে। কিন্তু অনেকেই চায় নিজেকে না লুকিয়েই যেন তারা বন্ধু পায়। কারও কারও জন্য এই কাজটা করা খুব কষ্টকর, নিজেকে লুকিয়ে রাখা। অনেকেই বলেছে, দিন শেষে তাদের বেশ কিছুটা সময় শুধু বসে থাকতে হয় এই ধকলের কারণে।

এক গবেষণায় এক নারী বলেছেন, তাঁর এটা খুব শ্রমদায়ক কাজ লাগে। কেউ বলেছে, নকল মানুষ সাজতে তাদের ভালো লাগে না এবং তারা চায় আসল মানুষটার সঙ্গেই অন্যরা বন্ধু হোক।

গবেষকেরা এই ছদ্মবেশী আচরণকে বিভিন্নভাবে পরিমাপ করতে চেষ্টা করেছেন। একটা উপায় হলো, এ ধরনের মানুষেরা কী ভাবে ও কেমন আচরণ করে। যদি কেউ মনে মনে ভাবে যে, তার মধ্যে অটিজম প্রবল, কিন্তু অন্য মানুষ তা বুঝতে না পারে, তার অর্থ হলো সে অনেক বেশি নিজেকে লুকিয়ে রাখছে। অন্য একটি উপায় হলো অটিস্টিক মানুষদের জিজ্ঞাসা করে জানা যে, তারা কত ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে (Camouflaging Autistic Traits Questionnaire—CAT-Q [1])।

ক্রমাগত এভাবে অভিনয় করার কারণে অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, এর ফলে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা হতে পারে। এ বিষয়ে জানা জরুরি যেন আমরা এ ধরনের মানুষকে সাহায্য করতে পারি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা মানুষকে সাহায্যও করে। যেমন স্কুলের অ্যাসেমব্লিতে যেখানে বাচ্চাদের চুপ থাকতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি অটিস্টিক মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো পরিস্থিতিতে ছদ্মবেশ নিতে পারে, সেটা তাদের আনন্দ দেয়।

ছদ্মবেশের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের প্রভাব 

কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, অটিস্টিক মেয়েরা বেশি নিজের মনের ভাব লুকিয়ে রাখে। এর কারণ হতে পারে যে মেয়েদের ওপরে মানিয়ে নেওয়ার সামাজিক চাপ বেশি থাকে বা অনেকেই মনে করেন মেয়েদের অটিজম কম থাকে। মেয়েরা যদি নিজেদের মনের ভাব ডাক্তারদের কাছ থেকেও লুকায়, তাহলে সেটা একটা সমস্যা।

লিঙ্গবৈষম্যের ব্যাপারে অনেক গবেষণা হলেও সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েরা মনের ভাব লুকানোর বিভিন্ন ধরনের কৌশল জানে। অটিস্টিক ছেলেরাও এই অভিনয় করে, কারণ তাদেরও অনেক স্বাভাবিক কাজ কঠিন লাগে।

এ বিষয়ে আরও অনেক বেশি গবেষণা দরকার। এই মুহূর্তে আমরা জানি অটিস্টিক মানুষ মনের ভাব লুকিয়ে অনেক কিছু করে। এ জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা অটিস্টিক মানুষদের জিজ্ঞেস করি যে, এই আচরণ তাদের ওপরে কীভাবে প্রভাব ফেলে। (চলবে)

Frontiers for young minds (frontiersin.org/) অবলম্বনে।